ব্যতিক্রমী এক শিক্ষক – মোস্তাফিজুর রহমান

Published in বণিক বার্তা on Thursday, 16 March 2017

তাঁর মেধা ও মনন অসাধারণ, লিখনীর ব্যাপ্তি ব্যাপক, পথচলা বহুধাবিস্তৃত। তাই তাঁর পরিচয়ও বহুমাত্রিক। তিনি একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও লেখক, ব্যতিক্রমী চিন্তাবিদ, প্রতিভাবান প্রতিষ্ঠান নির্মাতা, সংবেদনশীল মানুষ, একজন মুক্তিসংগ্রামী। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তাঁর অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে যে পরিচয় তাঁর লেখা ও গবেষণা, জীবন ও জীবনাচার, ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তিত্বকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরে, যে পরিচয় তাঁর অন্য সব পরিচয়েরই নির্যাস ও প্রতিফলন, যে পরিচয় সব পরিচয় ছাপিয়ে প্রতিভাত হয়ে ওঠে তা হলো, অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রথমত ও প্রধানত একজন শিক্ষক, এবং প্রকৃত অর্থেই একজন ব্যতিক্রমী ও অনন্যসাধারণ শিক্ষক। কোথায় যেন পড়েছিলাম, An ordinary teacher talks, a good teacher teaches, a very good teacher demonstrates, a great teacher inspires. তিনি তেমনই একজন শিক্ষক, যিনি অনুপ্রাণিত করেন, ভাবতে শেখান, উন্নততর জীবনদর্শনে আগ্রহী করেন, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন, প্রান্তজনের সপক্ষে কাজ করতে উত্সাহী করেন, ভাবনা ও ভাবাদর্শকে বদলে দিতে পারেন। দীর্ঘ ছয় দশকের কর্মময় জীবনে তিনি প্রভাবিত করে চলেছেন কয়েক প্রজন্মের মানুষকে, যারা তাঁর লিখনীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, তাঁর বক্তব্য শুনেছেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন। আর এর মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন সেই শিক্ষক, যিনি অনুপ্রেরণার উত্স হওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহানের লিখনী-যুক্তিতর্ক-আলোচনা, দেশের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁর সাহসী বক্তব্য ও অবস্থান অনেক সময়ই ছিল প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে। আর এসব তিনি করে গেছেন তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে, যে দায়বদ্ধতা দেশের প্রতি এবং দেশের মানুষের প্রতি নিবেদিত, প্রগতি আর উন্নতির আকাঙ্ক্ষার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারি, একুশ বছর বয়সে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে তিনি এভাবেই জীবনকে উত্সর্গ করার ব্রত নিয়েছিলেন; নিয়েছিলেন অনেক ভেবেচিন্তে; জীবনের পথচলা নিয়ে একান্ত নিজস্ব জীবনদর্শনে যে সিদ্ধান্ত ছিল প্রোথিত। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন একটি গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর দেখা রেহমান সোবহানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন: ১৯৫৩ সালের এক শীত-জর্জরিত সন্ধ্যায় কেমব্রিজে তার সঙ্গে আমার দেখা। তার ক্ষুরধার বুদ্ধি সেদিন আমাকে আকর্ষণ করেছিল, কিন্তু আমি তখন জানতাম না যে, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সুবিচার আর ন্যায্যতা নিয়ে তার যে ঐকান্তিক আগ্রহ সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিলাম, সেটাই পরবর্তীকালে সারা জীবন তার জ্ঞানচর্চা, কর্মকাণ্ড ও সাধনার একান্ত কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে। জীবনের অভিযাত্রায় এ সুনির্দিষ্ট পথরেখাকে বাছাই করার সিদ্ধান্তটি ছিল তার একান্তই নিজস্ব এবং একান্তই ব্যক্তিগত, যার প্রতি রেহমান সোবহান সারা জীবন বিশ্বস্ত থেকেছেন। অমর্ত্য সেন যে জীবনদর্শনের প্রতি বিশ্বস্ততার কথা লিখেছেন, তা থেকে যা শিক্ষণীয় আর অনুকরণীয়, তার ছাপ অধ্যাপক রেহমান সোবহান রেখে চলেছেন অনেকেরই মধ্যে, তাদের কর্মে ও উদ্যোগে, চিন্তায়-চেতনায়, মননে ও মানসে। শুধু জ্ঞানতাপস হলেই চলবে না, আরাধ্য জ্ঞানকে মানুষের কল্যাণ ও উন্নতির কাজে নিয়োজিত করার মধ্যেই যে তার সার্থকতা, সে শিক্ষাই তিনি দিয়ে চলেছেন। তিনি সে বৈশিষ্ট্যময় শিক্ষারই শিক্ষক।

ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, আমার সুযোগ হয়েছে তাঁর মতো একজন মানুষের সান্নিধ্যে আসার, ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার, ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে জানার, বোঝার, তাঁর কাছ থেকে শেখার। তাঁর ‘শিক্ষক’ পরিচয়ই আমার কাছে সবচেয়ে বড় মনে হয়েছে প্রচলিত অর্থে তাঁর শিক্ষকসুলভ আচরণের কারণে নয়। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, তর্ক-বিতর্ক করেছেন, কিন্তু কখনো বলেননি এটাই শেষ কথা, এটাই বলতে হবে, এভাবেই লিখতে হবে, এভাবেই করতে হবে। তাঁর প্রভাব নিরন্তর, কিন্তু অগোচর; তাঁর দর্শন ও জীবনাচার, কর্মোদ্যম ও উদ্যোগ, অজান্তেই অনুপ্রাণিত করে তাঁর কাছ থেকে জানার ও শেখার। সে কারণেই তিনি সে ধরনের এবং সে মাপের একজন শিক্ষক।

মনে পড়ে, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সেমিনারে প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯০ সালের কোনো একদিন। তখন তিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক। স্বৈরশাসনের সময়কার অর্থনীতির মূল্যায়ন নিয়ে কাজ শুরু করেছেন ‘ডিকেড অব স্ট্যাগনেশন’ (স্থবিরতার দশক) বই নিয়ে। যাদের সে কাজে সম্পৃক্ত করেছিলেন, তাদের মধ্যে  বিআইডিএস থেকে ছিলেন বন্ধু ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. বিনায়ক সেন, ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, ড. আতিউর রহমান। এছাড়া ছিলেন ড. সৈয়দ হাশেমী, ড. হামিদা হোসেন ও অন্যরা। এর আগে তাঁর লেখার সঙ্গে কিছু পরিচয় ছিল, আমাদের মুক্তিসংগ্রামে তাঁর ভূমিকা সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম। পাকিস্তান আমলের ‘দুই অর্থনীতি’ তত্ত্বের অন্যতম রূপকার হিসেবে তিনি আমাদের কাছে ছিলেন সর্বাধিক পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলে তাঁর ও প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য তাঁর অন্য সহকর্মীদের লেখায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ উন্নয়ন ভাবনার প্রতিফলন পড়েছি। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে বাংলাদেশের সরকারি খাতের চরিত্র নিয়ে তাঁর ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রয়াত অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের লেখা বইটি ছিল উন্নয়ন অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। এবার মানুষটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর লেখা ও কাজকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ পেলাম। ডিকেড অব্ স্ট্যাগনেশন বইটি তিনি উত্সর্গ করেছিলেন আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে। সে গ্রন্থে তাঁর নিজের লিখিত প্রবন্ধে ছিল তাঁর উন্নয়নদর্শনের প্রতিফলন– এমন একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর কথা, যা হবে প্রতিনিধিত্বশীল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার কাছে দায়বদ্ধ; এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা, যা দাঁড়াবে মূলত নিজস্ব সম্পদ ও জনশক্তির ওপর নির্ভর করে, বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর অন্যায্য শর্তকে বর্জন করে, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শ্রমজীবী মানুষের অংশীদারিত্বকে নিশ্চিত করে। সে গ্রন্থের কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাঁর কাছে আমার শেখার শুরু। সেই থেকে না পড়িয়েও তিনি আমার শিক্ষক, তাঁর ক্লাসরুমে বসার সুযোগ না পেয়েও আমি তাঁর চিরন্তন ছাত্র।

