CPD study on Bangladesh’s business competitiveness cited

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রকাশিত এক জরিপে অংশ নেওয়া ৬২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নেই। আগের বছরের জরিপে ব্যবসায়ীরা দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বিদ্যমান বলে মত দিয়েছিলেন।

Published in The Daily Inquilab on Wednesday, 4 November 2015.

ব্যবসায় ভাটা নেই নতুন বিনিয়োগ খরায় ব্যাংক খাত

হাসান সোহেল

দীর্ঘদিন থেকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার পর আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ পাচ্ছে না ব্যবসায়ীরা। দুই বিদেশী হত্যাকা-ের পর এবার দিনে-দুপুরে পুস্তক ব্যবসায়ী হত্যায় দেশে ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে আরো শঙ্কায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এমনিতেই পুঁজিবাজার ধুঁকছে। আবাসন, সিমেন্ট, স্টিল, আসবাবপত্র, তেল-চিনির পরিশোধনাগার, কাগজ, সিরামিক, পাট-দেশীয় বাজারনির্ভর এসব প্রধান খাতের বিনিয়োগকারীরা বিপাকে আছেন। ফলে মন্দার বাজারে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন না ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ব্যাংক ঋণেও আগ্রহ নেই বিনিয়োগকারীদের। ব্যাংকগুলোর ব্যবসায় যাচ্ছে দুর্দিন।

র সত্যতাও মিলেছে, সর্বশেষ বিশ্ব ব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস জরিপেও। ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশে গত বছরের চেয়ে ২ ধাপ নিচে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের একই সময় পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কমেছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রবাহ। সামগ্রিক ঋণ চাহিদায় চলছে খরা। শিল্প কারখানার চলমান কার্যক্রম ছাড়া নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য ঋণের চাহিদা নেই বলেও জানা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ বছরের প্রথমার্ধের জন্য ঋণ প্রবাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে ব্যাংকগুলো সঠিক পথে নেই। নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য ব্যাংক ঋণের চাহিদা নেই বললেই চলে। সূত্র মতে, নতুন ঋণের চাহিদা কম। যা চাহিদা আছে সেগুলো চলমান শিল্প কারখানার সম্প্রসারণের জন্য। তাই পুরনো ঋণকে নিয়মিত করে আগাচ্ছে ব্যাংকগুলো। আর এভাবেই ব্যাংকগুলো মুনাফার পাশাপাশি ঋণ নিয়মিত করছে। যদিও এতে ব্যাংকগুলোর ঋণের গুণমান ঠিক থাকছে না। তারপরও নতুন বিনিয়োগকারী না আসায় এ পথেই হাঁটতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।

তবে জুন ও জুলাইয়ে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল। জুন মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ আর জুলাইয়ে ছিল ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।সূত্র মতে, আগস্টের শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৫ হাজার ৯৩ কোটি টাকা বেশি। যদিও এ স্থিতির পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।ঋণ চাহিদায় এমন অবস্থার জন্য ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা নানা বাধার কথা বললেও নতুন কারখানায় গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়া এবং ঋণের চড়া সুদ হারকেই প্রধান বাধা হিসেবে দেখাচ্ছেন। এর মধ্যে সামনে প্রকটভাবে এসেছে, সরকারের গ্যাস পরিস্থিতি নিয়ে দেয়া বক্তব্য।ব্যবসায়ীদের মতে, তাদের মধ্যে এখন আস্থার সংকট প্রবল। রাজনীতি কোন দিকে যাবে তা অনিশ্চিত।

আবার বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে কি না সে নিশ্চয়তাও নেই। সরকারের একটি সংস্থা এ ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দিলেও অন্য সংস্থার প্রশ্ন করার সুযোগ থাকছে। তাই এ অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ না করে টাকা বিদেশে নেওয়াই সহজ মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ থেকে যে টাকার পাচার বাড়ছে, তা বিনিয়োগে জটিলতার কারণে ঘটছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সূত্র মতে, শুধু অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগই নয়, দেশি বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন আইনি জটিলতায় বেঁধে রাখা হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ওঁৎ পেতে থাকে দেশি বিনিয়োগকারীদের ধরার জন্য।২০০২ সালে চালু হওয়া মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে দুই হাজার ৯৩৩ জন বাংলাদেশি অংশ নিয়ে সে দেশে কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। গত বছর সুইস ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশিদের তিন হাজার ২৩৬ কোটি টাকা গচ্ছিত আছে।

