Published in ভোরের কাগজ on Thursday 7 May 2020
স্বাস্থ্যের পরই গুরুত্ব দিতে হবে কৃষি খাতকে
থমকে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি
করোনা মহামারিতে স্থবির বিশ্ব অর্থনীতি। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে দেশীয় অর্থনীতিতেও। রপ্তানি থেকে শুরু করে প্রবাসী আয় সবখানেই শুধু নেতিবাচক খবর। তার ওপর প্রবাসী শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন। দেশে ফেরার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে লাখ লাখ শ্রমিকের। এতে বেশি বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। কারণ গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাঙ্গা করতে বরাবরই প্রবাসী আয়ের প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। এছাড়া দেশের এক তৃতীয়াংশ পরিবার প্রবাসী আয়ের সঙ্গে যুক্ত। এই থমকে যাওয়া অর্থনীতি সচল করতে একমাত্র আশার আলো কৃষি খাত। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরই গুরুত্ব দিতে হবে কৃষি খাতকে। অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রবাসীরা সারাবছর দেশে অর্থ পাঠান। এই অর্থে চাঙ্গা হয় গ্রামীণ অর্থনীতি। সেই সঙ্গে দেশে আসে বৈদেশিক মুদ্রা। এই বৈদেশিক মুদ্রায় মেটানো হয় আমদানি খরচ। বাড়তে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ। কিন্তু করোনার থাবায় থমকে গেছে বিশ্ব। আর প্রবাসী শ্রমিকরা পড়েছেন বিপাকে। যার কারণে তাদের অর্থ পাঠানোর সক্ষমতা কমছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মচারী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে। ইতোমধ্যে এক লাখ বাংলাদেশির স্ট্যাম্প ভিসা বাতিল করেছে সৌদি আরব। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে অশনি সংকেত। কেননা, গ্রামীণ অর্থনীতি সর্বদা সচল রাখা থেকে শুরু করে অবকাঠামো নির্মাণেও অবদান রাখে প্রবাসী আয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, প্রবাসীরা গত এপ্রিলে যে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন তা গত ৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। চলতি বছরের এপ্রিলে প্রবাসীরা ১০৪ কোটি ১০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে তারা পাঠিয়েছিলেন ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। এই হিসেবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এপ্রিলে প্রায় ৪০ কোটি ডলার কম এসেছে। আর গত মার্চ মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ২৪ কোটি ডলার। গত মার্চ মাসে প্রবাসীরা ১২৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এই অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) প্রবাসীরা ১ হাজার ৪৮৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ভোরের কাগজকে বলেন, বৈশি^ক মন্দার একটা প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে। প্রবাসী আয়ের ধারা কমার পাশাপাশি এসব প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হারানোর একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। কারণ প্রবাসী আয়ের সঙ্গে জড়িত দেশে এক তৃতীয়াংশ পরিবার। প্রবাসীরা কর্মসংস্থান হারালে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে এদের ওপর। এ ক্ষেত্রে করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের অন্যতম ভরসা কৃষি। এই মুহূর্তে স্বাস্থ্যের পরে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত কৃষি খাতে। এই সময়ে যেহেতু আমাদের ফলন ভালো হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কৃষক থেকে শুরু করে পাইকারি বেপারি সবাইকে আরো সক্রিয় করে তুলতে হবে। আর করোনার অভিঘাতে যদি অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান কমে যায় এসব শ্রমিক হয়তো কৃষি খাতে ফিরতে পারেন। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতেও খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কারণ যে হারে স্বাস্থ্য খাতে উদ্বেগ বাড়ছে, করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফেরা আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চ থেকেই প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি নেগেটিভ। যদিও গত ডিসেম্বর মাসে আগের বছরের একই সময়ে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অথচ বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে গত দুই মাস ধরে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি নেগেটিভ হয়েছে। করোনার বৈশ্বিক মহামারি রূপ নেয়ার পর অনেক প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন। জানুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ফিরে এসেছেন ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৩০ জন প্রবাসী। বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, করোনা মহামারির কারণে এ বছর বাংলাদেশে রেমিট্যান্স কমবে ২২ শতাংশ।
এসব বিষয়ে কথা হয় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, করোনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি কতটা হচ্ছে বা হবে তা নির্ণয় করা এখন খুবই কঠিন। তবে সরকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও দেশে মন্দা শুরু হয়েছে। রপ্তানি খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। এছাড়া রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরতে হলে বা শ্রমিক ফেরাতে হলে বড় প্রয়োজন আস্থা। যদি শ্রমিকরা করোনা আক্রান্ত হন তাহলে তাদের দিয়ে কি উৎপাদন সম্ভব। এছাড়া করোনায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। প্রবাসীদের আয়ে বরাবরই গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে থাকে। প্রবাসীরা কর্মসংস্থান হারালে এর প্রভাব পড়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এক্ষেত্রে বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা কৃষি। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।