সরকারের হাতে খাদ্য-মজুদ কম থাকলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়াবেঃ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in সকালের খবর on Friday 5 May 2017

মজুদ ৫ লাখ টনেরও নিচে: খাদ্য মজুদ নেমেছে সর্বনিম্নে

এসএম আলমগীর

খাদ্যশস্য মজুদ স্মরণকালে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। চাল ও গম মিলে খাদ্য মজুদ এখন ৫ লাখ টনেরও নিচে। একদিকে খাদ্যশস্যের মজুদ কম, অন্যদিকে এবার হাওর এলাকার ফসল পাহাড়ি ঢলের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে চলতি মৌসুমে ধানের উত্পাদনও অনেক কম হবে। একদিকে মজুদ কম, অন্যদিকে কমবে উত্পাদন। সেই সঙ্গে চালের বাজারও চড়া গত এক বছর ধরে। হাওরের সঙ্কটে নতুন করে আরও বেড়েছে চালের দাম। এ অবস্থার মধ্যে খাদ্য মজুদ এত কমিয়ে আনাকে ভালোভাবে দেখছেন না বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, এতে চালের বাজারে সঙ্কট আরও বাড়বে এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা এর ফায়দা নেবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৮৪ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ২ লাখ ৯০ হাজার টন এবং গম ১ লাখ ৯৪ হাজার টন। এর আগে কখনও গম ও চালের মজুদ পরিস্থিতি এত নিচে নেমে আসেনি। অথচ গত বছরের একই দিন খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৫৭ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুদ ছিল ৭ লাখ ৫৮ হাজার টন ও গমের মজুদ ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার টন।

খাদ্য মজুদ কমে যাওয়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সকালের খবরকে বলেন, খাদ্য মজুদ এত কমিয়ে আনা ঠিক হয়নি। এর মাশুল শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষকেই দেওয়া লাগবে। কারণ সরকারের হাতে মজুদ কম থাকলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়াবে। সরকার মজুদ কমিয়ে ব্যবসায়ীদের সে সুযোগ করে দিল। তিনি বলেন, এবার সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় ১ লাখ ৭১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমির ধান পানিতে ডুবে গেছে। দেশের উত্পাদিত ধানের ২৫ শতাংশ হাওর এলাকা থেকে আসে। এর মানে এবার ২৫ শতাংশ ধান উত্পাদিত হবে না। এতে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

একদিকে উত্পাদন কমছে, অন্যদিকে মজুদ কম। দুইয়ে মিলে সামনে হয়তো সঙ্কট আরও বাড়বে। সুতরাং সরকারকে আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে আগে থেকে চাল আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে গমের মজুদ যে ২ লাখ টনের মতো আছে তাতেই আপাতত পরিস্থিতি সামলানো যাবে বলে মনে করছে খাদ্য অধিদফতর। কিন্তু চালের মজুদ নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নয় খোদ রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থাটি। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে ৬ লাখ টন চাল আমদানির প্রস্তাব সংবলিত চিঠি গত সপ্তাহে খাদ্য অধিদফতর থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. বদরুল হাসান সকালের খবরকে বলেন, চালের মজুদ এত কমে যাওয়ায় আমরা দ্রুত বিকল্প উপায়ে মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছি। তার আলোকেই অধিদফতরের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রীও আমাদের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। আশা করছি দ্রুত এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পাব। খাদ্যশস্যের মজুদ পরিস্থিতি এখন এতটাই কমেছে যে, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে তা সর্বনিম্ন। চলতি বছরের আগের চার বছরের মজুদ পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাবে এ বছরের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি মজুদ ছিল আগের বছরগুলোতে। যেমন ২০১৬ সালে খাদ্যশস্য মজুদ ছিল ১০ লাখ ৫৭ হাজার টন। তার আগের বছর অর্থাত্ ২০১৫ সালে মজুদ ছিল ১৪ লাখ ৫৮ হাজার টন। ২০১৪ সালে খাদ্যশস্য মজুদ ছিল ১০ লাখ ৭ হাজার টন। আর ২০১৩ সালে খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১১ লাখ ৮০ হাজার টন। সুতরাং সবশেষ পাঁচ বছরের মধ্যে এবার খাদ্যশস্য মজুদ সর্বনিম্ন। অবশ্য এ বছর খাদ্যশস্য মজুদ কমার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল কম মজুদ করা হয়। সেই ঘাটতি এখনও রয়ে গেছে। এ বিষয়ে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, গত বোরো মৌসুমে প্রথমে আমরা ধান কেনার দিকে বেশি জোর দিয়েছিলাম। গত বছরের মে, জুন, জুলাই-তিন মাস ধান কেনা হয়। আগস্ট থেকে চাল কেনা শুরু হয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বর দুই মাসে ৫ লাখ টন চাল কেনা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৭ লাখ টনের মতো। অর্থাত্ ২ লাখ ৫০ হাজার টনের মতো চাল কম সংগ্রহ করা হয় গত বছর। মূলত এ কারণে এবার মজুদটা বেশি কমে গেছে। তিনি বলেন, এর আগে ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সবশেষ খাদ্যশস্য মজুদ ৫ লাখ টনের নিচে নেমে এসেছিল। এ ছাড়া আর কখনও এত নিচে নামেনি খাদ্যশস্যের মজুদ। সুতরাং মজুদ যাতে বাড়ানো যায় তার জন্য আমাদের দ্রুত চাল আমদানি করতে হবে। তিনি জানান, বাংলাদেশ মূলত ভারত থেকেই দ্রুত সময়ের মধ্যে চাল আমদানি করে থাকে। অথচ সে দেশটিতে এখন প্রতিটন চালের মূল্য ৩৯৫ থেকে ৪০০ ডলার। এই দামে চাল আমদানি করলে প্রতিকেজির দাম পড়বে ৩৬ টাকার ওপর। অথচ আমরা সরকারি দামে ৩৪ টাকায় চাল বিক্রি করে থাকি। সুতরাং চড়া দামে চাল আমদানি করে সুবিধা করা যাবে না। তাই এখন চালের আমদানি শুল্ক যে ২৮ শতাংশ রয়েছে তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা দরকার। তাহলে চাল আমদানি করে কিছুটা কম দামে দেশের গরিব মানুষকে দেওয়া যাবে এবং যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যাবে। কম দামে যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে চাল আমদানি করা যায় তার জন্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে চালের আমদানি শুল্কও সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিষয়টি এখন সরকারের সর্বোচ্চ মহলের বিবেচনাধীন।