অন্যদিকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে ৮০ কোটি ডলার বা ছয় হাজার ২৪০ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। দেশে বিনিয়োগে জটিলতার কারণেই অর্থ পাচার বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।ব্যবসায়ীরা জানান, ব্যবসা শুরু করতে গেলে পদে পদে ভোগান্তি জোটে। জমি, ঋণ ও নিবন্ধন কোনোটাই সহজে সম্ভব নয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তো আছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যস্বত্বভোগীরা অনিয়মকেই যেন নিয়ম করে ফেলেছে। ডিজিটালাইজেশন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা অনিয়ম কমাতে পারে বলে মত দেন তারা। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদের হার ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন তারা।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রকাশিত এক জরিপে অংশ নেওয়া ৬২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নেই। আগের বছরের জরিপে ব্যবসায়ীরা দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বিদ্যমান বলে মত দিয়েছিলেন।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)’র সভাপতি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, বর্তমানে মোট ঋণের চাহিদা কম। যা চাহিদা আছে সেগুলো চলমান শিল্প কারখানার সম্প্রসারণের জন্য।

নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য ঋণের চাহিদা নেই বললেই চলে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কারখানাগুলো গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় চালু হচ্ছে না। যে কারণে অন্যরাও নতুন প্রকল্পে যেতে পারছেন না। আবার ডিমান্ড নোট ইস্যু হয়েছে এমন অনেক কারখানায় ব্যাংক ঋণ দিয়েছে, কিন্তু সংযোগ না পাওয়ায় ঋণের টাকা আটকে আছে। তথ্য মতে, বর্তমানে বেসরকারি খাতে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণ স্থিতি আছে। সূত্র মতে, এক সপ্তাহেরও কম সময়ের ব্যবধানে দুই বিদেশী নাগরিক খুন হওয়ায় তৈরি পোশাকের বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের আতংক বিরাজমান ছিলো। এ কারণে তারা বাংলাদেশ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন।

ইতোমধ্যে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সংগঠন বায়ার্স ফোরামের সঙ্গে পোশাক শিল্পমালিকদের একাধিক বৈঠক স্থগিত হয়ে গেছে। এতে আগামী মৌসুমের পোশাক তৈরির কার্যাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে শিল্পমালিকরা আশংকা প্রকাশ করেন। তারপর আবার নতুন করে পুস্তক ব্যবসায়ী হত্যায় এটা আরো ঘনীভূত হলো। তাই বিনিয়োগকারীরা নতুন করে আর ব্যাংক ঋণে ঝুঁকছেন না। বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত ডুয়িং বিজনেস বিষয়ক এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। এতে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান দেখানো হয়েছে ১৭৪। যা গত বছর ছিল ১৭২। ব্যবসার পরিবেশে ১০ সূচকে এই পতন ঘটেছে।সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলছেন, আগামী ১৫ বছর পর দেশে গ্যাসের মজুদ কমতে থাকবে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেছেন, ব্যবসায়ীরা কেন দেশে বিনিয়োগ করবে? গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট কাটছে না। সরকার বলছে ১৫ বছর পর দেশে গ্যাসের মজুদ কমতে থাকবে, এমন পরিস্থিতিতে আমরা কিভাবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে যাবো প্রশ্ন রাখেন তিনি। অবশ্য বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ার পাশাপাশি বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি সতর্ক। এদিকে, এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ বিতরণ কমে যাচ্ছে। কারণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা ব্যবসায়ীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেছেন, বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা এখনো গ্যাসনির্ভর শিল্প করার চিন্তা করে। এ কারণে গ্যাস যখন পাওয়া কঠিন হয়, তখন বিনিয়োগের হারও থমকে দাঁড়ায়। গ্যাস সংযোগের অনিশ্চয়তাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। তিনি বলেন, বিদ্যুতে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু শিল্পে বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। চাইলেই ৩-৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না।

উদ্যোক্তারা সহজে মূলধন পেলে বিনিয়োগও বাড়ে। কিন্তু এ দেশে ঋণপ্রাপ্তি যেমন কঠিন, তেমনি সুদের হারও চড়া। সম্প্রতি চাহিদা না থাকায় সুদের হার কিছুটা কমলেও এখনো বিনিয়োগের ঋণের জন্য ১৫ শতাংশের কাছাকাছি সুদ দিতে হয়। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি ও বড় ঋণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। চীন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশেই গড় সুদের হার এক অঙ্কের নিচে। দেশি উদ্যোক্তারা বহু চেষ্টা-তদবির করেও সুদের হার এক অঙ্কে আনতে পারেননি। যাঁদের সক্ষমতা আছে, তাঁরা ঋণের জন্য এখন বিদেশী সংস্থায় যাচ্ছেন।

ফজলুল হক বলেন, এ দেশের ব্যাংকগুলো সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছর মেয়াদে ঋণ দেয়। এর ‘গ্রেস পিরিয়ড’ থাকে এক থেকে দেড় বছর। তার মানে এক বছরের মধ্যে কারখানা গড়ে সেখান থেকে মুনাফা এনে ঋণ শোধ করতে হবে। অথচ এক বছরে একটা ছোট কারখানাও নির্মাণ করা যায় না। দেশে শিল্পঋণের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একসময় শিল্পে ঋণ দেওয়ার জন্য শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা ছিল। এখন সেটি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হয়েছে। তারা পুরনো কিছু বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে। নতুন কোনো কার্যক্রম তাদের নেই।