Originally posted in জনকন্ঠ on 17 January 2023
নতুন মুদ্রানীতি আর্থিক খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি শক্তিশালী করতে হবে
বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় পর্বের (জানুয়ারি-জুন) সদ্য ঘোষিত মুদ্রানীতির কঠোর বাস্তবায়নই বেসরকারি ও আর্থিক খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে সরকারকে সুশাসন নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং পাশাপাশি সরকারি ব্যয় হ্রাস করতে হবে।
এছাড়াও উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের মধ্যে সরকারকে অপরিহার্য প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়া পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী করতে হবে।
জানা গেছে, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, টাকার দরপতনের মতো পরিস্থিতিতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে রেপো রেট বা নীতি সুদ হার বাড়ানো হয়েছে, সেইসঙ্গে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে, ভোক্তা ঋণের সুদহারের সীমা শিথিল করা হয়েছে। অর্থাৎ ভোক্তা ঋণের সুদহার ৩ বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যক্তিগত ঋণ ও গাড়ি বা বিলাসবহুল পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভোক্তা ঋণ বোঝানো হয়। তবে ভোক্তা ঋণ ছাড়া সব ধরনের ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশেই নির্ধারিত থাকবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ শিল্প ঋণসহ অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। একইসঙ্গে ব্যাংক আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো আমানত নেয়ার ক্ষেত্রে যত ইচ্ছা তত সুদ দিতে পারবে গ্রাহককে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো রেট ৫.৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। আর রিভার্স রেপো হার আগের ৪ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪.২৫ শতাংশ করা হয়েছে। সহজ করে বললে, বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ ঘাটতির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদহারে অর্থ ধার দেয় সেটাই রেপো রেট। আর রিভার্স রেপো রেট হল যে সুদহারে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বছরে একটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছে। তবে এবার সংকট সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ ঋণের অন্যতম শর্ত বছরে অন্তত দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা। মুদ্রানীতির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন অর্থবছরে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩৭.৭ শতাংশ, যেখানে গত বছরের জুনে ধরা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ।
তবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের মতো ১৪.১ শতাংশ ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮.৫ শতাংশ, গত জুনে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে যা ধরা হয়েছিল ১৮.২ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর অর্থাৎ জুন নাগাদ ঋণের প্রবৃদ্ধি যেটা টার্গেট করা হয়েছে, সেটা গত অর্থবছরের ডিসেম্বরের প্রবৃদ্ধির চাইতেও বেশি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
কিন্তু মুদ্রানীতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা সেই লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘মুদ্রানীতিতে বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও উদ্যোগের বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করেছে ঠিকই, কিন্তু এর সাপেক্ষে কৌশলী ও টার্গেটেড উদ্যোগ দরকার ছিল, সেই বিষয়গুলো মুদ্রানীতিতে প্রতিফলিত হয়নি। আইএমএফের সঙ্গে সরকার বিভিন্ন শর্তাদি নিয়ে আলোচনা করছে। সে হিসেবে এই মুদ্রানীতিতে যত উদ্যোগ প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা পর্যাপ্তভাবে ফুটে ওঠেনি।’
গত জুন মাসের মুদ্রানীতিতে রেপো সুদ হার বাড়িয়ে ৫.৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও পরে দুই দফায় বাড়িয়ে এবার তা ৬ শতাংশ করা হলো। সাধারণত মূল্যস্ফীতি সীমিত করতে রেপো রেট বাড়ানো হয়, যেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিতে নিরুৎসাহিত হয়। এতে বাজারে অর্থের জোগান কমে এবং তারল্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে থাকে। সহজভাবে বললে রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেয়া হয়।
আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়া হয়। তবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু রেপো রেট বাড়ানো যথেষ্ট নয়, বলছেন অর্থনীতিবিদরা। নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহারের সীমা ৯ শতাংশে বেঁধে দেয়ায় অর্থনীতিতে বড় কোন চাপ পড়ছে না। এই সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা তুলে দেয়া হলে ব্যাংকগুলো আরও প্রতিযোগিতামূলক দামে তাদের ঋণ সুবিধাগুলো দিতে পারত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদের হারে শিথিলতা না আনায় বড় আকারে ঋণ নেয়া এখনো সহজ হয়ে পড়েছে। ঋণ নিয়ে ঋণগ্রহীতারা আরও অর্জন করছেন বলে তিনি জানান। এতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ সামাল দেয়ার বিষয়টি এই মুদ্রানীতিতে প্রশ্নবিদ্ধ বলে তিনি মনে করেন।
মুদ্রানীতির কঠোর বাস্তবায়নে ঘুরে দাঁড়াবে বেসরকারি-আর্থিক খাত ॥ বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় পর্বের (জানুয়ারি-জুন) সদ্য ঘোষিত মুদ্রানীতির কঠোর বাস্তবায়নই বেসরকারি ও আর্থিক খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার।
তিনি বলেছেন, মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল করা। সোমবার ডিসিসিআইয়ের গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন। নতুন মুদ্রানীতি বিষয়ে ঢাকা চেম্বার সভাপতি বলেন, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন মেয়াদের জন্য সরকারি ঋণের প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা অর্থবছরের জুন-ডিসেম্বর মেয়াদে ছিল ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা বেসরকারি খাতে নতুন ঋণপ্রবাহ ও বিনিয়োগকে সংকুচিত করতে পারে।
সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে সরকারকে সুশাসন নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং পাশাপাশি সরকারি ব্যয় হ্রাস করতে হবে। এছাড়াও উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের মধ্যে সরকারকে অপরিহার্য প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্যারিস্টার সাত্তার বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোক্তা পর্যায়ে ঋণের সুদহারের সীমা শিথিলকরণের প্রস্তাব এবং সঞ্চয়ের ওপর সুদহারের সীমা প্রত্যাহার করার ফলে ব্যাংক খাতে সঞ্চয় ও তারল্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ ক্রমান্বয়ে বাজারভিত্তিক এবং একক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার চালু করার প্রত্যাশায় ব্যারিস্টার সাত্তার স্বস্তি প্রকাশ করেন। বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধে এলসির মাধ্যমে আমদানি ব্যয় মেটানোর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি জোরদার করার সিদ্ধান্তকে তিনি স্বাগত জানান।
এছাড়া যেসব এলসির দাম ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি সেগুলোকে তদন্তপূর্বক পরিশোধ করা গেলে তা অর্থপাচার রোধে সহায়ক হবে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার সাত্তার। তবে বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি প্রস্তাব করেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি মার্জিনের শর্তাবলি শিথিল করতে হবে এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে এলসি মার্জিনের শর্তাবলি শিথিল করলে তা স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিতে সিএমএসএমই সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে।
কৃষি, সিএমএসএমই এবং আমদানি বিকল্প শিল্প খাত যেন সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণপূর্বক বিনিয়োগ করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অগ্রাধিকারভিত্তিতে ৫০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করাকে ডিসিসিআই সভাপতি স্বাগত জানান। এ সিদ্ধান্ত সিএমএসএমইর দ্রুত পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে বলে মনে করেন তিনি।
বৃহৎ ও খেলাপি ঋণ কমানোর স্বার্থে প্রতিনিয়ত নজরদারির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘স্পেশাল মনিটরিং সেল’ গঠন করার সিদ্ধান্তকে ব্যারিস্টার সাত্তার একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে মনে করেন। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমাদানের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার, স্থানীয় ব্যাংকের ফি গ্রহণ না করা এবং উত্তোলনপূর্ব অনুমোদন না রাখার ব্যবস্থাকে তিনি স্বাগত জানান। ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, ঘোষিত নতুন মুদ্রানীতিতে বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু ইতিবাচক দিক-নির্দেশনা রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে একটি সময়োপযোগী বাস্তবায়ন কৌশল মুদ্রাবাজার ও অর্থনীতির মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারে বলে জানান তিনি।