সরকার নীতি–সংস্কার ও উদ্ভাবনী কৌশলে পিছিয়ে – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in প্রথম আলো on Wednesday, 31 May 2017

Debapriya

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একজন অর্থনীতিবিদ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো। দুই দশক ধরে তিনি বাজেট বিশ্লেষণের সঙ্গে জড়িত। আর এক দিন পরেই উপস্থাপিত হবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নতুন বাজেট। আসন্ন এই বাজেটের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথমআলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শওকত হোসেন

প্রথম আলো : গত বছর বাজেটকে আপনি তির-ধনুকের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, এই তির দিয়ে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। ঠিক এক বছর পর এসে কী মনে হচ্ছে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : এ বছরের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। কিন্তু প্রাথমিক বাজেটীয় তথ্য বলছে, প্রাক্কলিত সামষ্টিক ও খাতওয়ারি লক্ষ্যসমূহের সঙ্গে প্রকৃত অর্জনের পার্থক্যটা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় কিছুটা চাপ বেড়েছে। তাই ধনুকের টানাটাও দুর্বল হয়ে গেছে কি না, তিরটাও ভোঁতা হয়ে গেল কি না—এটাই এখন আলোচ্য বিষয়।

প্রথম আলো : বাজেট বাস্তবায়নে কী কী সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : বর্তমানে বাজেট ব্যবস্থাপনায় অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। যেমন যত দ্রুততার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কর আদায় করেছি, ঠিক সে রকম দক্ষতার সঙ্গে সরকারি ব্যয় করতে পারছি না। বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার দ্রুততর করতে পারিনি। যেহেতু আর্থিক কাঠামোটা দুর্বল, এর ভেতরের প্রাধিকারগুলো এটার দ্বারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ না হওয়ায় তা ব্যক্তি বিনিয়োগের ওপর প্রভাব রাখেনি। প্রকল্প ব্যয়ের গুণমান বিচার করার জন্য কোনো কাঠামো এখনো দাঁড়ায়নি। তাই সামষ্টিক প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেও কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান, সামাজিক উন্নয়ন ও সুষম উন্নয়নের ক্ষেত্রে আশানুরূপ প্রতিফলন আমরা দেখছি না।

প্রথম আলো : কর আহরণ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অন্যান্য সমস্যাও তো আছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : জনগণের কাছ থেকে নেওয়া কর হাত ঘুরে বিদেশে পাচার হওয়া আরও বেড়েছে। পাচারকারীদের নাম প্রকাশ হওয়ার পরও কোনো আইনি ব্যবস্থা না নেওয়া, বিভিন্ন দেশে সম্পত্তি ক্রয় এখন খোলামেলা সত্য। বড় বড় ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে আদায়কৃত বাড়তি কর দিয়ে সরকারি ব্যাংকের পুনঃপুঁজীকরণ হচ্ছে। এ ছাড়া ১৫ শতাংশ হারে একক ভ্যাট হার প্রচলন নিয়ে সমস্যার কথা তো সবাই জানে। তাই কর আহরণ বাড়লেও সেটির নৈতিক ভিত্তি কিছুটা দুর্বল। করের বোঝা সুষম করার জন্য সিপিডি বলেছিল, ব্যক্তি করের প্রথম হারটি ১০ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশতে কমানোর কথা।

প্রথম আলো : যে কথাগুলো বললেন, এ ধরনের কথা তো কয়েক বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে, তারপরও কিছু হচ্ছে না।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : ধারাবাহিক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, নীতি সংস্কার ও উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক কৌশল নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার পিছিয়ে আছে। ২০১২-১৩ সালের পর থেকে বর্তমান সরকার কোনো বড় ধরনের সংস্কারে যায়নি। এই উদ্যোগহীনতা এখন পুঞ্জীভূতভাবে দেশের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

