Professor Mustafizur Rahman on food inflation

Published in Banik Barta on Friday, 25 April 2014.

চালের দাম বাড়ায় আরো নাজুক হতদরিদ্ররা 

সাইদ শাহীন

অঞ্চলভেদে এক মাসের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৭ টাকা। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জীবনমানে। বাড়তি দামের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে বাধ্য হয়ে চালের ভোগ কমিয়ে দিচ্ছে এসব পরিবার। ফলে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদায়। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য ব্যয়েও পিছিয়ে পড়ছে তারা। সব মিলিয়ে চালের মূল্যবৃদ্ধি আরো নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারগুলোকে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলছে, এ ধরনের পরিবারের হার ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিআইডিএসের ‘বাংলাদেশ ফুড মার্কেট পারফরম্যান্স: ইনস্ট্যাবিলিটি, ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যমূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারগুলো। ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতদরিদ্র পরিবারই তখন চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। তবে শুধু দরিদ্রদের বেলায় এ হার কিছুটা কম। এক্ষেত্রে ৬৬ শতাংশ দরিদ্র পরিবার চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। দরিদ্র ও অতিদরিদ্রের বাইরে মধ্যবিত্তরাও খাদ্যমূল্যস্ফীতিতে প্রভাবিত হয়। এ শ্রেণীর প্রায় ২৪ শতাংশ পরিবার ভোগ কমিয়ে দেয়। পরিবারের অন্যান্য ব্যয় মেটাতেও হিমশিম খেতে হয় তাদের। খাদ্যচাহিদা মেটাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ে পিছিয়ে পড়ে তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দরিদ্র কিংবা অতিদরিদ্র শ্রেণীর পরিবারগুলো তাদের উপার্জনের ৫০-৭০ শতাংশ ব্যয় করে খাদ্য বাবদ। এর আবার সিংহভাগ ব্যয় হয় চাল কেনায়। ফলে চালের দাম বাড়লে বাধ্য হয়ে এ শ্রেণীর মানুষ ভোগ কমিয়ে দেয়। এর প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন পুষ্টিচাহিদায়। এতে একদিকে পুষ্টিহীনতায় ভোগা পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যায়, অন্যদিকে দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব হয় না।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, চালের দাম বাড়ার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। যারা চালের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুষ্টি গ্রহণে পিছিয়ে পড়ছে তারা। পরিবারের অন্যান্য ব্যয় মেটাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

মজুদ থাকা সত্ত্বেও চালের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতা। প্রতি বছরই বাড়ছে মোটা, মাঝারি থেকে সব ধরনের চালের দাম। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল ১৯-২১ ও মাঝারি ২৫-২৯ টাকায়। অথচ গতকাল মোটা চাল বিক্রি হয় এর প্রায় দ্বিগুণ দামে অর্থাত্ ৩৪-৩৬ টাকায়। আর মাঝারি মানের চাল বিক্রি হয় ৩৯-৪৪ টাকায়। ২০১০ থেকে ২০১৩ সালে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল যথাক্রমে ২৫-২৮, ৩০-৩৪, ২৮-৩২ ও ৩০-৩২ টাকা। একই সময়ে মাঝারি মানের চালের দাম ছিল যথাক্রমে ৩০-৩৬, ৩৭-৪২, ৩৪-৩৬ ও ৩৪-৩৬ টাকায়।

বাজার অনুসন্ধানে জানা গেছে, মজুদ থাকা সত্ত্বেও পাইকারি ও খুচরা বাজারে দুই মাসের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৭ টাকা। গত মাসের শুরুতে রাজধানীর পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৪৬-৫০ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। এছাড়া ৩৮-৪০ টাকার বিআর-২৮ চাল এখন বিক্রি হচ্ছে  ৪০-৪২ ও ৩২-৩৩ টাকার মোটা চাল ৩৪-৩৬ টাকায়।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে খাদ্যমূল্যস্ফীতি বাড়ছে। শহরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছে। মার্চে শহরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ; গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসায়ীদের যে ক্ষতি হয়েছে, এখন তারা তা পুষিয়ে নিচ্ছেন। এর প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতির ওপর। ব্যবসায়ীদের সামান্য ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্যই খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

গত মাসে শেষ হয়েছে আমন মৌসুম। সরকারি ও বেসরকারিভাবে মজুদ বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যেই আগামী মাসের প্রথম দিন শুরু হচ্ছে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকা অবস্থায় চালের দাম বাড়াটা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, খাদ্যমূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর। এ থেকে উত্তরণে সরকারকে এখনই কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। দরিদ্র মানুষের জন্য স্বল্পমেয়াদে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার ও খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রিসহ রেশন চালু করা যেতে পারে। আর মধ্যমেয়াদে খাদ্য আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কমানোর উদ্যোগও নেয়া যেতে পারে। তবে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে কৃষির উত্পাদন বাড়ানো গেলে তা হবে যুক্তিযুক্ত।