Originally posted in বাংলাদেশ প্রতিদিন on 15 January, 2021
কর্মসংস্থানে হাহাকার কাটছে না
কমে গেছে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, কাজ ফিরে পাননি চাকরি হারানোরা লাখো মানুষের পেশা বদল, শক্ত অবস্থানে প্রযুক্তি খাত
করোনা মহামারীর ১০ মাস পার হলেও সুখবর নেই কর্মসংস্থানে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা না হওয়ায় বেসরকারি খাতের অবস্থা এখনো নাজুক। এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে ব্যয় সংকোচনের চেষ্টা করছে। কাজ হারিয়ে অনেকেই পেশা বদলে যে কাজ পাচ্ছেন তা করেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। খরচ কমাতে পরিবার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে মেসে উঠেছেন রাজধানীর অনেক মানুষ। জোড়াতালির সংসারের খরচ মেটাতে নিম্নআয়ের পরিবারের বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন রোজগারের আশায়। বেড়েছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। তবে এই দুঃসময়ের মধ্যেও মহামারীর ধাক্কা সামলে শক্ত অবস্থানে রয়েছে তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিতরা। এই খাতটিতে বেড়েছে ব্যবসা ও কাজের পরিধি।
কেস স্টাডি-১ : লালবাগের বাসিন্দা সোহাগ হোসেন পড়াতেন ধানমন্ডির একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। করোনার কারণে গত সাত মাস ধরে স্কুলে বেতন বন্ধ। মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর এক মাসের মাথায় হারান ২টা টিউশনি। শেষ টিউশনিটা চলে যায় গত নভেম্বরে। এরপর থেকে ‘পাঠাও’ চালিয়ে রাজধানীতে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন। পাঠাওয়ের যাত্রী হওয়ার সুবাদে কথা
হয়েছিল এই স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে। বলেন, বাইকটা না থাকলে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু, বাড়িতে গিয়েই বা কী করতাম?
কেস স্টাডি-২ : ষাটোর্ধ্ব বয়সী হাঁপানি রোগী সুলায়মান পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না। তার পরও গত পাঁচ মাস ধরে রিকশা চালান রাজপথে। কিছুক্ষণ রিকশা চালানোর পরই হাঁপিয়ে ওঠেন। লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা ২টা ইনহেলার মুখে স্প্রে করে ফের রিকশায় প্যাডেল মারেন। জানুয়ারির শুরুতে টিএসসি এলাকায় দেখা হয় এই বৃদ্ধের সঙ্গে। বলেন, গত মে মাসে দুই ছেলে-মেয়ে গার্মেন্টের চাকরি হারিয়ে এখন বেকার। ছেলেটি ঘুরে ঘুরে চা-পান বিক্রি করছে। মেয়েটি ঘরে বসা। ২টা ইনহেলারের দাম ৭৩৫ টাকা। ছেলের ওপর বাড়তি চাপ না দিতেই রিকশা চালানো শুরু করেছেন। সোহাগ হোসেনের মতো অনেক উচ্চশিক্ষিত যুবক বা সুলায়মানের মতো বৃদ্ধের জন্য বেঁচে থাকাটা এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী চাহিদা কমে যাওয়ায় কাজ মিলছে না শিক্ষিত যুবক-যুবতীর।
সরকারি-বেসরকারি নিয়োগও কমে গেছে। দেশের কয়েকটি চাকরির ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, অন্য বছরগুলোর তুলনায় কমে গেছে চাকরির বিজ্ঞপ্তি। যে বিজ্ঞপ্তিগুলো দেওয়া হচ্ছে সেগুলোতে দায়িত্ব বিবেচনায় বেতন কম। অধিকাংশ চাকরির বিজ্ঞাপনে অভিজ্ঞ লোক চাওয়া হচ্ছে, ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের চাহিদা একেবারেই কমে গেছে। করোনার ধাক্কায় গত এপ্রিল-মে-জুন মাসে যারা বেকার হয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই এখনো ফিরে পাননি চাকরি। উল্টো এখনো চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা।
এদিকে এই প্রতিকূলতার মধ্যে বহাল তবিয়তে রয়েছে তথ্য-প্রযুক্তি খাত ও এই খাতের কর্মীবাহিনী। বেড়েছে তথ্য-প্রযুক্তি সেবার চাহিদা। ই-কমার্সের বাজার ২০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেও ছিল ১৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় তথ্য-প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিতরা ইন্টারনেটের সুবিধা নিয়ে গ্রামে বসেও আয় করছেন। এ কারণে করোনা শুরুর পর ৯ মাসে ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। গ্রাহক বেড়েছে ১ কোটির বেশি। গত বছরের শুরুতে দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ছিল সর্বোচ্চ ৯০০ জিবিপিএস। বছর শেষে সেই ব্যান্ডউইথের ব্যবহার দাঁড়ায় ২ হাজার ২০০ জিবিপিএসে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সেইলর ইনফোটেকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী নাজমুল হাসান নাহিদ বলেন, ‘করোনায় অনেকেই বেকার হয়েছেন। তবে আমাদের ব্যবসা চাঙা হয়েছে। ওয়েব সার্ভিস, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো প্রযুক্তি সেবাগুলোর চাহিদা বেড়েছে। সব জায়গায় ইন্টারনেট পৌঁছে যাওয়ায় এই সেবাগুলো যে কোনো জায়গায় বসে দেওয়া যাচ্ছে। তাই ঢাকার উত্তরার পুরনো অফিস ছেড়ে কয়েক মাস আগে কুমিল্লার দেবীদ্বারে গ্রামের বাড়িতে এসে অফিস নিয়েছি। পরিবারের সঙ্গে আছি। ৩২ জন কর্মী বিভিন্ন স্থানে থেকে আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। দেশে বসে বিদেশি ক্লায়েন্টকেও সেবা দিচ্ছি। সেই সঙ্গে ২৫০-এর বেশি তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। প্রশিক্ষণ নিয়ে অধিকাংশই নিজের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে পারছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনায় বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। করোনার আগে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে গড়ে ১২ জন বেকার ছিলেন। করোনায় তা বেড়ে প্রায় ২৫ জন হয়েছে। এর সঙ্গে আছে পুরনো ২৭ লাখ বেকার। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘করোনায় ১৩ ভাগ চাকরিজীবী চাকরি হারিয়েছেন। ২৫ শতাংশ চাকরিজীবীর বেতন কমেছে। আবার চাকরি আছে বেতন নেই এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক।’ এ ছাড়া বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে যোগদান করেন। করোনায় বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন ১২ লক্ষাধিক প্রবাসী, যার মাত্র ২ লাখ ফিরে যেতে পেরেছেন। সব মিলে চাকরির বাজারে বিরাজ করছে অস্থির অবস্থা। তবে এর মধ্যেও আত্মকর্মসংস্থানে ভালো অবস্থানে আছে প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতরা।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এর প্রভাব এখনো যায়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হয়নি। নতুন বিনিয়োগ না আসলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। অবকাঠামো উন্নয়নসহ সামাজিক খাতে সরকার বিনিয়োগ বাড়ালে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আবার সবার কর্মসংস্থান করলেও হবে না। অনেকের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।