প্রথম আলো : সংস্কার না হওয়ায় অর্থনীতিতে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : সফল বাজেট বাস্তবায়নের জন্য একটি অনুকূল নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ লাগে। যেমন ব্যাংক খাত এখন অর্থনীতির ভেতরে একটা দুষ্ট ক্ষত। প্রয়োজন ছিল সমস্যার প্রকৃত রূপ চিহ্নিত করার জন্য ও সমাধান বের করার জন্য একটি সময় নির্দিষ্ট ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা। অথচ হলো উল্টো পথে যাত্রা। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনে ২০০৪-০৫ সালে যে কমিটি করা হয়েছিল, আমি নিজে সেটার সদস্য ছিলাম। সেখানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা, সুশাসন শক্তিশালী করা, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে যেসব সুপারিশ ছিল তা পরবর্তী সময়ে কার্যকর করা হয়। অথচ এখন আবার পারিবারিক পরিচালকের সংখ্যা ও মেয়াদ বাড়িয়ে অর্থ জমাকারীদের স্বার্থÿ ক্ষুণ্ন করা হলো। রেইনট্রি হোটেল নির্মাণে অর্থায়নের প্রক্রিয়া প্রমাণ করে যে ব্যক্তি খাতের পরিচালকেরা কীভাবে বাধাহীনভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে। আর ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনে অভিযোগ উঠেছে যে বৃহৎ ঋণগ্রহীতা কীভাবে অন্যতম মালিক হয়ে যায়। পুঁজিবাজারের অবস্থা অনেকটা নীরব ক্যানসারের মতো। পুঁজিবাজারেরও এত সংস্কারের উদ্যোগ এখনো কোনো কার্যকর ফল দিল না। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা, বিও অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনায় জটিলতা ইত্যাদি সমস্যা রয়ে গেছে। তাই ক্ষুদ্র লগ্নিকারকেরা ঝুঁকিতে রয়ে গেলেন।

ভবিষ্যতে বাজেট যদি বাড়াতে হয় তাহলে ঢাকায় বসে এত টাকা খরচ করা হবে কল্পনাতীত ব্যাপার। আর্থিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সম্পদের সমাবেশ, স্থানীয় সরকারের ভূমিকাকে জোরদার করার দিকে এগোলাম না। উল্টো জেলা বাজেট তৈরির উদ্যোগকে পরিত্যাগ করলাম। একইভাবে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের স্বাধীনভাবে মেধার ভিত্তিতে কাজ করার আইন পাস করলাম না।

বাজেটের ওপর জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণও অনেক ক্ষীণ। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোও কোনো ভূমিকা এ ক্ষেত্রে রাখে না। এরা মন্ত্রণালয়ের তিন বছর মেয়াদি বাজেট-কাঠামোকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রকল্প চয়ন, বাস্তবায়নে নজরদারি এবং প্রকল্প শেষ হলে মূল্যায়ন করার মতো কোনো কাজই করে না। সংসদেও অর্থনীতির নীতিগত কোনো বিষয় নিয়ে সে রকম আলোচনা হয় না। শেষ পর্যন্ত বাজেট অত্যন্ত আমলানির্ভর থেকে যায়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বা পিপিপি একটি আকর্ষণীয় ধারণা ছিল, এর অক্ষরগুলো দিয়ে কোনো সাফল্যের বাক্য আমরা রচনা করতে পারলাম না।

প্রথম আলো : অর্থনৈতিক সংস্কার না করেও প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি হচ্ছে, এর ব্যাখ্যাটা কী?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : বাংলাদেশের অর্থনীতির ৫০ শতাংশের বেশি হলো সেবা খাত। এ খাতে যদি ৬ থেকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় তাহলে বাংলাদেশে কখনোই প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশের নিচে নামবে না। তবে সেবা খাতের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হিসাব করার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। উৎপাদনশীল খাতের জন্য যে প্রাক্কলন করা হয়, সেটাও বছরের তিন-চার মাসের প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়, বাকিটা অনুমাননির্ভর। সাম্প্রতিক অকালপ্লাবন কৃষির প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেবে, রপ্তানি আয় ইদানীং দুর্বল হয়ে যাওয়ায় শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কার্যত কমে যাবে। তাই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উৎপাদনশীল খাতের বিকাশ। অথচ এ বছর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ হার বাড়েনি, ভোগের ক্ষেত্রেও সরকারি অংশ বেড়েছে। আর রেমিট্যান্স আয় নেতিবাচক থাকায় মোট জাতীয় সঞ্চয়ের হারও কমবে।

