অভিযানে বাজার ঠিক করা যাবে না – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in দেশ রুপান্তর on 17 September 2023

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান। মূল্যস্ফীতির মধ্যে দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রথমবারের মতো সরকার কর্তৃক কয়েকটি পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়াসহ নানা বিষয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী

 

 

দেশ রূপান্তর: প্রথমবারের মতো ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিল সরকার। এর আগে সরকার নির্ধারিত মূল্যতালিকা টানিয়ে রাখার নির্দেশসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা সম্ভব হয়নি।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: সরকারের এই উদ্যোগের মধ্যে হয়তো একটা ভালো কিছু করার আকাক্সক্ষা থাকতে পারে। কিন্তু এটার বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কারণ রিটেইল বা খুচরা পর্যায়ে যদি এটা বাস্তবায়ন করতে হয় তাহলে সেটা খুবই কঠিন। দেশে লাখ লাখ রিটেইল পয়েন্ট আছে। সেখানে এটা কার্যকর করা খুবই মুশকিল। আমার মনে হয় আমদানি এবং উৎপাদন স্তর থেকে খুচরা পর্যায় হয়ে ভোক্তা পর্যন্ত আসতে আসতে দেখা যাচ্ছে বাজারকে প্রভাবিত করার এক ধরনের মেকানিজম দাঁড়িয়ে গেছে। সেখানে এক রকম একচেটিয়াকরণ হচ্ছে। আসলে ওই জায়গাগুলোতে বেশি নজর দিতে হবে। রিটেইল লেভেলে নজর দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের মতো সেই সক্ষমতা সরকারের নেই। মানে প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায়, আনাচে কানাচে বিভিন্ন পয়েন্টে খুচরা পর্যায়ে বেচাকেনা হয়, সেটা কি নজরদারি করা সম্ভব? প্রথমত, হোলসেল এবং আমদানি স্তর থেকে রিটেইল লেভেল পর্যন্ত বাজারকে অযৌক্তিকভাবে প্রভাবান্বিত করা হচ্ছে কিনা? দ্বিতীয়ত, সমস্যা তো আসলে একদিনে সৃষ্টি হয়নি, সমাধানও এক সিদ্ধান্তেই হবে না। আমাদের আসলে উৎপাদন কত, সরবরাহ কত, ঘাটতি কত, আমদানি কখন করতে হবে, কখন আমদানিকে উৎসাহিত করতে হবে, স্টক কত রাখতে হবে এ বিষয়গুলোতে গবেষণাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপার আছে। এই জায়গাতেই আমাদের আসল সমস্যা রয়েছে বলে আমার মনে হয়।

দেশ রূপান্তর: বাজার ব্যবস্থাপনায় এই দাম বেঁধে দেওয়ায় কি প্রভাব পড়বে?

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা তো দুর্বল এবং আমাদের ভোক্তা অধিকার বলি আর কম্পিটিশন কমিশন বলি, খুবই রিয়েক্টিভ। কিছু একটা হলো, তখন তারা যায় অভিযানে। যেমন ভোজ্যতেল বা পেঁয়াজ এসব ক্ষেত্রে দেখা গেল, তারপর পোলট্রি ফার্ম নিয়ে দেখলাম কম্পিটিশন কমিশন অনুসন্ধানে নামল। যখন কোনো একটা সমস্যা হাজির হয় তখন এসব তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু এগুলোকে একটা সার্বক্ষণিক তথ্য-উপাত্তভিত্তিক নজরদারির মধ্যে রাখার ক্ষেত্রে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। মূল সমস্যা মনে হয়, যখন কিছু একটা হয় তখন আমরা স্বল্পমেয়াদে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তো আসলে ধারাবাহিক এবং সার্বক্ষণিক নজরদারির একটা ব্যাপার আছে। সেখানে যেটা বললাম আর কী, তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সেই অনুযায়ী আমদানিটা কখন করতে হবে, স্টক কখন ছাড়তে হবে এসব বিবেচনা নিতে সার্বক্ষণিক লেগে থাকার একটা ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু যখন কিছু হয় বা ঘটে যায় তখন তার রিয়েক্ট করে আমরা একটা সিদ্ধান্ত চাপানোর চেষ্টা করি। এটা ফলপ্রসূ হবে না।

দেশ রূপান্তর: খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বিবিএসের হিসাবে, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু মূল্যস্ফীতি আরও বেশি বলে অনেকে বলছেন। আপনার পর্যবেক্ষণে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কী পর্যায়ে আছে?

