Professor Mustafizur Rahman on project accountability and development

Published in Bonik Barta on Saturday, 14 February 2015.

বড় প্রকল্পে ভারত-চীন প্রতিযোগিতা

ইসমাইল আলী ও তাসনিম মহসিন

বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বর্তমানে বেশকিছু বড় প্রকল্প চলমান রয়েছে। আগামী কয়েক বছরে আরো কিছু বড় প্রকল্প নেয়া হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, কর্ণফুলী নদীতে টানেল ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছে বেশকিছু রেলপথ নির্মাণ, ইঞ্জিন-কোচ ও বাস-ট্রাক ক্রয়ের উদ্যোগ। আর এসব প্রকল্পের কাজ নিতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে আঞ্চলিক দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন।

দুই দেশের কেউই এককভাবে অন্যকে বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে রাজি নয়। এজন্য নানা ধরনের তদবিরও চলছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়া ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত-চীনের প্রতিযোগিতায় এরই মধ্যে ভারতের পক্ষ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তারকে ত্বরান্বিত করতেই দেশটি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গভীর করতে চাইছে বলে মনে করছেন তারা। এমনকি সম্প্রতি শ্রীলংকার নির্বাচনে রাজাপাকসের হারের পেছনে দেশটিতে চীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়টি বেশ জোর দিয়েই বলছেন বিশ্লেষকরা।

ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে চীন-ভারতের এ প্রতিযোগিতাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন না আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, চীন ও ভারতের সম্পর্কের মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে একক দেশ হিসেবে চীন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। তবে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাউথ ব্লকের আমলাদের মনোভাব এখনো আগের অবস্থানেই রয়েছে।

চলমান বড় অবকাঠামো প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুর বড় দুই অংশের কাজ এককভাবে করছে চীন। দেশটির চায়না মেজর ব্রিজ মূল সেতু ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন নদী শাসনের কাজ করছে। আবার কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণেও আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এরই মধ্যে টানেলটি নির্মাণ ও অর্থায়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও সমঝোতা স্মারক সই করেছে চীন।

এদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ নিতে চাইছে ভারত। এজন্য ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দরপত্র শিথিলের প্রস্তাব করেছে দেশটি। বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে হলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিদেশে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আর ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) চায়, দরপত্র প্রতিযোগিতামূলক করতে এ শর্ত তুলে দেয়া হোক। কেননা পিডিবির শর্ত বহাল থাকলে ভারতীয় কোম্পানি দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। এক্ষেত্রে চীন, জাপান, কোরিয়া ও ইউরোপের কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করবে। কিন্তু এ দরপত্রে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেডের (ভেল) অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় এনটিপিসি।

এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের দরপত্রেও অংশগ্রহণ করেছে ভারত। মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ-সংক্রান্ত দরপত্র যাচাই কমিটির সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছে দেশটির সর্ববৃহত্ গ্যাস আমদানিকারক পেট্রোনেট এলএনজি। দরপত্র মূল্যায়নে নির্বাচিত হলে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বছরে ৫০ লাখ টন এলএনজি আমদানি, টার্মিনাল নির্মাণ ও তা পরিচালনায় দায়িত্ব পাবে।

জ্বালানি খাত ছাড়াও সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণেও আগ্রহ দেখিয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপ। প্রস্তাবিত বন্দরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং কয়লা খালাস ও সংরক্ষণে একটি পৃথক জেটি নির্মাণেও আগ্রহী এ শিল্প গ্রুপটি। এজন্য গত বছর জুলাইয়ে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সঙ্গে দেখা করেন আদানি গ্রুপের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যদিও এর আগে কখনই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভারত আগ্রহ দেখায়নি।

এদিকে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বরাবরই আগ্রহ দেখিয়ে আসছে চীন। ২০১৩ সালে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবও দেয় দেশটি। তবে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সরকার এককভাবে কোনো দেশকে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ভারত আগ্রহ দেখায়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নেও এখন চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে এসেছে ভারত। চীনের বায়ার্স ক্রেডিটের বিপরীতে ১০০ কোটি ডলার লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) হিসেবে দিয়েছে দেশটি। এর মধ্যে ৮০ কোটি ডলার অবকাঠামো ঋণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আর ২০ কোটি ডলার পদ্মা সেতু নির্মাণে অনুদান হিসেবে দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় প্রকল্পের কাজ পেতে দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য শুভ ফল বয়ে না-ও আনতে পারে। কারণ প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেক সময়ই দর কমিয়ে দিচ্ছেন ঠিকাদাররা। অথবা দরপত্রে বিশেষ শর্ত জুড়ে দেয়া কিংবা ছাড় নেয়া হচ্ছে। এতে ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশ প্রতিযোগিতায় ভারত-চীনের সঙ্গে পেরে উঠছে না। পদ্মা সেতুর কাজের ক্ষেত্রেই এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে কাজের মান নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে।

