অর্থনীতি এখন অনিশ্চয়তার ঝুঁকিতে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in কালেরকন্ঠ on 26 November 2023

মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি

দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ডলার সংকটে আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়া এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব নিয়ে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে কথা বলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সংকট উত্তরণে পরামর্শও দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিরাজ শামস

কালের কণ্ঠ: দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: এই সংকট খুব অল্প সময়ে আসেনি। কভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের চাপ এবং দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব—একে একে সব কিছু যুক্ত হয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বিপাকে ফেলেছে। সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনায় বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের চাপে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি, আমদানি, রপ্তানি ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সামষ্টিক অর্থনীতির শক্তি যেটা দেশের ছিল, অনিশ্চয়তা বেড়ে যাওয়ায় তা এখন ঝুঁকিতে রয়েছে।

কালের কণ্ঠ: ডলার সংকটে আমদানিতে কড়াকড়ির ফলে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ ও রপ্তানি বিঘ্নিত হয়েছে। এর প্রভাব কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: ডলার সংকটে অনেক দিন ধরে ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে সরবরাহ ও চাহিদার ব্যাপক ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে।

পণ্যের ঘাটতি সমস্যা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া টাকার অবনমন হয়েছে। এটি একদিকে বাজারে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে, অন্যদিকে রপ্তানি কমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বেঁধে দিলেও বাজারে অনেক বেশি দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে।

ডলার বেচাকেনায় অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এটা মূল্যস্ফীতিকে ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সার্বিকভাবে লেনদেন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় অর্থনীতিতে পৌনঃপুনিক প্রভাব পড়ছে। ঋণপত্র খোলা অনেকটা বন্ধ থাকায় সরবরাহ প্রক্রিয়ায় বাধা আসছে। এমন অর্থনৈতিক দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়বে।

তবে ডলারের সঙ্গে টাকার মূল্যমান অবনমন হওয়ায় রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বেড়েছে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়তে শুরু করেছে। এটা ইতিবাচক।

কালের কণ্ঠ: অর্থনীতিতে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতি কেমন হতে পারে?

মোস্তাফিজুর রহমান: কয়েক বছর ধরে নানা সংকটে থাকা অর্থনীতির অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এখন অর্থনীতি আগের চেয়ে আরো নাজুক অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এমন সময়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর নানা বার্তা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে আরো ঘণীভূত করছে। এই অনিশ্চিত অবস্থা থেকে স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার তাই কঠিন হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের স্বার্থে সমঝোতাপূর্ণভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

কালের কণ্ঠ: চলমান সংকট উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?

মোস্তাফিজুর রহমান: সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে না পড়তে হয়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিয়েও বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুনভাবে কাজ করতে হবে।

অনেক বিষয় আগে থেকে বলা হলেও যেহেতু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তাই আরো কিছু সময় অর্থনীতি অনিশ্চয়তার মধ্যেই থাকবে। স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব চলবে। এই পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নজর দিতে হবে।

স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এখন খুব সহজ হবে না। অনেক কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এ জন্য ভালো অবস্থায় ফিরতে কিছুটা সময়ও লাগবে। তবু ঋণের সুদহার, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে হবে, যাতে আস্থার ঘাটতি না হয়। সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। পাশাপাশি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় ডলারের দাম বাড়লে যাতে মূল্যস্ফীতিতে চাপ ততটা না পড়ে, এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।

তবে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়াতে পারলে বর্তমান সংকট মোকাবেলা তুলনামূলক সহজ হবে। অর্থনৈতিক ভারসম্য ফিরিয়ে আনতে করখেলাপি ও ঋণখেলাপিদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়ার আর সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

কালের কণ্ঠ: পরিস্থিতি মোকাবেলায় মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?

মোস্তাফিজুর রহমান: দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার একটা সমাধান লাগবে। সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পায় করখেলাপি ও ঋণখেলাপি কমাতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ব্যবসা পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছাড়লে রেমিট্যান্স আরো বাড়বে। তবে বাজারে চাপ থাকবে। এটা মোকাবেলা করার জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আরো বাড়াতে হবে। তাহলে মধ্য মেয়াদে অনেকটা ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে।

কালের কণ্ঠ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মোস্তাফিজুর রহমান: কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।