করোনায় সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় শিল্পের পাশাপাশি কৃষিখাতকেও গুরুত্ব দিতে হবে: মোস্তাফিজুর রহমান

Published in দৈনিক ইনকিলাব on Friday 22 May 2020

সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে সুফল পাচ্ছেন না কৃষক

করোনাভাইরাসের এই মহাদুর্যোগে কৃষক যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সে জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে এসব উদ্যোগের সুফল কৃষক পাচ্ছেন না। কৃষকের পণ্য পরিবহনের জন্য চালু হলো বিশেষ লাগেজ ট্রেন অথচ কৃষক এর কিছুই জানেনা। অন্যদিকে সরকার কৃষকের কাছ থেকে ১০৪০ টাকা মণ দরে ধান ক্রয় শুরু করলেও কৃষকের তালিকা তৈরিসহ নানা জটিলতার কারণে অনেক স্থানে এখনো তা শুরু হয়নি। ফলে কৃষক বাধ্য হয়ে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে কৃষিই হবে পরবর্তীতে টিকে থাকার মূলমন্ত্র। জাতিসংঘ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড় আকারের দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে এবং এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাতে পারে। তাই পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষিখাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) ফেলো বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার ফলে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় শিল্পের পাশাপাশি কৃষিখাতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। করোনা পরবর্তী সময়ে কৃষি অর্থনীতি হবে টিকে থাকার প্রধান উৎস। ফলে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এ খাতকে সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

কৃষি অর্থনীতি জোরদার করতেই সরকার করোনার সময়ে কৃষক ও কৃষি বাঁচানোর বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে রয়েছে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা। কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে বিশেষ লাগেজ ট্রেনের ব্যবস্থা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে খামারিদের পণ্য বিক্রির জন্য ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র চালু। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে পণ্য বিক্রি। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় এ সব পদক্ষেপের পুরোপুরি সুফল কৃষক পায়নি।

চলতি রোরো মৌসুমে হাওরাঞ্চলসহ সারাদেশে বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষক যাতে ধানের ন্যায্যমূল্য পায় এজন্য সরকার তাদের কাছ থেকে সরাসরি ১০৪০ টাকা মণ দরে ধান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। এবার সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। তবে কৃষকদের তালিকা তৈরিতে বিভিন্ন স্থানে নানা জটিলতার কারণে ধান কেনা শুরু করতে দেরি হচ্ছে। এর ফলে অনেক কৃষক প্রয়োজন মেটাতে বাধ্য হয়ে কম দামে ব্যাপারিদের কাছে ধান বিক্রি করছে। এতে কৃষকদের মাঝে হতাশা নেমে এসছে।

করোনাভাইরাসে উদ্ভ‚ত সঙ্কটের মধ্যে চালু করা কৃষিপণ্যবাহী লাগেজ ট্রেনে ভাড়া কমছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ ভাড়া ছাড় ও সার্ভিস চার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

করোনাকালে কৃষককে সহায়তা এবং কৃষি অর্থনীতিকে জোরদার করতেই সরকার বিশেষ লাগেজ ট্রেন চালু করে। কৃষকের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের সুবিধায় গত ১ মে থেকে ঢাকা-যশোর-খুলনা, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ-দেওয়ানগঞ্জ রুটে লাগে ট্রেন চালু করা হয়েছিল। তবে যাদের জন্য এই বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়েছে সেই কৃষক এ সম্পর্কে কিছুই জানেনা। ফলে এসব ট্রেন অনেকটা খালি আসা যাওয়া করেছে। পরবর্তীতে রেল মন্ত্রণালয় পর্যাপ্ত চাহিদা না থাকায় চালুর পরপরই ঢাকা-যশোর-খুলনা ও ঢাকা-ময়মনসিংহ-দেওয়ানগঞ্জ রুটে এই বিশেষ ট্রেন সুবিধা বন্ধ করে দেয়। এর পরিবর্তে ঢাকা-পঞ্চগড় ও ঢাকা-ভৈরব রুটে ট্রেন চালু হয়েছে। এই বিশেষ ট্রেনে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের উৎপাদিত শাক-সবজি, দেশিয় ফলমূল, দুধ, ডিম ইত্যাদি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ ভাড়াও ছাড় দেয়া হয়েছে। এছাড়া সব ধরনের সার্ভিস চার্জও প্রত্যাহার করেছে রেল মন্ত্রণালয়। আমাদের জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য যে বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়েছে এ ব্যাপারে কৃষকরা কিছুই জানে না। এটা চালুর আগে কৃষকদের মধ্যে প্রচারণার প্রয়োজন ছিল। সত্যি বলতে পরিকল্পিতভাবে এটি চালু না হওয়ায় ভাল উদ্যোগটির সুফল কৃষক পায়নি।

করোনা সঙ্কটে খামারিদের উৎপাদিত দুধ, ডিম ও পোল্ট্রি পণ্য ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রয়ের উদ্যোগ নেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গত ২২ এপ্রিল দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের চাষি, খামারি এবং উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত মাছ, দুধ, ডিম ও পোল্ট্রি সুষম সরবরাহ ও বাজারজাত করার উদ্যোগ গ্রহণে সব জেলা ও উপজেলায় কর্মরত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করে মন্ত্রণালয়। এতে প্রান্তিক খামারিরা অনেকটা আশার আলো দেখতে পায়। এই ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে গত ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে খামারিদের উৎপাদিত ২৬ কোটি ৭২ লাখ ৫৫ হাজার ৪৭৬ টাকার দুধ, ডিম ও অন্যান্য পোল্ট্রি পণ্য বিক্রি হয়। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে এপ্রিলের পর এ উদ্যোগে স্থবিরতা বিরাজ করছে।

এ ছাড়া কৃষিপণ্য বাজারজাত করণে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে সেনাবাহিনীকে উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ১ মিনিটের কাঁচা বাজার এবং দিনাজপুরের বিরামপুর ও হাকিমপুর (হিলি) উপজেলার খামারিদের দুধ বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ। এগুলো ছোট ছোট উদ্যোগ হলেও কৃষকরা এর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই উদ্যোগগুলোর আলোকে সমন্বিত ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কৃষক বাঁচবে এবং চাঙ্গা হবে কৃষি অর্থনীতি।