Debapriya Bhattacharya talks about political and economic status quo

Interview published in Bangladesh Pratidin on Tuesday, 24 December 2013.

ভ্রষ্ট রাজনীতি নষ্ট অর্থনীতি – ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

সাক্ষাৎকার: রুহুল আমিন রাসেল

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, নীতিভ্রষ্ট রাজনীতি নষ্ট করছে বাংলাদেশের সম্ভাবনার অর্থনীতিকে। দুষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনীতি ক্রমান্বয়ে অর্থনীতির মৌলগুলোকে দুর্বল করে ফেলেছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ একটাই, তা হলো- আস্থাভাজন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ এবং সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন। এটা যতদিন না হবে, ততদিন বাংলাদেশে শান্তি ও স্বস্তি আসবে না বলেও মন্তব্য করেন প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সমাজসচেতন এই বিশ্লেষক আরও বলেন, বর্তমানে যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে তা দেশে একটি স্বাধীন ও সক্ষম নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। নাগরিক সমাজ নির্বাচন কমিশনের প্রতি যতগুলো সদিচ্ছা দেখিয়েছিল, তারা (নির্বাচন কমিশন) সব ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দুষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনীতি ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলগুলোকে দুর্বল করে ফেলছে। উৎপাদক পর্যায়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি করছে। গত দুই বছরের বিনিয়োগের পতনের ধারাকে আরও জোরদার করছে। এর ফলে পর পর তৃতীয়বারের মতো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের পতন ঘটতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তিন দশকের এক শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি বাড়ার ধারা থেকে দেশ বিচ্যুত হতে পারে।

বর্তমান অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের নিচে নেমে যাবে- এ কথা আগে সিপিডি বলেছিল গত অক্টোবর মাসে, এর পর বিশ্বব্যাংকও একই প্রক্ষেপণ করেছে এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বলতম বিষয় হলো বিনিয়োগ হারের পতন। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ। গত দুই বছর সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের কমতিকে পুষিয়ে নেওয়া গেছে কিছুটা। অর্থাৎ ব্যক্তি খাতে পতন হলেও সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়াতে মোট বিনিয়োগ মোটামুটি আগের বছরের সমান ছিল। এ বছর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এবং সরকারি খাতের বিনিয়োগ উভয়ই কিন্তু এখন নিম্নমুখী হয়ে গেছে। তাই এবার মোট বিনিয়োগে হারের পতন ঘটতে পারে। তার মতে, বেসরকারি খাতে যে বিনিয়োগ কমে গেছে, তার প্রমাণ হলো- জুন মাসে ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহের হার যা ছিল, এখন তা আরও কম। শিল্প ঋণের বৃদ্ধির হারও ঋণাত্বক। ব্যাংকের ভেতরে উদ্বৃত্ত তারল্য ৮৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। তফসিলকৃত মন্দ ঋণের হারও গত পাঁচ মাসে আরও বেড়ে গেছে। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় আমদানি প্রবাহে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। স্থবির আমদানির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিনিয়োগের ধারাবাহিক পতনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বড় ভূমিকা রাখছে। অনিশ্চিত রাজনীতিতে কোনো বড় বিনিয়োগ হয় না। সরকারি বিনিয়োগ যে এবার কমে যাচ্ছে, তার বড় প্রমাণ হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত ৫-৬ বছরের মধ্যে এ বছর সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ না পাওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে প্রাক্কলিত পরিমাণে বৈদেশিক প্রকল্প সাহায্য না আসা। গত অর্থবছর প্রথম চার মাসে যেখানে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপর নিট বৈদেশিক সাহায্য এসেছিল, এবার সেখানে ৮৫ মিলিয়নের মতো এসেছে। একই সঙ্গে উন্নয়ন প্রশাসন স্থবির হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক নাশকতা ও সহিংসতা চলছে এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক যে হ-য-ব-র-ল অবস্থা, তাতে মাঠপর্যায়ে প্রশাসন উন্নয়ন কর্মসূচিতে মনোযোগ দেওয়ার কোনো সুযোগই পাচ্ছে না। আগ্রহও নেই, সুযোগও নেই সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। জাতিসংঘে কাজ করার অভিজ্ঞ সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগও বাড়ছে না। গত বছরের মতোই আছে। বছর শেষে হয়তো এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আশেপাশেই থাকবে। বাংলাদেশ একটি নিরাপদ বৈদেশিক বিনিয়োগ স্থল হিসেবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রেমিটেন্স আয়ের ধারাবাহিকভাবে পতন ঘটছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বিদেশে মানুষ যাওয়ার পরিমাণ প্রায় ২১ শতাংশ কমে গেছে। এটা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে রেমিটেন্স প্রবাহ আরও দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে রপ্তানি ভালো আছে। জিএসপি বাতিল ও রানা প্লাজা বিপর্যয় সত্ত্বেও রপ্তানি ভালো আছে। কিন্তু এই ভালো যে থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। রপ্তানি যেটুকু ভালো আছে, এটুকু শুধুই তৈরি পোশাকনির্ভর। আর পোশাকশিল্প বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন। পাট, চামড়াজাত পণ্য ও হিমায়িত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এ বছর উন্নতি নেই। তার মতে, আন্তর্জাতিক বাজার সুবিধা হারানোর আশঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করেছে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। সহিংস রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে পণ্যের উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও পণ্য জাহাজিকরণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় বিদেশের বাজারে সময়মতো মাল পেঁৗছানো কঠিন হয়ে পড়ছে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ইতোমধ্যে বিকল্প উৎস খোঁজা শুরু করেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশকে একটি নির্ভরযোগ্য আমদানি উৎস (ক্রেতার জন্য) হিসেবে মনে করা হচ্ছে না।