অধ্যাপক রেহমান সোবহানের লেখার একটা বড় অংশজুড়ে আছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সেসবের সম্পর্ককে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিচার-বিশ্লেষণ। তিনি বলতে চেয়েছেন, যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ আমাদের কাম্য, তা অর্জন করতে গেলে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, জবাবদিহিতার সংস্কৃতিকে শক্তভাবে প্রোথিত করতে হবে। তাঁর Challenging the Injustice of Poverty : Agendas for Inclusive Development in South Asia গ্রন্থে তিনি লিখেছেন এমন এক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার পক্ষে, যা সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বল, কিন্তু সবচেয়ে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করবে, অর্থনীতি পরিচালনায় সম্পৃক্ত করবে, মালিকানায় অংশীদারিত্ব দেবে। প্রান্তজনের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতিকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে না দেখে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য ও অন্তর্নিহিত অংশ হিসেবে বিবেচনার শিক্ষা আমরা তাঁর কাছ থেকেই পাই। স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের উপদেষ্টা সভার সদস্য হিসেবে তিনি গঠন করেছিলেন ২৯টি টাস্কফোর্স। সে উদ্যোগে অনেক প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞ ও স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। সে তিন মাসে তাঁর যে উদ্যম ও উদ্যোগ দেখেছি, সেটিও ছিল আমার জন্য শিক্ষণীয়। টাস্কফোর্স রিপোর্টের তিনটি খণ্ডে নব্বই-পরবর্তী বাংলাদেশের অভীষ্ট গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার একটি দর্শন ও রূপরেখা ছিল। আমাদের দেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠায় সে রিপোর্টগুলোয় দেয়া পরামর্শের গুরুত্ব আজো রয়ে গেছে। তাঁর রচনা সংকলন ‘আমার সমালোচক আমার বন্ধু’র বিভিন্ন লেখা থেকে আমরা জানতে পারি তাঁর চিন্তার ক্রমবিবর্তন, বিদ্যমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থার তলদর্শী ও ক্ষুরধার বিশ্লেষণ, আর বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ও অপরিমেয় বিশ্বাসের কথা।

নব্বইয়ের শুরুতে যখন বাংলাদেশে যুগব্যাপী স্বৈরাচারী শাসন অবসানের মধ্য দিয়ে পুনরায় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়, তখন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক আলোচনায় সুশীল সমাজের অংশীজনদের বক্তব্য ও প্রান্তজনের কণ্ঠকে সুযোগ দেয়ার একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে তিনি ১৯৯৩ সালে সিপিডি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার জন্য ছিল আমার শিক্ষানবিশি জীবনকে সমৃদ্ধতর করার এক দুর্লভ সুযোগ। ক্রমান্বয়ে সিপিডিকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি যেভাবে নিরলস কাজ করে গেছেন, অন্যদের সম্পৃক্ত করে ও সঙ্গে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে তুলেছেন, বেসরকারি পর্যায়ে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জকে ধৈর্য, প্রজ্ঞা আর সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন, সেটিও ছিল আমার ও আমাদের অব্যাহত শিক্ষাজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়।

১২ মার্চ ছিল অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ৮২তম জন্মদিন। ব্যতিক্রমী একজন শিক্ষকের অনন্যভূমিকায় তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করে যাবেন আরো দীর্ঘদিন— জন্মদিনে এ আন্তরিক শুভকামনা রইল স্যারের জন্য।

 

লেখক: সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি