Published in সারা বাংলা on 28 October 2020
এলডিসি পরবর্তী সময়ে থাকবে নতুন চ্যালেঞ্জ, প্রয়োজন নতুন নীতি
ঢাকা: স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যেসব সূচক রয়েছে, প্রত্যাশা অনুযায়ী সেগুলোর অগ্রগতি নিশ্চিত করা গেলে ২০২৭ সাল নাগাদ চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশ এই তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে। আর এই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে তখন নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে।
এ পরিস্থিতি সামনে রেখে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, এ ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকও বলছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বাংলাদেশকে বিভিন্ন খাতে নতুন করে নীতি নির্ধারণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে কূটনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সেই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে এই দুই অতিথি এসব কথা বলেন। বুধবার (২৮ অক্টোবর) বিকেলে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনের এ পর্বের বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি’। সারাবাংলা ডটনেটের বিশেষ প্রতিনিধি এমএকে জিলানী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। এটি সারাবাংলার ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং জিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।
অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে সিপিডি‘র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২০ সালের শেষে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হয় এবং ভারতের জিডিপি যদি ১০ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। আইএমএফ‘র ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২০ সাল শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ১ হাজার ৯৮৮ ডলার, ভারতের ১ হাজার ৮৭৮ ডলার। আবার এটাও বলা হচ্ছে, ২০২১ সালে যদি বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬/৭ শতাংশ এবং ভারতের ৯ শতাংশ হয়, তখন আবার ভারত ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশকে। আবার ২০২৫ সাল শেষে বাংলাদেশ আবার ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো— এ বছর শেষে ভারতের জিডিপিতে ১০ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে না।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েট হলে, অর্থাৎ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশের জন্য নতুন সমস্যা তৈরি হবে বলে জানান ড. মোস্তাফিজ। তিনি বলেন, তখন আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হব। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে ১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। ২০৪১ সালে আমাদের উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হতে হবে। ফলে সামনে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
সিপিডি‘র এই সম্মানীয় ফেলো আরও বলেন, ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি— সবকিছুর ওপরই কোভিডের প্রভাব পড়বে। কোভিডের কারণে আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। অনেক প্রবাসী কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসছেন। আবার নতুন করে বিদেশে যাওয়ার পরিমাণ কমে গেছে। কোভিডে আয়ের বৈষম্যও বাড়ছে। একটি অংশ এর মধ্যেও মুনাফা করছে, আয় করছে। কিন্তু একটা বড় অংশই পিছিয়ে পড়ছে। ফলে মাথাপিছু আয়ের সুফল সবাই পাচ্ছে না। সরকার নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ৫০ লাখ মানুষকে নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছে। রাজস্ব বেশি হলে সরকার আরও বেশি মানুষকে সহায়তা করতে পারত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এই রাজস্ব বাংলাদেশেরই সবচেয়ে কম।
ভূ-রাজনীতির গুরুত্ব তুলে ধরে অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ একটা নতুন ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। তাই আমাদের আঞ্চলিক অর্থনীতির দিকে নজর দিতে হবে। ২০২৭ সালের পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ করতে হলে আমাদের ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। কিন্তু ভিয়েতনাম তখনো বিনা শুল্কে ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করবে। ফলে আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সেজন্য আমাদের সব খাতে সংস্কার আনতে হবে, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে হবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির সমন্বয়ে একটি দেশকে নীতি নির্ধারণ করতে হয়। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের গুরুত্ব বাড়ছে, কখনো কমেনি। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের কম। বর্তমানে তা প্রায় ১৯০০ ডলারের কাছাকাছি চলে এসেছে। আমাদের বর্তমান অর্থনীতির আকার এখন ৩৭০ বিলিয়ন ডলার। জনসংখ্যা হিসাবে এই অর্থনীতির আকার আরও বড় হতে পারত। তারপরেও বলব, আফ্রিকার অনেক দেশ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বৈদেশিক সাহায্যে পেয়েছে। কিন্তু তারা অর্থনীতিতে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে আমাদের নতুন ধরনের পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের ডিপ্লোম্যাসিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ষাট-সত্তরের দশকে ভারতের যে কূটনীতি ছিল, এখনকার মোদি সরকার কিন্তু সেই নীতিতে চলছে না। তারা তাদের কূটনীতিতে পরিবর্তন এনেছে। আমাদেরও আনতে হবে।
সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিবও সরকারের বিভিন্ন ধরনের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে কূটনীতি নির্ধারণ করতে হবে। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার সময় যে ধরনের অর্থনীতি বা স্বাস্থ্যনীতি ছিল, এখন কিন্তু সেগুলো আর নেই। ফলে নতুন ধরনের নীতি লাগবে, নতুন কূটনীতিও লাগবে। আবার সব ধরনের কূটনীতির মধ্যে একটা চেইন থাকতে হবে। আগেকার সময়ে কূটনীতি ছিল রাজার জন্য, বড়জোড় রাষ্ট্রের জন্য। কিন্তু এখন জনগণের জন্য কূটনীতি করতে হবে।