কর্মজীবী নারীদের নিজেদের ওপর আস্থা বাড়াতে হবে – ড. ফাহমিদা খাতুন

Published in প্রথম আলো on Wednesday, 8 March 2017

 

fahmida khatun

 

বাবা-মা চাইতেন, মেয়ে ডাক্তার হবে। অতএব পড়াশোনা চলল সেই ধাঁচে। উচ্চমাধ্যমিকের পর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হলো, সুযোগও মিলে গেল। তবে ঘটনা ভিন্ন। মেয়েটি চিকিৎসাশাস্ত্র বাদ দিয়ে টুপ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেল অর্থনীতি পড়তে। তাঁর ইচ্ছা বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার। ছোটবেলা থেকে সে স্বপ্নটা বুনেছে।

এই মেয়ে আজকের ফাহমিদা খাতুন। তবে তিনি শিক্ষক নন, হয়েছেন গবেষক। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) ১৯৮৯ সালে নিজের গবেষণা ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৪ বছর ধরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগে (সিপিডি) গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। গত ১ মার্চ সিপিডির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। সামস্টিক অর্থনীতি, বিভিন্ন খাতের গতিপ্রকৃতি, আর্থিক নীতি, মূল্যস্ফীতিসহ দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গবেষণা করে প্রতিষ্ঠানটি।

বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলা থেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বড় হয়েছেন ফাহমিদা খাতুন। এখানেই অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করেন। বিআইডিএসে কাজ করার সময় উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি নিয়ে ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন। ইউনির্ভাসিটি কলেজ লন্ডনে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন। ১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে আগের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। পরে আবার ছুটি নিয়ে ইউএনডিপি ও ইউএসএআইডিতে কিছুদিন কাজ করেন। তবে ঘুরেফিরে তিনি পাকাপাকিভাবে গবেষণাতেই ফিরে আসেন।

অল্প কথায় কিন্তু ফাহমিদা খাতুনের কর্মজীবনের সবটা বলা হলো না। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেন তিনি। সেখানে অর্থনীতিবিদ ও জাতিসংঘের নীতি-পরামর্শক অধ্যাপক জেফরি স্যাক্সের সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন ও আইসিটি নিয়ে কাজ করেন। তিনি রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক ও এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালক ছিলেন। তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা খাতবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশবান্ধব পণ্য চিহ্নিতকরণ-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বৈদেশিক সাহায্যের কার্যকারিতা-বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। সরকারের প্রতিনিধিদলের হয়ে জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক বিভিন্ন সভায় যোগ দিয়েছেন তিনি।

আচ্ছা, ফাহমিদা খাতুন, শিক্ষক না হয়ে গবেষক হওয়ার গল্পটা কী? শুনুন তাঁর মুখেই, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি কাজ করে। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সেটি হয়। সে জন্য প্রথম হওয়ার পরও আমাকে নেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। তখন অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমানের পরামর্শে গবেষণায় চলে আসি।’

আগ্রহ হারানোর বিষয়টি আরেকবার প্রকটভাবে এসেছিল ফাহমিদা খাতুনের জীবনে। সন্তান জন্মের পর। বললেন, ‘বাচ্চা হওয়ার পর কিছুটা পিছুটান তৈরি হয়। তখন দুই বছর কোনোরকমে চাকরি করেছি। বারবার মনে হতো, চাকরি-টাকরি বৃথা। মূল হচ্ছে সন্তান। বাচ্চাকে ছেড়ে কাজ করতে আসাটা কষ্টকর।’

নিজের সঙ্গে একটা লম্বা সময় বোঝাপড়া করে আবার চাকরিতে মনোযোগী হন ফাহমিদা খাতুন। এই জায়গায় তিনি মনে করেন, সন্তানকে দিনের পুরোটা সময় দিলেই সব হয়ে যাবে তা নয়; বরং তাকে গুণগত সময় দেওয়ার বিষয়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া সন্তানের মধ্যে কী মূল্যবোধ দিচ্ছেন কিংবা জীবনের কী লক্ষ্য ঠিক করে দিচ্ছেন, সেটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবারের সহযোগিতা গবেষক ফাহমিদার কর্মজীবনের কঠিন পথকে সহজ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাবা-মা আমাকে সময় কাটানোর জন্য পড়াশোনা করাননি। আমার ভাইয়েরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে, আমিও সেটি করেছি। বিয়ের পরপরই আমি বিদেশে পিএইচডি করতে চলে যাই। তখনো আন্তরিক সহায়তা পেয়েছি।’

দেশের অর্থনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণার পাশাপাশি নারীদের নিয়ে কাজ করেছেন গবেষক ফাহমিদা। নারীর প্রতি সহিংসতার অর্থনৈতিক মূল্য এবং অর্থনীতিতে নারীর অবদান শীর্ষক দুটি গবেষণার কাজ করেছেন তিনি। তাঁর পর্যবেক্ষণ, গত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে অসংখ্য নারী আসছেন। আগে শুধু শিক্ষকতা ও চিকিৎসার মতো পেশায় এলেও এখন নারীরা করপোরেট ও ব্যক্তি খাত এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। মেয়েরা ঘর সামলে বাইরে কাজ করতে আসছেন। তাই বলা যায়, তাঁদের দক্ষতা বেড়েছে।

অবশ্য এখনকার কর্মজীবী নারীদের চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি বলে মনে করেন এই গবেষক। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, আগে যৌথ পরিবার ছিল। আর বর্তমানে অধিকাংশই একক পরিবার। সে জন্য নারীদের বাড়তি চ্যালেঞ্জ যোগ হয়েছে। সংসার দেখভাল ও সন্তান লালন-পালন করে চাকরি করা বেশ কষ্টের। সে জন্য একটা পর্যায়ের পর নারীরা কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ছেন। বিশেষ করে যখন নারীরা সন্তান জন্ম দেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তাহলে কর্মজীবী নারীদের উপকার হয়।

অন্য অনেক পেশায় নারীরা গেলেও গবেষণায় কম আসছেন। তবে অন্যান্য পেশার চেয়ে গবেষণাকর্মটি আলোকিত। জ্ঞানচর্চার জায়গা। আর জ্ঞান তো ভালোর জন্যই। এমন মন্তব্য করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, গবেষণা পেশায় যাঁরা আছেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ উদার। নয়টা-পাঁচটা দায়িত্ব পালন করতে হয় না, কিছুটা নমনীয়তা আছে। এ জন্য কাজ করতে গিয়ে পরিবার কিংবা প্রাতিষ্ঠানে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।

নারীদের প্রতি ফাহমিদার পরামর্শ, কাজকে ভালোবাসতে হবে। তবেই পেশাগত উৎকর্ষ অর্জন করা যাবে। তা ছাড়া কর্মজীবী নারীদের নিজেদের ওপর আস্থা (কনফিডেন্স) বাড়াতে হবে। যোগ্যতা সত্ত্বেও কেবল নিজের ওপর আস্থার অভাবে অনেক নারীই কর্মক্ষেত্রে সুদৃঢ় অবস্থান করতে পারেন না।

মোহাম্মদপুরে সিপিডির কার্যালয়ে ১ মার্চ প্রথম আলোর সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কথা বলেন ফাহমিদা খাতুন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই গবেষক মানুষটিকে যখন প্রশ্ন করলাম, এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর জীবনের অতৃপ্তি কী? একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘যা পেয়েছি, ভালো পেয়েছি। তবে অনেক সময় মনে হয়, কোনো বিষয়ে গবেষণার পর যেটি বলছি, সেটি যদি মাঠে গিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারতাম, তাহলে আত্মতৃপ্তি পেতাম।’