Published in বণিক বার্তা on Thursday, 16 March 2017
অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৭০ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের রচেস্টার শহরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে, যার বিষয়বস্তু ছিল পাকিস্তানের অর্থনীতি ও রাজনীতি। আমি তখন নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টোরাল ফেলো, হার্ভার্ড থেকে করা আমার পিএইচডি থিসিস সম্প্রসারণের কাজ করছি, যেটি পরবর্তীতে একটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তান: ফেইলিওর ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’। ১৯৭২ সালে বইটি প্রকাশ করে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। রচেস্টার সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন অধ্যাপক খালিদ-বিন-সাঈদ। শুরু হওয়ার পর পরই সম্মেলনটি পরিণত হয় পাকিস্তানি ও বাঙালি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উত্তপ্ত এক বিতর্ক ক্ষেত্রে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলে ছিলেন বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান ও বাগ্মী অর্থনীতিবিদ (মাহবুবুল হক, সারতাজ আজিজ, পারভেজ হাসান। আর বাঙালিদের পক্ষে ছিলেন মাত্র একজন ব্যক্তি, যিনি শুধু পাকিস্তানিদের সব যুক্তি-তর্কের সম্যক প্রত্যুত্তরই দেননি, তাদের একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন (তিনি হলেন রেহমান সোবহান। তাঁর প্রগাঢ় বাগ্মিতা, তীব্র ও রসাত্মক বিতর্কশৈলী, ধারালো খোঁচা, পাল্টা খোঁচায় বাঙালিপক্ষ সে সম্মেলনে বিতর্কে জয়লাভ করে। তাত্ক্ষণিকভাবে বাঙালিপক্ষের বীরযোদ্ধা বনে যান রেহমান সোবহান। মনে আছে, অনুষ্ঠানে উপস্থিত আমাদের মতো কয়েকজন তরুণ শিক্ষাবিদ সামসুল বারি, আবু আব্দুল্লাহ, মহিউদ্দিন আলমগীর এবং আমি নিজে রেহমানের দীপ্ত, স্পষ্ট বক্তব্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
আমি অবশ্য আরো আগে থেকেই রেহমান সোবহানের লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। তাঁর কাজ আমার পিএইচডির তত্ত্বালোচনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলাম। দুই অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক অসমতা নিয়ে লিখতেন রেহমান। আমার থিসিসে রেহমানের যুক্তিকে প্রসারিত করেছিলাম এবং রাজনীতি ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অসমতার দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলাম। রেহমানের কাজ ও আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, রাজনীতি কীভাবে অর্থনৈতিক নীতি গঠনে প্রভাব বিস্তার করছে। আর আমি কাজ করছিলাম সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে অর্থনৈতিক নীতি কী প্রভাব রাখছে, তার ওপর। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত রেহমানের বই ‘বেসিক ডেমোক্রেসি, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান’ আমার চোখ খুলে দিয়েছিল; আমাকে যেন বুঝতে শিখিয়েছিল রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যকার সুনিবিড় সম্পর্ক। আমাকে রুরাল ওয়ার্কস প্রোগ্রামের রাজনীতি বুঝিয়েছিল এ বইটি, যা এর আগে এভাবে উপলব্ধি করিনি। হার্ভার্ডে আমার পিএইচডি তত্ত্বাবধায়কসহ সব অধ্যাপকই ওয়ার্কস প্রোগ্রামের পক্ষে ছিলেন। প্রথম দিকে আমিও তাদের সঙ্গেই একমত ছিলাম। কিন্তু রেহমানের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। আমার থিসিসে আমি রেহমানের দুটি যুক্তি ধার করেছিলাম: আইয়ুব শাসনের রাজনৈতিক বৈধতা দিতে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের ভূমিকা এবং গরিব ও সচ্ছল (উদ্বৃত্ত) কৃষকদের ওপর ওয়ার্কস প্রোগ্রামের তারতম্যমূলক প্রভাব। তাঁর একাডেমিক প্রকাশনা ছাড়াও আমি ‘ফোরামে’র একজন উত্সুক পাঠক ছিলাম। ১৯৬৯ সাল থেকে রেহমান এ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি সম্পাদনা ও প্রকাশ করে আসছিলেন।
