Dr Khondaker Golam Moazzem on growth and employment

দেশের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়ে কর্মসংস্থান কিছুটা কম হয়েছে। এতে সার্বিকভাবে মানুষের আয় কিছুটা কমে যাওয়ায় ভোক্তাপর্যায়ে এর প্রভাব পড়তে পারে। যদিও এ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল।

Published in Bonik Barta on Tuesday, 3 November 2015.

শেয়ারবাজারে মন্দা
অর্থনীতির অন্য শাখায় ছড়িয়ে পড়ছে

আলতাফ মাসুদ

২০১০ সালের পর থেকেই মন্দা চলছে দেশের শেয়ারবাজারে। এর প্রভাব পড়েছে ভোক্তা আস্থায়। সব ধরনের ব্যয়ে সতর্কতা অবলম্বন করছেন ভোক্তারা। শেয়ারবাজারের এ মন্দা ছড়িয়ে পড়ছে অর্থনীতির অন্যান্য শাখায়ও। ২০১০ সালের পর থেকে মন্দার মধ্যে রয়েছে আবাসন খাত। শেয়ারবাজার ধসের প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতেও।

বাংলাদেশে ভোক্তা আস্থা কমে যাওয়ার তথ্য রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ডের প্রতিবেদনে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৮ পয়েন্ট হারিয়ে ভোক্তা আস্থা সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট ৭৫ দশমিক ৩। যদিও এ সূচকে বাংলাদেশ এখনো ‘সবচেয়ে আশাবাদী’র তালিকায় রয়েছে। অবশ্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের শেয়ারবাজারে সূচকপতনের পরও ভোক্তা আস্থা সূচকে তারা আগের ‘অত্যন্ত আশাবাদী’ অবস্থান ধরে রেখেছে।

২০১৪ সালে শেয়ারবাজার পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে থাকায় দ্বিতীয়ার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ভোক্তা আস্থা সূচকে এশিয়া-প্যাসিফিক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। সে সময় ভোক্তা আস্থা সূচক ৮৩ দশমিক ৩ পয়েন্টে উন্নীত হয়। ফলে এ সূচকে ‘সবচেয়ে আশাবাদী’র তালিকায় স্থান পায় বাংলাদেশ। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত শেয়ারবাজারের অস্থিরতায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচকটি হারায় প্রায় ৪০০ পয়েন্ট।

মূলত পাঁচটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ভোক্তা আস্থা সূচক গণনা করে মাস্টারকার্ড। এগুলো হচ্ছে— সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও নিয়মিত আয়ের সম্ভাবনা, শেয়ারবাজার ও ভোক্তার জীবনমান। সূচক গণনার ক্ষেত্রে শূন্য হচ্ছে ‘সবচেয়ে হতাশাপূর্ণ’ অবস্থান। ৪০ থেকে ৬০ পয়েন্ট অর্জনকারী দেশের ভোক্তা আস্থাকে নিরপেক্ষ, ৭৫ থেকে ৯০ পয়েন্ট হলে সবচেয়ে আশাবাদী ও ৯০ থেকে ১০০ পয়েন্ট অর্জনকারী দেশের ভোক্তাকে ‘অত্যন্ত আশাবাদী’ হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

যোগাযোগ করা হলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, যেহেতু শেয়ারবাজারে মধ্যবিত্তের সম্পৃক্ততা অনেক বেড়েছে, সে কারণে এ বাজারের পতন ভোক্তা আস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও আমাদের দেশে ভোক্তাদের মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্তের সংখ্যাই বেশি। শেয়ারবাজারের পতনের চেয়ে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার বিষয়টি ভোক্তা আস্থা সূচক গণনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন তিনি।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিও হিসাবের সংখ্যা অনুযায়ী শেয়ারবাজারে এখন অনেক বেশি মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তার পরও তা মোট জনসংখ্যার বিবেচনায় খুবই কম। এ হিসাবে ভোক্তা আস্থা সূচকের মূল্যায়নটি অতিমূল্যায়িত।

সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুুযায়ী, বিও হিসাব রয়েছে বর্তমানে ৩১ লাখ। এসব বিওধারীর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি বিবেচনায় নিলে ভোক্তার সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

ভোক্তা আস্থা কমে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায় ব্যক্তিখাতে ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হ্রাসের তথ্যেও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয়ে বেশ তেজিভাব ছিল। সে সময় এতে প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয়ে নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়। ওই অর্থবছর দেশে ব্যক্তিখাতে ভোগ ব্যয় প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৯ শতাংশে, ২০১০-১১ অর্থবছরে যা আরো কমে দাঁড়ায় ৪ শতাংশ। পরের দুই অর্থবছর ভোগ ব্যয় বৃদ্ধির হারে কিছুটা ত্বরণ সৃষ্টি হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যক্তিখাতে ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা আরো কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। তবে এর পরের অর্থবছর ব্যক্তিখাতের প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক হ্রাস পায়। এ সময় ব্যক্তিখাতে ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ৭৩।

ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভোক্তারা যে সতর্ক মনোভাব দেখাচ্ছেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য বিক্রির তথ্যেও তা উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধিতে থাকলেও চলতি বছর লাফার্জ সুরমা, গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইন, ম্যারিকো ও আরএকে সিরামিকসের পণ্য বিক্রির পরিমাণ কমে গেছে। দেশীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এপেক্স ফুটওয়্যার ও বেক্সিমকো লিমিটেডের পণ্য বিক্রির পরিমাণও কমেছে।

ভোগ ব্যয়ে সাধারণ মানুষ সতর্কতা অবলম্বন করছে বলে জানান লাফার্জ সুরমা সিমেন্টসহ চারটি বহুজাতিক কোম্পানির পরিচালক মাসুদ খান। তিনি বলেন, ভোক্তাপর্যায়ের এ আচরণের প্রভাব পড়ছে বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধিতে।

শেয়ারবাজারধসের সবচেয়ে বড় প্রভাবটা পড়েছে আবাসন খাতের ওপর। ২০১০ সাল পর্যন্তও চাঙ্গা ছিল দেশের আবাসন খাত। এর পর থেকেই মন্দায় পড়ে খাতটি। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় গেছে ২০১৩ সাল। ওই সময় আবাসন খাতের বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে যায়। এ অবস্থা থেকে এখনো বেরোতে পারেনি খাতটি। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোরই ১২ হাজার ফ্ল্যাট বর্তমানে অবিক্রীত রয়েছে। সব মিলিয়ে এ খাতের প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা আটকে আছে।

শেয়ারবাজার পতনের প্রভাব ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও পড়েছে। টানা দরপতনে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগে লোকসান হওয়ায় বিপুল পরিমাণ সঞ্চিতি রাখতে হয়েছে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও কমছে ব্যাংকগুলোর। গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। গত জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।

ভোক্তা আস্থা কমে যাওয়ার জন্য শেয়ারবাজারের মন্দাকে বড় করে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বিবেচনায় নিলে তাতে সরাসরি প্রভাব হয়তো অনুধাবন করা যাবে না। তবে দেশে বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও কম নয় এবং এদের অধিকাংশই মধ্যবিত্তশ্রেণীর। শেয়ারে লোকসান হলে বিনিয়োগকারী কিংবা তার পরিবার খরচের ক্ষেত্রে সতর্ক হবে, এটাই স্বাভাবিক।

মাস্টারকার্ডের জরিপ প্রতিবেদনকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মার্কেট রিসার্চের অবজেক্টিভ হিসেবে দেখা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, দেশের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়ে কর্মসংস্থান কিছুটা কম হয়েছে। এতে সার্বিকভাবে মানুষের আয় কিছুটা কমে যাওয়ায় ভোক্তাপর্যায়ে এর প্রভাব পড়তে পারে। যদিও এ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল।