শ্রম ইস্যুতে নতুন চ্যালেঞ্জ এলে অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in কালের কন্ঠ on 22 November 2023

নিয়ম মানলে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম নীতিতে সমস্যা হবে না

শ্রমিক নেতারা বলছেন নির্যাতনে জটিলতা বাড়বে 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ১৬ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে শ্রমিক অধিকারবিষয়ক একটি স্মারকে সই করেছেন। এটি এমন সময় ঘটেছে যখন যুক্তরাষ্ট্রে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন বা অ্যাপেক সম্মেলন এবং বাংলাদেশে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। সম্মেলন চলাকালে নতুন নীতির বিষয়ে বিভিন্ন দেশের শ্রমিক নেতাদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। নতুন নীতিতে শ্রমিক অধিকার হরণ, ভয়ভীতি ও নির্যাতনে জড়িতদের বিরুদ্ধে বাণিজ্য ও ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৈরি পোশাক খাত আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন মেনেই শ্রমিক অধিকার ও রপ্তানি নীতি বাস্তবায়ন করছে। ফলে নিয়ম মানলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতিতে সমস্যা হবে না। অন্যদিকে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বলছেন, শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে সরকার দমন-পীড়নের যে নীতি অবলম্বন করছে, তাতে জটিলতা বাড়বে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্বিক প্রেক্ষাপটে উদ্যোক্তাদের দক্ষতার বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রের যে কাজ, সেটি করা হয়নি। ফলে পর্যাপ্ত মজুরি বৃদ্ধি, শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় না আনা এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে উদ্বেগের কারণ রয়েছে।

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতির বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মহলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। সেখানে দেশের শ্রম পরিস্থিতি, শ্রমিক আন্দোলন, ন্যূনতম মজুরির ও ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের কোটা বা জিএসপি সুবিধা না থাকায় নতুন নীতি তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন অনেকে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য হয়েছে বিষয়টি এমনটি নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য রয়েছে। সেজন্য আমরা আন্তর্জাতিক যে কোনো নীতিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যে জন্য শ্রমিক অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার গত ১০ বছরে তিনবার শ্রম আইন সংশোধন করেছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন ও আইএলও নীতি মেনেই আমরা কারখানা ও শ্রম পরিবেশ নিশ্চিত করে ব্যবসা করছি। প্রতিনিয়তই শ্রমিক সুরক্ষার বিষয়ে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছি। পাশাপাশি কলকারখানা বিষয়ে অভ্যন্তরীণভাবে যতগুলো বিধি-বিধান রয়েছে, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য সদস্য (বিজিএমইএ) কারখানা মালিকদের নিয়মিত নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিষয়ে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক আগ থেকেই আমাদের কোটা সুবিধা নেই। জিএসপি বিষয়েও আমাদের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। অনেক আফ্রিকার দেশ রয়েছে, যাদের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে বলে আমরা শুনছি; কিন্তু সেসব দেশকে কোটা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তারের নাম উঠে আসার বিষয়ে ফারুক হাসান বলেন, কল্পনা আক্তারের বিষয়টি যতটুকু মনে পড়ে—২০১৫ সালের বিষয়। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এর পর অনেক সময় চলে গেছে এবং আমরা অনেক উন্নতি করেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর কালবেলাকে বলেন, যখন নিজস্বতার ঘাটতি থাকে, তখন বিদেশি শক্তি তার স্বার্থ হাসিল করে। আপনার ঘরে সমস্যা থাকলে প্রতিবেশী বা দূর প্রতিবেশী তার স্বার্থ হাসিলের জন্য পানি ঘোলা করে হলেও তার স্বার্থ হাসিল করতে চাইবে।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, দমন-পীড়ন ও নীতির মাধ্যমে সরকার শ্রমিক অধিকার আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। এটি শ্রম পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আমেরিকার শ্রমনীতি সারা বিশ্বের জন্য। এটিকে আমরা স্বাগত জানাই। দেশের শ্রম পরিস্থিতির জন্য সরকার, মালিক ও আমাদের (শ্রমিক পক্ষের) অনেক কাজ করার আছে। এক্ষেত্রে দেখছি, সরকার শুধু মালিকদের গুরুত্ব দিচ্ছে। মালিকদের নিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটি চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি মোকাবিলা কঠিন হয়ে যাবে। আমরা দেশের জন্য, শিল্পের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে চাই। যেন সব পক্ষ ভালো থাকে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার কালবেলাকে বলেন, সংবাদমাধ্যম থেকে জানলাম, মজুরি দাবির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৩২টি মামলায় ২০ হাজারের বেশি শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। আমাদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদককে (বাবুল হোসেন) গত ১৪ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। আজ (গতকাল) জামিনের আবেদন করা হয়; কিন্তু আদালত মঞ্জুর করেননি। এতে বোঝা যাচ্ছে, আন্দোলনকে দমানোর জন্য সরকার দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। অধিকার আদায়ে আমরা আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি মাঠের লড়াই অব্যাহত রাখছি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালবেলাকে বলেন, মার্কিন শ্রমনীতি বাংলাদেশকেন্দ্রিক কোনো ঘোষণা নয়। বিশ্বব্যাপী যেখানে শ্রম অধিকার লঙ্ঘন হয়, সেখানে তারা এ নীতি প্রয়োগ করতে চায়। এটি আমাদের শ্রমিক আন্দোলনের ইস্যুও নয়। আরও বড় প্রেক্ষাপট। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নির্বাচনী সিদ্ধান্তের আলোকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তবে শ্রমিক নেত্রীর নাম উল্লেখ থাকায় বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেজন্য সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহ নিতে পারে। বাংলাদেশের উচিত হবে শ্রমিকদের যে দাবি আছে, তার ঊর্ধ্বক্রম সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া। পাশাপাশি আন্দোলনে যেসব মামলা হয়েছে, সেখানে যারা আটক এবং মামলায় অভিযুক্ত তাদের মুক্তি ও সমাধানের দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর যারা নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের পাশে সহায়তার হাত বাড়ানো। কারণ এরই মধ্যে আমরা অর্থনীতিতে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। এর সঙ্গে শ্রম ইস্যুতে নতুন চ্যালেঞ্জ এলে অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে।

তিনি বলেন, শ্রম বিষয় শুধু পোশাক শ্রমিকদের জন্য নয়, এর সঙ্গে অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের জন্যও যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। যদিও নির্বাচনকালীন সরকার এখন নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। তার পরও পরবর্তী সরকার যাতে শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেজন্য উদ্যোগ বা পরিকল্পনা এখনই তৈরি করা দরকার।