বাংলাদেশের সংগ্রামে আমার অংশগ্রহণ – রেহমান সোবহান

Reminiscing Bangladesh’s struggle towards sovereignty – Rehman Sobhan’s account of Bangladesh’s journey, published in Prothom Alo on Friday, 7 November 2014.

 

বাংলাদেশের সংগ্রামে আমার অংশগ্রহণ

রেহমান সোবহান

rehman-sobhan-prothom-alo-nov-2014

আমি সরকারি নীতির দুর্বলতা এবং এর পরিণতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। আমার লেখাটি নিশ্চিতভাবেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কারণ, তারা অবিলম্বে সেই বইটি তুলে নিয়ে আমার লেখাটি বাদ দিয়ে ড. আবদুল্লাহ ফারুকের একটি ‘ইতিবাচক’ প্রবন্ধ যুক্ত করে বইটি প্রকাশ করে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরে এই বৈষম্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমিসহ আরও কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ি। এর ফলে আমরা সরাসরি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাই।

১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যায্য চরিত্র শুধু অর্থনীতির ছাত্রদের কাছেই পরিষ্কার ছিল না, আমাদের জনজীবনের সব ক্ষেত্রেই তা অনুভূত হতো। সে সময় বাঙালিদের অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও রাজনৈতিক অধীনতা ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কক্ষ পর্যন্ত এসব বিষয়ে আলোচনা হতো। অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমরা বিষয়টির অর্থনৈতিক তাৎপর্য নিয়েই বেশি মাথা ঘামাতাম, তবে সব আলোচনাই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক আচরণের দিকে মোড় নিত।

আমাদের সবার ‘স্যার’ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে জানতে পারতাম। ১৯৬০ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে পাকিস্তান রাষ্ট্র সম্পর্কে আমার সম্যকভাবে জানার সুযোগ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের চালচিত্র বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকস্ট্রাকশনের দায়িত্বে প্রকাশিতব্য একটি বইয়ে আমাকে অর্থনীতি নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল মূলত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের গুণকীর্তন করার জন্য। আমার লেখাটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু আমি সরকারি নীতির দুর্বলতা এবং এর পরিণতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। আমার লেখাটি নিশ্চিতভাবেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কারণ, তারা অবিলম্বে সেই বইটি তুলে নিয়ে আমার লেখাটি বাদ দিয়ে ড. আবদুল্লাহ ফারুকের একটি ‘ইতিবাচক’ প্রবন্ধ যুক্ত করে বইটি প্রকাশ করে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোগত বৈষম্যের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার কারণ নিহিত ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের আকারে পরে তা চিরস্থায়িত্ব পায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের সব ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাতদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এর সমাধান হিসেবে অর্থনীতিবিদেরা প্রস্তাব করেছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নীতি প্রণয়নের বিষয়টি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংবিধানিকভাবে পৃথক করা হোক। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদানের মধ্য দিয়ে যা বাস্তবায়ন করা হবে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রে ক্ষমতার এই পৃথক্রণের ব্যাপারটি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির মধ্যেই ছিল। অর্থনীতিবিদেরা যে এই বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করলেন, এর পেছনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদেরও একটি বড় ভূমিকা ছিল। কারণ, তাঁরা বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে তুলে ধরেছিলেন বলেই অর্থনীতিবিদেরা এ বিষয়ে লেখালেখি করার ভিত্তি পেয়েছিলেন। আর ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করেন, তাও অনেকাংশে ছিল অর্থনৈতিক দাবি। ছয় দফা আসলে বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকদের মধ্যকার সমন্বয়ের ফসল।

১৯৬০-এর দশকে আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে আমি অংশ নিয়েছি। লাহোর ও ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুটি সেমিনারে পাকিস্তানের এই দুই অর্থনীতির ওপর আলোকপাত করে যে প্রবন্ধ আমি পড়ি, তার ফলেই পেশাদার অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করি। লাহোরে ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুই অর্থনীতির তত্ত্বে একটি অঞ্চলের বিশেষ সমস্যা মোকাবিলায় করণীয় হিসেবে আমি পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলাম। পরবর্তীকালে সেই প্রবন্ধটি ঢাকার প্রধান ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-এ প্রকাশিত হয়, এমনকি পত্রিকাটি তাদের শিরোনামও করে এই প্রবন্ধটি উল্লেখ করে। তবে এই ধারণাটি যে শুধু আমার মস্তিষ্কপ্রসূত, ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবী যেমন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ড. সাদেক, অধ্যাপক এম এন হুদা, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক আখলাকুর রহমান, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক আবু মাহমুদ, ড. হাবিবুর রহমানসহ অন্যরাও এতে অবদান রেখেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরে এই বৈষম্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমিসহ আরও কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ি। এর ফলে আমরা সরাসরি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাই। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পর্যালোচনার জন্য নুরুল ইসলামসহ আমাকে যখন অর্থনীতিবিদদের প্যানেলে ডাকা হলো, তখন আমরা ইতিমধ্যে একটি রাজনৈতিক সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছি। সেটা নিছক বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলের কোনো ব্যাপার ছিল না।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করলে বঙ্গবন্ধু নুরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, কামাল হোসেন, মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদসহ আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন, তাঁর ও আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করার জন্য। ছয় দফার কয়েকটি দফার বাস্তব রূপায়ণ করতে গিয়ে আমাদের টেকনিক্যাল আলোচনা করতে হয়েছে: ভিন্ন মুদ্রা প্রচলন, বাণিজ্য ও অনুদানের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি।

সেখানে এমন কিছু ক্ষেত্র ছিল, যেখানে অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনীতির বাস্তবতা ও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মেলবন্ধন ঘটাতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সহযোগী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন রাজনৈতিকভাবে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রখর। তাঁদের সঙ্গে বসে আমরা প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারি রাজনৈতিক-অর্থনীতি বাস্তবে আসলে কী জিনিস। ১৯৬৯ সালে আমি, কামাল হোসেন ও হামিদা হোসেনের সহযোগিতায় ফোরাম নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনার কাজ শুরু করি। আমার এই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও ফোরাম-এ লেখালেখির বিষয়টা পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছিল। বাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু করার দুই দিনের মাথায় ২৭ মার্চ আমাকে ধরতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল আমার বাসায় আসে। সৌভাগ্যক্রমে আমি বাসা থেকে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলাম, তাই তাদের উদ্দেশ্য সফল হতে পারেনি। ২৭ মার্চের পর ১৯৭১ সালের পুরো সময় আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণাকাজে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করেছি। আমার প্রধান কাজই ছিল পাকিস্তানি সরকারের বৈদেশিক সাহায্য সংগ্রহ বন্ধ করার পক্ষে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনসমর্থন আদায় করা। এ কাজ অনেকটাই সফল হয়।

দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণই আমাদের প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ নিয়ে আমার বহু গবেষণায় আমি দারিদ্র্যর কাঠামোগত দিকটিতে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি, যে বিষয়টি তেমন একটা আলোচিত হয় না। দারিদ্র্য ও ন্যায়বিচারের মধ্যে সূত্র খুঁজতে গিয়ে দারিদ্র্যের চিরস্থায়িত্ব ও গরিবের রাজনৈতিক ক্ষমতাহীনতার পেছনে কাঠামোগত অবিচারের ভূমিকা সম্পর্কে আমি সচেতন হয়ে উঠি এবং গবেষণা ও লেখালেখি শুরু করি।

এ বিষয়টিতে আমি বেশ কয়েকবার আলোকপাত করেছি। ‘দুই অর্থনীতি থেকে দুই সমাজ’ শীর্ষক নাজমুল করিম স্মৃতিবক্তৃতা, ‘ব্যাংকিং খাতে ন্যায়বিচার’ শীর্ষক নুরুল মতিন বক্তৃতা ও ‘উন্নয়নে ন্যায়বিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ শীর্ষক মাহবুবুল হক স্মৃতিবক্তৃতায় আমি দারিদ্র্যবিষয়ক আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের আনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছি। এটাকে সম্পদের অপ্রতুলতার ফল হিসেবে না দেখে কাঠামোগত অবিচারের ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করার জন্য আমি আহ্বান জানিয়েছি। রোমে ২০০১ সালের জুলাইয়ে এফএওর ‘ইর্যাডিক্যাটিং রুরাল পোভার্টি: মুভিং ফ্রম এ মাইক্রো টু ম্যাক্রো পলিসি এজেন্ডা’ শীর্ষক বক্তৃতায় আমি এই অবিচারের থিসিস আরও সংহত করে দারিদ্র্য দূরীকরণের কৌশল নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেছি। এর উপায় হিসেবে বলেছি, কাঠমোগত অবিচারের বিষয়টি সংশোধন করে অর্থনৈতিক সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ণ ঘটাতে হবে।

আমার নেতৃত্বে চার বছরব্যাপী সিপিডি-সাসেপস একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করে। এর ফলাফল আমার চ্যালেঞ্জিং দ্য ইনজাস্টিস অব পোভার্টি: এজেন্ডাস ফর ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া বইয়ে প্রকাশিত হয়। এই বইটিতে আমি সম্পদের মালিকানায় ও বাজারের পরিচালনায় গণতন্ত্রায়ণের মাধ্যমে অবিচারের ব্যবস্থায় সংশোধন আনার কথা বলেছি। এতে দক্ষিণ এশিয়ার সুশীল সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে নীতি প্রণয়ন ও কাঠামোগত হস্তক্ষেপের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিচের বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে:

১. উৎপাদনশীল সম্পদের ওপর দরিদ্রদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের প্রসার,

২. জ্ঞানভিত্তিক সমাজে দরিদ্রদেরও অংশগ্রহণ বাড়ানো,

৩. দরিদ্রদের বাজারের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সক্ষমতা বাড়ানো,

৪. সরকারি সম্পদ দরিদ্রদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বাজেটীয় নীতি সংস্কার,

৫. দরিদ্ররা যাতে সামষ্টিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে সম্পদের মালিকানা লাভ করতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ। দরিদ্রদের জন্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যম সৃষ্টি।

অবিচারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আমরা যে কাজটি শুরু করেছি, সেটা কেবল একটি একাডেমিক তৎপরতা নয়। এর লক্ষ্য হলো, সরকারি নীতি ও সুশীল সমাজের সংগঠকদের তাৎপরতায় প্রভাব বিস্তার করা। আমি আশা করি, তরুণ প্রজন্ম এই অবিচার বন্ধের আন্দোলন চালিয়ে যাবে।