Originally posted in Dhaka Times on 8 August 2022
ব্যয়ের হিসাব মেলাতে দিশেহারা মানুষ
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে ইতিমধ্যে বাসের ভাড়া বেড়েছে। নানা খাতে একের পর মূল্যবৃদ্ধির দুঃসংবাদ। সামনের দিনে আরও দুর্ভোগের শঙ্কায় সাধারণ মানুষ যখন চিন্তিত, তখন সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ভোজ্যতেল শোধনকারী মিল মালিকরা। এ খবর মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষকে আরো দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।
বেশ কিছুদিন ধরে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মূল্য উর্ধ্বগামী। বাঁধা আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে দিশেহারা মানুষ। জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে মানুষ নতুন করে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির চাপে পড়বে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, পারিবারিক বাজেট কাটছাট করেও টিকে থাকা এখন তাদের পক্ষে কঠিন হবে।
নিম্নআয়ের মানুষের ভাষ্য, এখন তাদের টিকে থাকাই কঠিন- ‘এভাবে একের পর এক দাম বাড়ছে। আয় তো আর বাড়ছে না। সংসার চালাব কীভাবে? স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাঁচব কীভাবে? চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।’
তবে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্টের কথা সরকারের অজানা নয় বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও মানুষের কষ্টের বিষয়টি সরকারের ভাবনায় রয়েছে।’
সয়াবিনের নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রস্তাবিত দামের কতটুকু গ্রহণ করা হবে, তা পরিস্থিতি বিবেচনায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরই চূড়ান্ত হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইতোমধ্যে বাসভাড়া বাড়ানো হয়েছে। অন্যান্য গণপরিবহনের ভাড়াও বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারেও। এই মুহূর্তে সরকার সয়াবিন তেলের দাম বাড়ালে তা অতি কষ্টে জীবন চালানো মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন আরও বিষিয়ে তুলবে। এ অবস্থা থেকে মানুষকে রক্ষায় সরকারকেই পথ বের করতে হবে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা, ক্রয়ক্ষমতাসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে মানুষের ওপর আর চাপ বৃদ্ধি না করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
ভোক্তা অধিকার বিষয়ক বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘করোনা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যতটা হুমকি সৃষ্টি করেছিল, তার চেয়ে বেশি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে লাগাতার পরিবহণ ভাড়াসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই খড়গ।’
ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘কোনো ধরনের গণশুনানি ছাড়াই হুট করে অস্বাভাবিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, আবার এর ২৪ ঘণ্টার মাথায় বাস ভাড়া বৃদ্ধি কার্যকর করা, লঞ্চ ভাড়া বাড়ানোর প্রক্রিয়া এবং সর্বশেষ সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধির যে পাঁয়তারা চলছে তা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য অবশ্যই শুভ নয়। ন্যায়সঙ্গত নয়।’
এমন লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ক্যাব উপদেষ্টা। বলেন, ‘মানুষ ভালো নেই। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির চাপে পিষ্ট মানুষ। ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। দ্রব্যমূল্যে এমনিতেই আকাশচুম্বী। এর মধ্যে একের পর এক মূল্যবৃদ্ধির দুঃসংবাদ মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।’ সাধারণ মানুষের কষ্ট বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের প্রতি পরামর্শ দেন তিনি।
জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি দারিদ্র্য ও মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, ‘এভাবে সব দায় ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেয়া ন্যায়সংগত নয়। এমনিতেই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়ছে না। মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে। সরকার ভর্তুকি কিংবা অন্য কোনোভাবে সাধারণ মানুষের খেয়েপরে বাঁচার মতো উপায় বের করে দিক।’
সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব
আমদানিকারক ও মিল মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত চার দফায় প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে ৬২ টাকা দাম বাড়িয়েছে সরকার। এখন আবার লিটারপ্রতি ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি হিসেবে সংগঠনটির নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম মোল্লা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ভোজ্যতেলের আমদানিমূল্য বেড়েছে। এ কারণে দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।’
সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২০ টাকা বাড়াতে গত ৩ আগস্ট বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) প্রস্তাব দেয় মিল মালিকদের সংগঠন। এতে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৮০ টাকা, এক লিটারের বোতল ২০৫ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৯৬০ টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে।
প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করছে বিটিটিসি।
এর আগে চলতি বছরের ৯ জুন সয়াবিন তেলের লিটারপ্রতি ৭ টাকা, ২৭ মে ৯ টাকা, ৫ মে ৩৮ টাকা এবং ৬ ফেব্রুয়ারি লিটারপ্রতি ৮ টাকা দাম বাড়ায় সরকার। আর ২১ জুলাই সয়াবিন তেলের লিটার প্রতি ১৪ টাকা কমিয়ে ১৮৫ টাকা দাম নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু কমতি দামে বাজারে তেল মিলে না বলে অভিযোগ আছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের টনপ্রতি দর ছিল গড়ে ৮৩৮ ডলার, যা গত মে মাসে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯৬৩ ডলারে ওঠে। এর পর থেকে দাম কমছে। সর্বশেষ জুলাই মাসে টনপ্রতি দর নেমেছে ১ হাজার ৫৩৩ ডলারে।
লঞ্চ ভাড়া ১০০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় লঞ্চের ভাড়া ১০০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে লঞ্চ মালিক সমিতি। ফলে প্রতি কিলোমিটারে নতুন ভাড়া হবে ৪ টাকা ৬০ পয়সা করে, আগে যা ছিল ২ টাকা ৩০ পয়সা। গতকাল সরকারের কাছে এ প্রস্তাব দেয়া হয়। লঞ্চ ভাড়া পুননির্ধারণের জন্য লঞ্চমালিকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের আজ বৈঠকের কথা রয়েছে।
এর আগে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত বছরের ৭ নভেম্বর লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে সব লঞ্চের ভাড়া ৩৫ শতাংশ বাড়িয়েছিল অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সে হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি ৬০ পয়সা করে ভাড়া বেড়েছিল।
বাড়তে পারে ট্রেনের ভাড়া: রেলমন্ত্রী
ট্রেনের ভাড়া বাড়তে পারে জানিয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গতকাল বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। রেলমন্ত্রী বলেন, ‘ট্রেন ও বাসের ভাড়ার মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে, যা ট্রেনের ওপর বড় চাপ তৈরি করবে। সুতরাং, আমাদের ট্রেনের ভাড়া সমন্বয় করতে হতে পারে। কিন্তু আমরা এখনও ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।’
এদিকে শনিবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে পরিবহন মালিকদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মহানগরীতে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়। আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ২০ পয়সা করা হয়। বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা এবং মিনিবাসে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। রবিবার থেকে এ ভাড়া কার্যকর হয়।