ভ্যাট আইন চালু হলে আয়কর আদায়ও বাড়ত – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in সমকাল on Sunday, 2 July 2017

Khondaker-Golam-Moazzem

গতকাল ১ জুলাই থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর শুরু হয়েছে। এ বছরের বাজেট সংসদে পাস হয়েছে ২৯ জুন, যা পেশ করা হয় ১ জুন। আগের বছরে দেশে অর্থনীতির সূচকগুলো মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ছিল ওঠানামা। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির মন্দাভাবের কারণে রফতানি বাজারে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি। প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ কম হয়। এর পরও আগের বছরগুলোর মতোই উচ্চ হারে জিডিপি বজায় রাখা সম্ভব হয়। এটাও লক্ষণীয়, সামষ্টিক অর্থনীতিও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়নি। তবে ব্যাংকিং খাতে সমস্যা ছিল। সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতির প্রবণতা চলছেই। কু-ঋণ বেড়ে যায়। বেসরকারি ব্যাংকে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের স্বার্থে আইন সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। কৃষি খাতে ধানের টানা বাম্পার ফলনের কারণে খাদ্যশস্যের বাজারে যে স্বস্তিদায়ক চিত্র ছিল, সেটা হঠাৎ পাল্টে যায় হাওরে অকাল বন্যায় ফসলহানির কারণে। চালের বাজারে আকস্মিক ঊর্ধ্বগতি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির শঙ্কা সৃষ্টি করেছে।

এমন প্রেক্ষাপটেই অর্থমন্ত্রী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট সংসদে পেশ করেছিলেন। ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার এ বাজেট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি থেকে বাজেটের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এ ধরনের বড় আকারের বাজেটের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তবে যেভাবে আয়-ব্যয় কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে অসঙ্গতি রয়েছে। এবারের বাজেটের একটি ইতিবাচক দিক ছিল আর্থিক খাতে সংস্কারের বলিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণ। ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট আইন চালুর উদ্যোগের ঘোষণা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। আধুনিক এ কর কাঠামো চালু হলে আয়কর খাতে আদায় বাড়ার কথা। নতুন অর্থবছরে ভ্যাট খাত থেকে আয় বেড়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল ৯১ হাজার কোটি টাকায়। ভ্যাট ও আয়কর মিলিয়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে- এমন প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছিল। সিপিডি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কর ব্যবস্থাকে স্বাগত জানালেও এ পরিমাণ বাড়তি কর আদায় সম্ভব কি-না, সে প্রশ্ন তুলেছিল। বাজেটের ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী বৈদেশিক সূত্র থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার কথা বলেছিলেন, স্বাভাবিক সময়ে যা থাকে ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে। এ লক্ষ্য পূরণ সহজ নয়। আমি মনে করি, এমনকি নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলেও বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ সহজ হতো না।

রাজস্ব খাতের আয় এবং বৈদেশিক ঋণ-অনুদান থেকেই উন্নয়ন বাজেটের অর্থ জোগান হয়। এবারে উন্নয়ন বাজেটের আকার ১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের কাছাকাছি। সরকার অবকাঠামো খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে চলেছে এবং তার যৌক্তিকতা রয়েছে। তবে বাংলাদেশে বড় আকারের উন্নয়ন ব্যয় সময়মতো শেষ হয় না; এমন নজির অনেক। এ কারণে প্রকল্প শেষ করতে বাড়তি ব্যয় হয়, যা সামাজিক উন্নয়ন খাতে অর্থ জোগানে বিঘ্ন ঘটায়। অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন ব্যয় যৌক্তিক। কিন্তু অবকাঠামো তৈরি হলো, বিনিয়োগ বাড়ল; অথচ শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঙ্ক্ষিত দক্ষ শ্রমশক্তি মিলল না- এটা কাম্য নয়।

অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আরও একটি বিষয় সামনে এসেছে- বছর বছর উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি ঘটছে, কিন্তু কর্মসংস্থানে সমস্যা প্রকট হচ্ছে। চলতি বছরের বাজেটেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ধরা হয়েছে ৭.৪ শতাংশ। কিন্তু চ্যালেঞ্জ_ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিশেষ করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ায় সরকারি খাতে কিছু বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কেন পেঁৗছায় না, এ নিয়ে আলোচনা জরুরি।

সরকার বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে আর্থিক খাতের মাধ্যমে প্রণোদনা দিচ্ছে। যেমন সংরক্ষণ সুবিধা মিলছে তথ্যপ্রযুক্তি, সোলার প্যানেল, মোটরসাইকেল সংযোজন, চামড়া ও প্লাস্টিক দ্রব্য উৎপাদনে। এ ধরনের সংরক্ষণ সুবিধা চালু থাকার পরও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছে না কেন? আমি মনে করি, সংরক্ষণ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকা উচিত এবং এর নিয়মিত পর্যালোচনা হতে হবে। এ সুবিধা নতুন নতুন পণ্যের জন্য ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিও নজর রাখতে হবে।