কয়েক বছর ধরে তাঁর লেখা পড়ার পর অবশেষে রেহমানের সঙ্গে যখন আমার দেখা হলো, তখন জেনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম যে, তাঁর কাছে লেখালেখি নিছক কোনো একাডেমিক কাজ নয়। তিনি যে বিষয় নিয়ে লেখেন ও বলেন, সেটার প্রতি তাঁর রয়েছে দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যার অত্যন্ত পরিষ্কার দর্শন ও লক্ষ্য রয়েছে, তিনি রাজনৈতিক পদক্ষেপে বিশ্বাস করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বাঙালিদের প্রতি অবিচার ও শোষণ করা হচ্ছে এবং তিনি সত্যিকারভাবেই এর বিরুদ্ধে কিছু করতে চান।
সেই সম্মেলনে আমি রেহমানের মার্জিত আলোচনা ও বিতর্কে অংশ নেয়ার অসীম শক্তি দেখেও মুগ্ধ হয়েছিলাম। রেহমান দিনের পর দিন বিতর্ক চালিয়ে গেছেন, কিন্তু কখনো মেজাজ হারাননি বা অভদ্র ভাষা ব্যবহার করেননি। যুক্তি-তর্ক দিয়ে, শালীন ভাষা ব্যবহার করে তিনি বিতর্কে জিতেছেন। ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে তার দক্ষতা ছিল অতুলনীয়।
রচেস্টারের পর রেহমান নিউইয়র্কে একদিন থাকার পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি আমাকে কিছু বামপন্থী পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ, যেমন ইকবাল আহমদ ও ফিরোজ আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করিয়ে দেয়ার জন্য বলেন। ইকবাল আহমেদ সে সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত ছিলেন। আমি তাদের সঙ্গে একদিন দুপুরে খাবারের আয়োজন করি। সেখানে দেখলাম শুধু পাকিস্তান নয়, বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়েও রয়েছে রেহমানের প্রচুর আগ্রহ ও জ্ঞান।
দুপুরের খাবার শেষ হয়। কিন্তু তখনো রেহমানের হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় ছিল। তিনি আমাকে সে সময়টুকু ভিলেজে নিয়ে যেতে বললেন, যা নিউইয়র্কের লেখক ও শিল্পীদের পাড়া হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে বলার প্রয়োজন নেই যে, আমি এ দুর্দান্ত শিক্ষাবিদের বই পড়া আর লেখার বাইরে অন্য কিছুও দেখার উত্সাহ আছে, তা জেনে আশ্চর্য হয়েছিলাম। বই ও রেকর্ডের দোকানে ঢুঁ মেরে এবং আইসক্রিম খেয়ে রেহমান ওয়েস্ট ভিলেজে ঘোরাঘুরি করাটা দারুণ উপভোগ করেছিলেন।
এর পর গত ৪৭ বছরে রেহমান সোবহানের প্রতি আমার ধারণার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি এখনো একজন আন্তরিক শিক্ষাবিদ, যিনি সবসময় নতুন ধারণা ও জ্ঞানের সন্ধান করেন। শুধু নিজের পেশায় অগ্রগতির জন্য লেখালেখি করার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে রেহমানের একটি স্বপ্ন রয়েছে। তিনি লেখেন ও কথা বলেন সেই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। রেহমান সবসময় স্বপ্ন দেখেন এমন একদিন আসবে, যেদিন আমাদের সমাজ ও দেশ শোষণমুক্ত হবে, হবে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ; যার ভিত্তি হবে সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতি।
রেহমান শুধু একজন স্বপ্নদর্শী নন, তিনি একজন কর্মী-মানুষ। তিনি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে নিষ্ঠাবান ও সদা সচেষ্ট। যে বিষয়টি বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান-নির্মাতাদের থেকে তাকে আলাদা করেছে, তা হলো তিনি সবসময় অনেক মেধাবী লোকদের নিয়ে একটি টিম তৈরির চেষ্টা করেন এবং অনেকের সঙ্গে মিলেমিশে যেকোনো কাজ করতে পছন্দ করেন।
তাঁর গড়ে তোলা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে (পরিকল্পনা কমিশন, বিআইডিএস ও সিপিডি) তিনি বহু মেধাবী লোককে নিয়োগ দিয়েছেন।
রেহমানের আরেকটি বিরল গুণ হলো, তিনি কখনো অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেননি। তিনি বিআইডিএস ও সিপিডিতে একটি মসৃণ উত্তরাধিকার প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি স্বেচ্ছায় এ দুই প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর নিয়েছিলেন এবং যোগ্য উত্তরাধিকারীর হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।