এ বিষয়ে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় চীন ও ভারত প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার একটি বড় কারণ হলো ব্যয়সাশ্রয়। চীনের কাছে বর্তমানে যে উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে, তারা যে কোনো বড় প্রকল্পে অনায়াসে ঋণ দিতে পারে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সুশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দায়বদ্ধতা থাকার কারণে প্রতিটি ঋণ বা বড় প্রকল্পগুলোয় অর্থায়ন করতে তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে থাকে। কিন্তু চীন, ভারত বা রাশিয়া থেকে অর্থ এলে সরকার তা নিজের ইচ্ছামতো খরচ করতে পারে। ফলে পশ্চিমারা প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না।

সরকারও বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোয় চীন ও ভারতের অর্থায়নকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ও সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশ দুটি থেকে খুব কম খরচে প্রয়োজনীয় পণ্য আনা যায়। চীন ও ভারত থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে আর সবচেয়ে বেশি রফতানি করে পশ্চিমা দেশগুলোয়। এক্ষেত্রে পূর্ব থেকে আমদানি আর পশ্চিমে রফতানি করে বাংলাদেশ সুকৌশলে কূটনৈতিক বাণিজ্যের সুবিধা নিচ্ছে।

জানা গেছে, রেলওয়ের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েও ভারত-চীনের মধ্যে বড় ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। টঙ্গী-ভৈরববাজার ও লাকসাম-চিনকি আস্তানা ডাবল লাইন নির্মাণের কাজ করছে চীন। ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর রেলপথও নির্মাণ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম ডুয়াল গেজ ডাবল লাইনসহ হাইস্পিড ট্রেন, দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম ডুয়াল গেজ রেলপথ ও ময়মনসিংহ-জয়দেবপুর ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। তবে ডলার ক্রেডিট লাইনের (এলওসি) আওতায় দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস রেলসেতু নির্মাণ করছে ভারত। এছাড়া খুলনা-মংলা রেলপথ ও ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন নির্মাণ করতে যাচ্ছে ভারত।

গত কয়েক বছরে রেলওয়ের ইঞ্জিন-কোচ সরবরাহেও ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। এরই মধ্যে দুই ধাপে ২৬টি ব্রড গেজ ইঞ্জিন সরবরাহ করেছে দেশটি। আর ১২০টি ব্রড গেজ কোচ সরবরাহে চুক্তি হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এছাড়া ১৬৫টি ব্রড গেজ ও ৮১টি মিটার গেজ তেলবাহী ট্যাংকার ও ২২০টি পণ্যবাহী ওয়াগন এলওসির আওতায় সরবরাহ করেছে ভারত। তবে ২০ সেট ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডেমু) ২০১৩ সালে সরবরাহ করে চীন। এছাড়া সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে ২০০ কোচ সরবরাহেও আগ্রহী দেশটি।

এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস সরবরাহ নিয়েও দুই দেশের প্রতিযোগিতা রয়েছে। ২০১১ সালে বিআরটিসিকে ২৭৫টি বাস সরবরাহ করে চীন। কিন্তু পরে বিআরটিসির বাজার দখল করে নেয় ভারত। এলওসির আওতায় ২৯০টি দ্বিতল, ৮৮টি এসি একতলা ও ৫০টি আর্টিকুলেটেড (দুই বগির জোড়া লাগানো) বাস সরবরাহ করে দেশটি। তবে বসে নেই চীনও। বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আবার ২০০ দ্বিতল ও ১০০ আর্টিকুলেটেড বাস এবং ৫০০ ট্রাক সরবরাহ করতে চাচ্ছে দেশটি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হলে যে দেশই কাজ পাবে, তার গুণগত মান ভালো হবে। এক্ষেত্রে বায়ার্স ক্রেডিট বা এলওসির মতো একক দেশনির্ভর ঋণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। তাতে সুশাসন নিশ্চিত করা যায়। তাই বাংলাদেশের উচিত এ বিষয়গুলোয় গুরুত্ব দেয়া।