প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক পরিবেশে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব? – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক পরিবেশে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত সংকট অর্থনীতিকে যেভাবে পেঁচিয়ে ধরেছে,তা আশঙ্কাজনক। সাধারণভাবে সুস্থ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনীতি-অর্থনীতি একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক কাঠামোয় অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। রাজনীতি-অর্থনীতির পারস্পরিক সম্পর্ক কীভাবে নির্ধারিত হয়, সে সম্পর্কে সাম্প্রতিক কিছু ধারণা জন্মেছে। এ নিবন্ধে সেই সম্পর্কের আলোকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনোত্তর প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক পরিবেশে মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি।

গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক পরিবেশে কাঙ্খিত মাত্রায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে— বাংলাদেশের মতো উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে গণতন্ত্রের ভিত্তিই এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেখানে এ আলোচনা কতটুকু তাত্পর্যপূর্ণ? এক কথায় উত্তর হলো এ ধরনের আলোচনার তাত্পর্য রয়েছে। নব্বই দশক থেকে দেশের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারের শাসন ক্ষমতায় অবস্থান, কম বেশি গণতান্ত্রিক চর্চা বজায় থাকা এবং দু-একটি ছাড়া জাতীয় নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া ইত্যাদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বৃদ্ধিতে, সহায়ক বিনিয়োগ পরিবেশ বজায় রাখতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনোত্তরকালে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশের বিপরীতমুখী অবস্থা সৃষ্টি হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা বর্তমান নিবন্ধের আলোচনার যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে।

গবেষণায় দেখা গেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে পরিচালিত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নিশ্চিত করে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা অর্থনৈতিক নীতি-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা ও জ্ঞান সংযোজন করে,বিকল্প কৌশল সম্পর্কে অবহিত করে,নীতি-পরিকল্পনার দুর্বলতাগুলো ধরিয়ে দেয় এবং সময় সময় যৌথ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়। রাজনৈতিক কার্যক্রমে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ সহজতর হলে জনগণের যৌক্তিক দাবিগুলো সম্মিলিতভাবে জোরালো আকারে উঠে আসে। শাসন ক্ষমতায় অবস্থানকারী রাজনৈতিক দলের পক্ষে সেসব দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে সঠিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর হয়।

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিনিয়ত জনগণের মুখোমুখি হতে হয়। এতে জনপ্রতিনিধিরা চাপের মধ্যে থাকেন। এ ধরনের চাপের কারণে অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিরা একধরনের দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়েন। সার্বিকভাবে একটি দেশে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কল্যাণকর অর্থনীতি-রাজনীতির ধনাত্মক মিথষ্ক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এতে অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নে অদক্ষতা কমে দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হয়।

অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক পরিবেশে জনগণের চাওয়া-পাওয়া মূল্যহীন হয়ে পড়ে। জনগণের গণতান্ত্রিক দাবি অর্থনৈতিক নীতি কাঠামোয় ক্রমশ অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। এর চেয়ে বড় হলো জরুরি অর্থনৈতিক প্রয়োজনে সরকারে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কম প্রতিক্রিয়া দেখায় অথবা পর্যাপ্ত মাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়। নব্য গণতান্ত্রিক দেশে এ সময়কালে রাজনীতি-অর্থনীতির মধ্যকার সম্পর্ক তৈরির সুযোগই সৃষ্টি হয় না। অপেক্ষাকৃত অগ্রসরমান গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি ও অর্থনীতির যতটুকু সম্পর্ক মিথষ্ক্রিয়া সৃষ্টি হয়,তা ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়,একপেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে রাজনীতি-অর্থনীতির মধ্যকার সম্পর্ক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে; অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ শ্লথ হয়ে পড়ে; উন্নয়ন কার্যক্রম গতিহীন হয়ে পড়ে। ফলে প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর হয়ে পড়ে; ফলশ্রুতিতে কোনো কোনো দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে রাজনৈতিক সরকারের দায়বদ্ধতা থাকে না। এ পরিস্থিতিতে সরকারের অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নে জনগণের সমর্থন থাকে না।

রাজনীতি-অর্থনীতির মধ্যকার উপরোক্ত সম্পর্ক বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে,নিকট ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির সঙ্গে এমনকি আরো দূরবর্তী ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখার সুযোগ রয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনোত্তরকালে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে— সে পরিস্থিতিতে মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব রাজনৈতিক দলের সমান অংশগ্রহণ এবং জনগনের অংশগ্রহণ অনেকাংশেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ফলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে ন্যূনতম পরিবেশ বজায় রাখা প্রয়োজন ছিল,তা বর্তমানে নেই। ফলশ্রুতিতে রাজনীতি-অর্থনীতির প্রত্যাশিত ধনাত্মক মিথষ্ক্রিয়া এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে তার প্রভাব এখনো বহুলাংশে অনুপস্থিত। অবশ্য কাম্য পরিস্থিতি না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামুখর ন্যূনতম যে রাজনৈতিক পরিবেশ নির্বাচনকালে নিশ্চিত ছিল— এবারের সংসদ নির্বাচনে তাও অবশিষ্ট রইল না। ফলে দেশের অর্থনীতি আগামী দিনে নির্দেশিত হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতর অবস্থিত সরকারের মাধ্যমে।

এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী বছরগুলোয় দেশে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতিমালা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাস্তবায়ন মোটেই সহজসাধ্য হবে না। কারণ,জনগণের অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন কাঠামো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রতিফলিত হবে না। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কার্যক্রম চালানো,দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো ধরে রাখা,ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের চাহিদার নিরিখে কার্যক্রম গ্রহণ ইত্যাদি অনুপস্থিত থাকতে পারে। ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বাভাবিক গতিধারা হারিয়ে যেতে পারে।

এ ধরনের রাজনৈতিক সরকার কাঠামো দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক কাঠামোর চেয়ে দায় সৃষ্টি করতে পারে। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ সম্ভব নাও হতে পারে;বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যে পরিমাণ অর্থের জোগান প্রয়োজন হবে তা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা কষ্টকর হবে। বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া ও এর সদ্ব্যবহার করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এসব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এ ধরনের সরকারের পক্ষে মোকাবেলা করা দুরূহ। সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুপস্থিতিতে রাজনীতি-অর্থনীতির ধনাত্মক মিথষ্ক্রিয়া সৃষ্টির প্রক্রিয়া পিছিয়ে যেতে পারে। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

লেখক: অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)