অর্থনীতিতে পহেলা বৈশাখের ইতিবাচক প্রভাব – ড. মোয়াজ্জেম

Published in ভোরের কাগজ on Saturday, 14 April 2018

অর্থনীতিতে বৈশাখী হাওয়া

ঋতুচক্রে সমাগত নয়া ঋতু গ্রীষ্ম। আর শুধু নতুন ঋতুই নয়, এর মাঝেই লুকিয়ে আছে নতুন বাংলা বছরের আগমনী বার্তা। বাংলা বর্ষপঞ্জির নতুন মাসের প্রথম তারিখ পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণে বাঙালির রয়েছে অন্তহীন আনন্দ-উচ্ছাস। আর এ বর্ষবরণকে ঘিরে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই জমজমাট প্রস্তুতি চলছে। যার বড় অংশ ঘিরেই রয়েছে অর্থনীতি। আর তাই এবারের পহেলা বৈশাখ ঘিরে ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী থাকলেও উৎসবের দিনে মানুষ হয়ে উঠে বৃহৎ এবং মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব মহৎ। হয়ত বৃহৎ ও মহৎ হওয়ার ইচ্ছায় আমাদের দেশে উৎসবে শামিল হওয়ার আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। রাজধানীসহ সারা দেশের নগরীর বিপণিবিতান, মার্কেট শপিংমল থেকে শুরু করে ফুটপাথে ছেয়ে গেছে বৈশাখী সামগ্রী ও রকমারি পোশাকে। বৈশাখ উপলক্ষে দেয়া হচ্ছে আকর্ষণীয় সব অফার। বসে নেই খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ীরাও। অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে ইলিশের দাম এখন আকাশচুম্বী। বাংলার এই উৎসবকে ঘিরে অন্য সময়ের চেয়ে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উঠানোর পরিমাণও বেড়েছে। গত দুই বছর থেকেই বৈশাখী অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে নববর্ষের বোনাস। মার্চের বেতনের সঙ্গে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার উৎসবভাতা পেয়েছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। এ বোনাসের কয়েকশ’ কোটি টাকা এবার আসবে বৈশাখের বাজারে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের কাছ থেকে পাওয়া হিসাবে- এবারের পহেলা বৈশাখ ঘিরে ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকা বাণিজ্য হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন বলেন, চলতি বছর বৈশাখী ব্যবসা অনেক ভালো যাচ্ছে। এ বছর সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে আশা করেন তিনি। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পয়লা বৈশাখ ‘বাংলা নববর্ষ’ উদযাপনের স্বতঃস্ফ‚র্ততা নগর পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামেও। এ উৎসব ঘিরে পাখা মেলছে নানামুখী বাণিজ্যও। বাংলা নববর্ষ বরণ করতে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে পার্ক-উদ্যান, পাড়া-মহল্লায় ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের। শহরের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে বৈশাখী তাঁতবস্ত্র মেলা।

পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে কেনাকাটা, হালখাতার প্রস্তুতি, মেলা আর মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বর্ষবরণের প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে। পাইকারি দোকানগুলোতে চলছে শেষ মুহূর্তের বেচাকেনা।

তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এবার শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাকই বিক্রি হবে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার। এর সঙ্গে চুড়ি, মালা, দুল, মাটির তৈরি পণ্য, কুটিরশিল্পসহ নানা পণ্য বিক্রির টার্গেটও ছাড়িয়ে যাবে। ফ্যাশন হাউসের উদ্যোক্তারা জানান, সারাবছর তাদের যে ব্যবসা হয় তার অর্ধেকই হয় রোজার ঈদে। পহেলা বৈশাখে হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। আর বাকিটা সারাবছর।

এ প্রসঙ্গে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ভোরের কাগজকে বলেন, পহেলা বৈশাখ এখন দেশের বাইরেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। অর্থনীতির জন্য এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। এতে দেশে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। তিনি আরো বলেন, গত দুই বছরের মতো এবারো সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা বোনাস পেয়েছেন। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। সামগ্রিকভাবে এ বিষয়টি সরকারের ইতিবাচক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তবে এটা ধারাবাহিকতা লাভ করলে বেসরকারিভাবে চাপ পড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বৈশাখী অর্থনীতির বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রামীণ মেলা ও গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পণ্য যত বেশি বিক্রি হবে, ততই গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।

পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া এখন আর নাগরিক মধ্যবিত্তের রীতি নয়। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও পান্তা-ইলিশকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়েছেন। তাই এখন বৈশাখ ঘনিয়ে এলেই বাজারে ইলিশের দাম বাড়তে থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা গড়ে তোলে অবৈধ ইলিশের মজুদ। উৎসবকে ঘিরে এ অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

নানা আয়োজনে সাজানো পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ পোশাক। কেরানীগঞ্জ, ইসলামপুর, নবাবপুরসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি মার্কেটে এক মাস আগে থেকেই বৈশাখের পোশাক কেনাকাটা শুরু হয়েছে। সারাদেশের অর্ধেক বৈশাখী পোশাক তৈরি হয় কেরানীগঞ্জে। কেরানীগঞ্জের আলম মার্কেটের ব্যবসায়ী ওসমান গণি বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটসহ জেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাইকাররা এখান থেকে বিভিন্ন ডিজাইনের বৈশাখী পোশাক নিয়ে যাচ্ছে। ইসলামপুরের আলম বলেন, পাইকারি বাজার হওয়ায় আমরা আগে বেচা-কেনা শুরু করি, যাতে খুচরা বিক্রেতারা কিনে নিয়ে সময়মতো বিক্রি করতে পারে। প্রতিদিন কেরানীগঞ্জের একেকটি দোকানে দুই লাখ থেকে পাঁচ-সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পাইকারি বাজার হলেও অনেকে এখানে খুচরা বিক্রি করেন। খুচরা বিক্রির জন্য এই এলাকার টং আকারের ফুটের দোকানগুলো বেশি জনপ্রিয়।

রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেট, নিউমার্কেট, গাউছিয়া, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, গুলশান, মিরপুর-উত্তরাসহ বিভিন্ন মার্কেটে ও শপিংমলগুলোতে দেদার বিক্রি হচ্ছে বৈশাখের এসব পোশাক। মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, বৈশাখের কেনাকাটায় তরুণ-তরুণী ও নারী ক্রেতাদের সংখ্যাই বেশি। মিরপুর বেনারসি পল্লীর ব্যবসায়ীদের কয়েকদিন ধরেই বেচাকেনা জমে উঠেছে। এখন গড়ে প্রতিদিন তাদের এক শ’র বেশি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে।

ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পহেলা বৈশাখের উৎসব সফল করতে মৃৎশিল্পের বিশেষ কারুকাজ, সরা আঁকা, মিছরির মিষ্টি বানানো, খৈ তৈরি, কাপড় বোনা ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজ উৎসবমুখর পরিবেশে চলছে।

বৈশাখ ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানের ফুল ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চাঙ্গা হয়। প্রতিদিন রাজধানীতে পাইকারি বাজারে ৩০-৩৫ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। সেই হিসাবে বৈশাখ ঘিরে ৬০-৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট করেছে ফুল ব্যবসায়ী সমিতি।