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আমরা তো এ ধরনের তথ্য-উপাত্তের জন্য বিবিএসের ওপরই নির্ভর করি। কারণ এত বিস্তৃতভাবে আর কেউ করেও না। সুতরাং এটাকেই আমরা মেনে নিতে পারি। আর এটা তো কোনো ভালো চিত্র নয়, যেখানে বৈশ্বিক পর্যায়ে সব দেশেই মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশেই এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে মনে রাখতে হবে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মান ও ক্রয়ক্ষমতার সরাসরি একটা সংযোগ আছে। সুতরাং এই সাড়ে ১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যদি আমরা ধরেও নেই, তাহলে সেটা একটা নৈরাশ্যজনক চিত্র। একই সঙ্গে এই সাড়ে ১২ শতাংশ যে মূল্যস্ফীতি, এটা তো হলো গড় হিসাব। কিন্তু যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের জন্য যে মূল্যসূচক সেখানে কিন্তু অন্য চিত্র দেখা যাবে। যেমন চালের দামের গুরুত্বটা অনেক বেশি। নিম্ন আয়ের মানুষ যেগুলো ভোগ করেন, সেসব পণ্য যদি আমরা দেখি তাহলে কিন্তু মূল্যস্ফীতির হিসাব আরও বাড়বে। বিবিএসের যে প্রাইস ইনডেক্স বা ভোক্তা মূল্যসূচক সেখানে চালের গুরুত্ব হলো ২০ শতাংশ। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের যে কনজাম্পশন, ভোগ্যপণ্যের যে বাস্কেট সেখানে চালের গুরুত্ব এই ২০ শতাংশ থেকে অনেক বেশি।

দেশ রূপান্তর: খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে গ্রামীণ এলাকায়। সেখানে এর পরিমাণ ১২.৭১ শতাংশ। গত জুলাইতে এটি ছিল ৯.৮২ শতাংশ। এর কারণ কি আপনি যেটা বললেন নিম্ন আয়?

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: হ্যাঁ। কিন্তু আমি বলছি নিম্ন আয়ের মানুষ, সেটা তিনি শহরের হোক বা গ্রামের। বিবিএসের সূচকের যে কাঠামো, যেমন চালের কথা বললাম, ২০ শতাংশ গুরুত্ব। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের ভোগ্যপণ্যের যে ব্যয়, সেখানে তার মোট ব্যয়ে চালের গুরুত্ব ৪০ থেকে ৩৫ শতাংশ। সেভাবে যদি আমি হিসাব করি তাহলে যে মূল্যস্ফীতির গড় সেটা কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন হবে। অনেক ক্ষেত্রেই সেটা আরও অনেক বেশি হবে। তবে এই প্রেক্ষিতে তৃতীয়ত যেটা আমি বলতে চাচ্ছি, আমরা যদি দেখি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। সুতরাং মূল্যের স্তরটা কিন্তু ওপরে উঠে গেছে এবং এর ওপর ভিত্তি করে আমরা এখন মূল্যস্ফীতি হিসাব করছি। অর্থনীতিতে যেটাকে বলে বেজ ইফেক্ট। তো সেই বেজ ইফেক্টটা কিন্তু থেকে যাবে। আগামী সাত-আট মাসে মূল্যস্ফীতিটা যদি সাড়ে ১২ থেকে কমে আট শতাংশে নেমে আসে তাহলে আমরা হয়তো বলতে পারব যে, মূল্যস্ফীতি কমেছে, সেটা ওপরের একটা জায়গা থেকে হবে। ধরেন ১০০ টাকারটা ১১২ টাকা হয়েছে। তারপর মূল্যস্ফীতি যদি কমে আট শতাংশ হয় তাহলেও ওই ১১২ টাকারটা হবে তখন ১১৭ টাকা। তার মানে কি ১০০ টাকারটা হলো ১১৭ টাকা। তো এখন যদি আমি বলি যে মূল্যস্ফীতি কমেছে কিন্তু সেটা তো স্বস্তিকর না, কারণ ইতিমধ্যে মূল্য বেশ উপরের স্তরে আছে এবং সেখানে হয়তো মূল্য বাড়ার হারটা কমেছে। দাম কমছে না, বৃদ্ধির হারটা কমছে।

দেশ রূপান্তর: চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। তবে উল্টোচিত্র বাংলাদেশে। কেন?