সময়ের পরিক্রমায় আমি বারবার বাংলাদেশে থাকা এবং দেশের সেবা করার প্রতি রেহমানের নিষ্ঠা দেখে এসেছি। অবাক হয়েছি। তিনি একজন দেশপ্রেমিক। তিনি সবসময় বিশ্বাস করেন যে, বাংলাদেশে থেকেও আন্তর্জাতিক মানের কাজ করা যায়। তিনি তা করেছেন। অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও কখনো বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে যাননি। সবসময় বাংলাদেশের মধ্যে জাতীয় সক্ষমতা গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন এবং অন্যদেরও একই অনুপ্রেরণা দিতেন। ১৯৭০ দশকের প্রথম দিকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতাম এবং ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচন ও সাংসদদের নিয়ে গবেষণা করছিলাম, রেহমান আমার গবেষণার ফল জানতে খুব আগ্রহী ছিলেন। যদিও তিনি সে সময় পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। সেই দিনগুলোয়, এমনকি আজো বিদ্বান ব্যক্তিদের মধ্যে এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল, যারা সত্যিই অন্য গবেষকদের লেখা পড়তে ও মন্তব্য করতে আগ্রহী। রেহমান আমাকে শুধু গবেষণা চালিয়ে যেতেই উত্সাহ দেননি। পাশাপাশি আমাকে সবসময় বলে এসেছেন আমি যেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান-বিষয়ক একদল গবেষক গড়ে তুলি। তিনি ১৯৭৪ সালে বিআইডিএসে যোগ দেন। সে সময় তিনি সেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান-সংক্রান্ত গবেষণায় সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য আমাকে বিআইডিএসে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি অবশ্য তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইনি।
এর পর ১৯৮২ সালে আমি যখন জাতিসংঘের একটি কাজ নিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, রেহমান তখন আমাকে দেশে থাকতে আগ্রহী করার জন্য খুব চেষ্টা করেছিলেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, দেশে আমার সেবার বেশি প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়ার পর যখনই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, হোক তা দেশে বা বিদেশে, রেহমান প্রতিবারই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, তরুণ গবেষক গড়ে তোলা এবং আমাদের নিজেদের জাতীয় সক্ষমতা তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশে আমার সময় আরো ভালোভাবে ব্যবহার করা যেত।
১১ বছর ধরে রেহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় শুধু একাডেমিক সহকর্মী হিসেবেই নয়, বরং জীবনসঙ্গী হিসেবেও। মানুষ হিসেবে রেহমান কেমন, সে সম্পর্কে আমার ধারণা এখন আরো স্পষ্ট হয়েছে। অন্যদের প্রতি, এমনকি কারো সঙ্গে মতের মিল না হলেও, তাঁদের প্রতি তাঁর ভদ্রতা একটি অনন্য গুণ। এ গুণটি আমি ১৯৭০ সালে রচেস্টারে লক্ষ করেছিলাম। তিনি কখনই কারো সম্পর্কে ব্যক্তিগত অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করেন না, এমনকি কেউ তার ব্যাপারে এ ধরনের কথা ব্যবহার করলেনও না। আমি প্রায়ই ভাবি এটা তিনি কীভাবে করেন! এ কথা সত্যি যে, তিনি একজন সদয়, উদার ও সহমর্মী ব্যক্তি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তাঁর রয়েছে নিজ ও নিজের কাজের ওপর বিশ্বাস। তিনি একজন আত্মসচেতন, আত্মপ্রত্যয়ী, নিশ্চিত মানুষ। তিনি জানেন তিনি কে এবং জীবন থেকে তিনি কী চান। কোনো কাজে তিনি যদি ব্যর্থ হন, তবে এর দায় উনি অন্যদের ওপর চাপান না, বরং নিজের সীমাবদ্ধতা বের করার চেষ্টা করেন। তাঁর মধ্যে একটি শক্তিশালী নৈতিকতার কম্পাস রয়েছে, যা তাঁর জীবনকে নিজের আদর্শ ও দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালনা করার নির্দেশ দেয়।
রেহমানের জীবনে বহু চড়াই-উতরাই রয়েছে। তাঁকে ব্যক্তিগত দুঃখ ও আপনজন হারানোর বেদনা সহ্য করতে হয়েছে। তবে তিনি একজন প্রাণবন্ত ও বহুমাত্রিক মানুষ। জীবনের প্রতি তাঁর প্রবল উত্সাহ রয়েছে। তিনি জীবনকে ভালোবাসেন। আমি বিশ্বাস করি জীবনের বিভিন্ন দিক, যেমন খেলা ও সিনেমা দেখা, বই পড়া, থিয়েটার ও কনসার্টে যাওয়া, ভালো খাবার ও রাজনীতি নিয়ে ভালো আড্ডা উপভোগ করা; এ সবকিছুই তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে উত্সাহিত করে। যদিও ৮২ বছর পার করেছেন, মনের দিক থেকে এখনো তিনি রয়ে গেছেন তরুণ। তিনি সবসময় সামনের দিনের কথা চিন্তা করেন। একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার যে দর্শন তাঁর রয়েছে, যেটি এখনো তার হূদয়ে অপ্রশমিত, সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তিনি সবসময় খোঁজেন।