ড. দেবপ্রিয় মনে করেন, কৃষিতে এবার আমন ভালো হয়েছিল। কিন্তু পণ্য চলাচলে সমস্যা হওয়ার কারণে ধানকল ও পাইকারি পর্যায়ে পণ্য আটকে যাচ্ছে। এর ফলে পুরো সরবরাহ ব্যবস্থায় অসুবিধা হচ্ছে। পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে এবং সরবরাহ অনিশ্চিত হওয়ার জন্য পণ্য খুচরা বাজারে আসতে পারছে না। পণ্য সরবরাহ কমে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। সিপিডির সাবেক নির্বাহী পরিচালক বলেন, সমস্যা আরও বেশি হচ্ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের। যারা অল্প মূলধনে চলেন, তাদের যদি টার্নওভার না থাকে তাহলে তারা ব্যবসা সচল রাখতে পারবেন না। খুচরা পর্যায়ে বিক্রেতারা দোকান খুলতে পারছেন না। কিন্তু মাস গেলে তাদের বেতন-ভাতা ও দোকান ভাড়া দিতে হবে। অর্থাৎ দেশের উচ্চবর্গের রাজনীতিবিদদের সমস্যাটা এখন উৎপাদক পর্যায়ে পেঁৗছে গেছে। এটা কত গভীর হবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা কতটা দীর্ঘস্থায়ী এবং ব্যাপক হবে।

আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচন যেভাবে এগুচ্ছে যদি সেভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে আমরা হয়তো একটা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার সরকার পাব। কিন্তু সেই সরকারের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা হবে খুবই সঙ্কুচিত। সেই সরকারের নৈতিক বৈধতা হবে খুবই সংকীর্ণ। সেক্ষেত্রে সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা হবে বেশ কম। যে সরকার আইনি ব্যবস্থা নিতে দ্বিধায় থাকবে, তারা রাজস্ব আদায় করতে পারবে না। বিনিয়োগে ব্যক্তি খাত এগিয়ে নাও আসতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি যে, নির্বাচনকালীন সরকার একটির পর একটি বড় বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ সরকার প্রশাসনে পদায়ন, বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন, বীমা কোম্পানির লাইসেন্স ইত্যাদি প্রদানের কাজ করে যাচ্ছে। যে কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনে এসব সিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আমাদের নির্বিকার নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি কমে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নাশকতা-সহিংসতা দীর্ঘস্থায়ী হলে উদ্যোক্তারা শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই করতে বাধ্য হবেন। সেক্ষেত্রে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়বে।