পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে প্রবৃদ্ধির সুফল পৌঁছেনি: তৌফিকুল ইসলাম খান

Published in আমাদের সময় on Saturday, 21 January 2018

গরিবের আয় কমেছে বেড়েছে ধনীর আয়

রুমানা রাখি

বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার ও সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। সাংবিধানিক এই অধিকার রক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকারবদ্ধ। তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যেও এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু গত ১১ বছরে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। সম্পদের সুষম বণ্টন হয়নি, সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত হয়নি, প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি দারিদ্র্য বিমোচন। বরং রাষ্ট্র এমন অর্থনৈতিক ও সামাজিকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে যার ফলে মানুষের মধ্যে আয়বৈষম্য আরও বেড়েছে। গরিবের আয় কমে গেছে, বেড়েছে ধনীদের আয়। ফলে ধনী আরও ধনী হয়েছে এবং গরিব আরও গরিব হয়েছে। এতে দেশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ধনীদের হাতে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন সব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি বিবিএস ও বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আরও ভয়ঙ্কর তথ্য তুলে এনেছে। তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দরিদ্রদের আয় গ্রামে কমেছে সবচেয়ে বেশি। আর ধনীদের আয় শহরে বেড়েছে বেশি। এ তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, তা হলে দারিদ্র্য বিমোচন কোথায় হলো। গ্রামের দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে, শহরের ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। এর মানে গ্রাম থেকে সম্পদ শহরে চলে আসছে। পরে এর কিছু অংশ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি সিপিডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অতি দরিদ্রের একেবারে নিচের সারিতে অবস্থান করে এমন ৫ শতাংশের খানাপ্রতি মাসিক আয় (হাউজহোল্ড ইনকাম) ২০০৫ সালে ছিল ১ হাজার ১০৯ টাকা, যা কমে ২০১৬ সালে ৭৩৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যদিও ২০১০-এ নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বেড়ে ১ হাজার ৭৯১ টাকা হয়েছিল। অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০১৬ এই সময়ে তাদের আয় কমেছে। ২০০৫ সালে গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় ছিল ১ হাজার ৭৩ টাকা। আর শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় ছিল তখন ১ হাজার ৪০২ টাকা। গত ১১ বছরে ওই শ্রেণির জাতীয় আয় কমেছে ৫৯.১ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে ৬০.৭ শতাংশ এবং শহরে ৫১.৩ শতাংশ কমেছে।

অন্যদিকে ধনীদের শীর্ষে অবস্থানকারী পাঁচ শতাংশের খানাপ্রতি আয় ২০০৫ সালে ছিল ৩৮ হাজার ৭৯৫ টাকা। ২০১০ সালে এই আয় ছিল ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা। ২০১৬ সালে বেড়ে হয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকা। ওই সময়ে তাদের আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আলোচ্য সময়ে তাদের জাতীয় আয় বেড়েছে ৫৭.৪ শতাংশ। এর মধ্যে শহরে ৮৮.১ শতাংশ এবং গ্রামে বেড়েছে ৪৬.৪ শতাংশ। মধ্যম ধনী ও দরিদ্রদের আয় বেড়েছে তুলনামূলক কম হারে।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সম্পদের এই বৈষম্যের কারণে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। সমাজকে সুষমভাবে এগিয়ে নিতে পারলে উন্নয়নের সুফল যেমন মানুষ পাবে না, তেমনি ধনী শুধু আরও ধনী হতে থাকলে সম্পদের সুষম বণ্টন হবে না। এ জন্য সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অবৈধ অর্থ আয় বন্ধ করতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

ধনী-গরিবের আয়বৈষম্য নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি খাতের বেতন বৃদ্ধি পায়নি। দ্রব্যমূল্যে সারা বছরই ঊর্ধ্বগতি থাকে। তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও দফায় দফায় বেড়েছে। তাই সার্বিক দারিদ্র্য কিছুটা কমলেও দৃশ্যমান ও টেকসই অগ্রগতি হয়নি। যারা দারিদ্র্য থেকে কিছুটা ওপরে উঠেছেন তারা যে কোনো সময় আবার নিচে নেমে যেতে পারেন।

তিনি বলেন, তবে বর্তমানে সব থেকে বেশি চাপে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বছর বছর তাদের বাসাভাড়া বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে পণ্যের দাম। কিন্তু সেভাবে তাদের মজুরি বাড়ছে না, যা উদ্বেগের বিষয়। এ কারণে অতি দরিদ্ররা পিছিয়ে পড়ছে।

সিপিডির গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে প্রবৃদ্ধির সুফল পৌঁছেনি। গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। আর এ বৈষম্য শহর ও গ্রামে দেখা দিচ্ছে বেশি করে। শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, যা আয়ের ওপর প্রভাব ফেলছে। আবার গ্রামের জীবনযাত্রার মান কমছে।