গত ৫-৬ বছরে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবে শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ পেঁৗছানোর সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। গ্যাসের চাহিদা পূরণে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের অগ্রগতি শ্লথ। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের ভালো পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও তেমন অগ্রগতি নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিং সড়ক চার লেন হয়েছে। কিন্তু অনেক জেলায় সড়কপথ এখনও দুর্বল। নৌ-রেলপথেও বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের দাবি রয়েছে। এসব না হলে বাজেটে আর্থিক প্রণোদনা থেকে প্রত্যাশিত ফল মিলবে না।

নতুন বছরের বাজেটে বেসরকারি খাতে বাড়তি ৬৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে বলে ধারণা ব্যক্ত হয়েছিল। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে শ্লথ গতির কারণে আমাদের রফতানি বাজারে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থও কম হতে পারে। এর সঙ্গে যদি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সমস্যা যুক্ত করি, তাহলে নিট ফল দাঁড়ায় অর্থনীতিতে ভোগের চাহিদা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়া, যা অভ্যন্তরীণ বাজারকে সংকুচিত করে রাখে। এর পরিণতিতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে।

১ জুলাই থেকে নতুন বাজেট চালু হয়েছে। কিন্তু ভ্যাট আইন দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। কেন এ পিছু হটা? সরকারের কি ভ্যাট আইন চালুর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল? এ আইন কার্যকর হলে উদ্যোক্তা ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা আলোচনায় ছিল। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তেমন ভাবা হয়নি। চালের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। নতুন ভ্যাট আইন চালু এবং রমজান মাসের কারণেও বাজারে প্রভাব পড়েছে। ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ; এটাকে অনেকে উচ্চ মনে করেছেন। অর্থমন্ত্রী করমুক্ত অর্থে কিছুটা ছাড় দিয়ে ভোক্তাদের সুবিধা বাড়াতে পারতেন। নূ্যনতম করের হার ১০ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেও সাধারণ ভোক্তাদের সুবিধা দেওয়া যেত। ভ্যাটের হার ১৫ থেকে ১২ শতাংশ নামিয়ে আনার প্রস্তাবও বিবেচনা করা যেত। কিন্তু এখন কিছু বিষয় হয়ে পড়ল এলোমেলো।

ভ্যাট আইন চালু হলে আয়কর আদায়েও তার প্রভাব পড়ত। কিন্তু ভ্যাট বলবৎ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি দেখা গেল না। ভারতে পণ্য ও সেবা কর বা জিএসটি বলবৎ হয়েছে এ বছরের ১ জুলাই থেকে। এ জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের চেষ্টা চলেছে। ব্যবসায়ীসহ সমাজের সব অংশের সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারপরও বন্ধ ডাকা হয়েছে কোথাও কোথাও। আমরা নতুন আইন চালু করতে চেয়েছি, কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইসিআর মেশিনের জোগান নেই। অনলাইন নিবন্ধন কতটা হয়েছে, স্পষ্ট নয়। মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় যেসব দুর্বলতা, তা কাটানো যায়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলছে, শুরু তো হোক- ঘাটতি ক্রমে পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু ভোক্তা ও খুচরা পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো না হলে ভ্যাট আদায়ে যে বিশৃঙ্খলা হতে পারে, সেটা কি ভাবা হয়েছে? এনবিআর বলছে, তারা ২ লাখ লোককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অথচ ব্যবসায়ীদের সংগঠন থেকে দাবি করা হচ্ছে- কোনো প্রশিক্ষণই হয়নি।

এখন ভ্যাট আদায় দুই বছর পিছিয়ে গেল। এ সময়টি কীভাবে কাজে লাগানো হবে, সেটা নিয়ে এখন থেকেই ভাবা দরকার। সরকারের আয়-ব্যয়ে কী প্রভাব পড়বে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভ্যাট আদায়ের নতুন পদ্ধতি চালু হলে আয়কর আদায়েও ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। এখন কী হবে? তবে কেউ কেউ মনে করছেন, বিদ্যমান ভ্যাট আইন প্রয়োগ করেও বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব। কী হয়, সে জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু শঙ্কা হয়, ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়বে। ফলে পরের বছর সুদ খাতে আরও বেশি অর্থ গুনতে হবে। সরকার বাজেটের আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকাই রেখে দিয়েছে। এটা কমিয়ে এখনই ৩ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার মতো করা যেত। এর ফলে আয়-ব্যয় নিয়ে উৎকণ্ঠা কম হতো, বাস্তবায়নকারীরা বছরজুড়েই সচেষ্ট থাকতেন লক্ষ্য পূরণে। এ পথে না চলায় বছরের মাঝামাঝি গিয়ে বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট প্রয়োজন হতে পারে। এর অর্থ, ব্যয়ের ক্ষেত্রে বছর শেষে তাড়াহুড়ো করা।

আরও একটি বাস্তবতা মনে রাখতে হবে। ২০১৮ সালকে নির্বাচনের বছর হিসেবে ধরা হচ্ছে। এ সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বাড়তে পারে। সঙ্গত কারণেই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে দেখা দিতে পারে স্থবিরতা কিংবা গতি হতে পারে শ্লথ। খাদ্যশস্যের বাজারে অস্থিরতাও অস্বাভাবিক নয়। এর সঙ্গে যদি রফতানি আয় ও প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রবৃদ্ধি না ঘটে তাহলে নতুন অর্থবছরের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন বৈকি।

 

গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর, পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)