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: এটা একটা বড় প্রশ্ন। আমাদের আশপাশের দেশগুলোতেও কমেছে। এখানে শ্রীলঙ্কার কথা বাদ দিলেও, মানে সেখানে তো ৬০ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতি চলে গিয়েছিল, পরে তারা সেটা কমিয়ে নিয়ে এসেছে। আমরা বিশ্ববাজারে দেখি, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরুর পর জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত মূল্য বাড়ার একটা প্রবণতা ছিল। তারপর আমরা চিনি, ফুয়েলের মতো দু-একটি পণ্য ছাড়া বাকি সবগুলোরই মূল্য কমেছে। মানে আমাদের আমদানিকৃত পণ্যগুলোর দাম কমার কথা। কিন্তু সেটা হয়নি। আমাদের স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রেও তাই। দেখা যাচ্ছে আমাদের উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত উভয় পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতাটি রয়েই গেছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে মনে হয়। এর মধ্যে কয়েকটা আছে সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আর কয়েকটা রয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এটা একটা বড় কারণ। উৎপাদন এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে যেতে যে হাতবদলটা হয় সেখানে আমরা দেখছি যে, কিছু মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে এই বাজারটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সেখানে সরকারের কিছু কিছু সংস্থা মাঝে মাঝে চেষ্টা করছে। যেমন ভোক্তা অধিকারের কথা প্রথমেই বলেছি।

দেশ রূপান্তর: ভোক্তা অধিকার এখন ডাব বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে, খুচরা বিক্রেতার ভ্যানে রেইড দিচ্ছে। এর আগে দেখলাম ভোজ্যতেল বা পেঁয়াজের ক্ষেত্রে, তারপর ডিম…, এর পেছনে বাজার ঠিক রাখার চেয়ে কি ট্রেন্ডের দিকে ছোটার প্রবণতা রয়েছে?

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: বিভিন্ন সময়ে তারা রেইড দিচ্ছে, সিচুয়েশন তৈরি হলে অভিযান চালাচ্ছে। এখন অভিযান চালিয়ে তো আর বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করা যাবে না। রেইড বা অভিযান এক জিনিস আর বাজার ব্যবস্থাপনা আরেক জিনিস। এ দুটো একদমই আলাদা। একটা আইনি প্রয়োগ থাকতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে নজরদারি, খবরদারি করবে সেটা একটা। কিন্তু আমাদের কম্পিটিশন কমিশন বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ধারাবাহিকভাবে এগুলোকে পর্যবেক্ষণে রাখা এবং কোনটা যৌক্তিক, কোনটা অযৌক্তিক সেটা বের করে সে অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা করার যে জায়গাটা থাকার কথা সেটা কিন্তু আমরা দেখছি না। আগেই বলেছি আমাদের তথ্য-উপাত্তের বড় ধরনের অভাব আছে। আর কম্পিটিশন কমিশন যে আছে, সেটা তো আমাদের আগে নজরেই আসেনি। সম্প্রতি দেখলাম যে ডিমের বাজার নিয়ে তারা একটু চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। এসব কমিশন, সংস্থার কাজ কিন্তু অভিযান করা না। তাদের কাজ হচ্ছে এখানে মূল্য কতটা যৌক্তিক আছে সেটা দেখা এবং অযৌক্তিক মূল্য থাকলে, সিন্ডিকেট থাকলে অবশ্যই সেখানে তারা হস্তক্ষেপ করবে। এখানে আরেকটা বিষয় হলো, কোনটা অযৌক্তিক অভিযান আর কোনটা যুক্তিসংগত সেটা বোঝা যায় না। কারণ, তথ্য-উপাত্ত আমরা পাই না।

দেশ রূপান্তর: সিন্ডিকেটের বিষয়টা তো ওপেনসিক্রেট। সর্বোচ্চ মহলে এ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আসছে না, এটা কি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে?

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আমার মনে হয়, এখানে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দায়ী। অবশ্যই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক উদ্যোগ ও উদ্যমের অভাব রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বগুলো পালন করার প্রায়োগিক সক্ষমতাও দুর্বল। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বড় একটা কারণ। এই বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যে কিন্তু তথ্য-উপাত্ত, গবেষণা করে সমস্যা ও সমাধান বের করার বিষয় রয়েছে। ভারতে অ্যাগ্রিকালচারাল কমোডিটির জন্য পারমানেন্ট প্রাইস কমিশন আছে, কারণ খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি খুবই সেনসিটিভ, সরবরাহ থাকলেই হবে না, ক্রয়ক্ষমতারও ব্যাপার আছে।

দেশ রূপান্তর: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আপনাকে ও দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।