আসলে প্রবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে দেশে একটা মানসিক বৈকল্য (প্যারানয়া) সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটাই একমাত্র ধ্রুব না। সত্যি সত্যিই যদি বর্তমান প্রবৃদ্ধি এত তাৎপর্যপূর্ণ হতো তাহলে ৪০ শতাংশ যুবক কর্মহীন থাকত না। উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি যদি প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে তাহলে এ প্রবৃদ্ধির গুণগত মান নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বড় প্রমাণ হলো সাম্প্রতিক শ্রম জরিপ প্রদত্ত তথ্য। হয়তো দেশ একটা পর্যায় দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নতুন প্রযুক্তি আসার ফলে শ্রমের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমছে।

প্রথম আলো : সরকারের মনোযোগ তো এখন বড় বড় প্রকল্পের দিকে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : কিন্তু মেগা প্রকল্পে মাইক্রো স্বস্তি দিচ্ছে না। মেগা প্রকল্পে অতি-অর্থায়ন, বিলম্বিত বাস্তবায়ন, প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে সম্পদের অপচয় হচ্ছে। অথচ শিক্ষা ও ÿস্বাস্থ্য খাতে টাকা না দিয়ে এসব প্রকল্পে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। তাই জনগণ দুই-তিন দিক দিয়ে বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি দ্রুত কাটাতে হবে। এটা শুধু বাজেটের কোনো ব্যাপার না। প্রয়োজন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, অর্থনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামাজিক সমর্থন।

প্রথম আলো : তাহলে এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই নয়?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : আমাদের সৌভাগ্য গত আট বছরে আমরা একটা অনুকূল বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমাদের বৈদেশিক খাতে চিড় দেখা দিচ্ছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় শ্লথ হচ্ছে। এর ফলে মাঠপর্যায়ে ভোগের মাত্রা সীমিত হচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ছে না। এই চিড় যদি ফাটল হয়ে দেখা দেয় তাহলে সূচকে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। নতুন ভ্যাট আইন, চালের দাম বেড়ে যাওয়া এবং জ্বালানির দাম না কমানোয় আগামী বছর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর মেধা ও পরিশ্রমের মূল্যায়ন না হলে অর্থনীতিতে উদ্ভাবনী শক্তি থাকে না। বৈষম্যমুখী সমাজের মধ্যে আরেক ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন মাদকাসক্তি, অসহিষ্ণুতা, জঙ্গিভাবাপন্ন মনোভাব।

প্রথম আলো : অর্থনৈতিক সংস্কারে সরকারের হাত না দেওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : সরকার কি চেতনার অভাবের কারণে নাকি সচেতনভাবে সংস্কার না করার সিদ্ধান্ত নিল—এটা বোধগম্য নয়। সামনে নির্বাচন। তাই সরকারের কোনো পদক্ষেপ এখন কোনো পক্ষকে অখুশি করবে বলেও মনে হয় না। নির্বাচনের আগে পুঁজিবাজারের দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেবে, বেসিক ব্যাংকের মতো ‘বেসিক’ বিষয়ে হাত দেবে—তা আশা করতে পারি না। অথচ রাজনৈতিক অর্থনীতিকে ঠিক করতে না পারলে কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় বাজেট বাস্তবায়ন দক্ষ করার সুযোগ কম। এখন আসলে তির-ধনুকের আলোচনার চেয়ে তিরন্দাজদের নিয়েই বেশি আলোচনা করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

প্রথম আলো : শেষ কথা তাহলে কী বলবেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : সরকার তার বর্তমান মেয়াদকালের শুরুতে প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিমালা সংস্কারের বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সব দেশে অর্থ মন্ত্রণালয়ই গোষ্ঠীস্বার্থের ওপরে থেকে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। সংস্কারের কারণে সৃষ্ট সাময়িক দুঃখ-কষ্টের জন্য তাদের গালমন্দ শুনতে হয়, কিন্তু শেষ বিচারে মানুষ এই দূরদর্শী ভূমিকার জন্য তাদের প্রশংসা করে। আমরা তো এ ক্ষেত্রে শুধু উদ্যোগহীনতাই দেখলাম না, দেখলাম অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা-সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রকট সমন্বয়ের অভাব। এর মধ্যে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড, বিনিয়োগ বোর্ড, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। দেখুন, বাজেট ঘোষণার এক সপ্তাহ আগেও ভ্যাটের হার নিয়ে বিভ্রান্তিকর অবস্থা। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে না পারাটা ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য তিরন্দাজেরা নতুন কী কর্মপরিকল্পনা দেয়, তা দেখার অপেক্ষায় আছি।

প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : ধন্যবাদ।