অস্থির সময়ের প্রশান্তি – রেহমান সোবহান

Originally posted in বণিক বার্তা on 25 October 2022

একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তির গড়ে ওঠা

আমি আমার আত্মজীবনীতে লিখেছি ১৯৭০ সালে নিউইয়র্কের রচেস্টারে একটি ঐতিহাসিক সম্মেলনে রওনকের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, যেখানে দুটি আলাদা জাতি হিসেবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে পাকিস্তানের গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আমরা চূড়ান্ত এক একাডেমিক লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলাম। যদিও রওনক ১৯৫৯-৬৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন এবং তিনি ছিলেন ক্লাসের তারকা শিক্ষার্থী, তার সঙ্গে তখন আমার পরিচয় হয়নি। রওনক অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী অর্জন করেন। সে যুগে প্রথম শ্রেণী পাওয়া ছিল একটি বিরল অর্জন।

১৯৬৫ সালে রওনক যখন হার্ভার্ডে পৌঁছেন, তখন শাড়ি পরিহিত কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলের ৪ ফিট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটিকে দেখে সম্ভবত তার শিক্ষক ও সহপাঠীরা তাকে অন্য কোনো জগতের প্রজাতি হিসেবে গণ্য করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও পিতা আহমাদুল্লাহর সরকারি চাকরির কারণে মফস্বলে বাংলা মাধ্যমেই পড়তে হয়েছে তাকে। ক্লাসের সবচেয়ে ছোটখাটো আকৃতির শিক্ষার্থী হলেও তিনি যখন যে স্কুলে পড়েছেন সবসময়ই প্রথম হয়েছেন। শিক্ষার প্রতি আলাদা ধরনের আগ্রহ ছিল রওনকের পিতার এবং ছিল মায়ের সমর্থন। কখনো তারা ছেলেমেয়েদের আলাদা করে দেখেননি। তার পিতা নিজে ছেলেমেয়ের হোমওয়ার্কের তদারকি করতেন। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিভিন্ন বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। তাদের সব সন্তানই বাংলা ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

আহমাদুল্লাহ একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবেও বেশ ব্যতিক্রমী ছিলেন। তিনি সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতেন। তত্কালীন মুসলিম লীগ সরকারের বিভিন্ন রাজনৈতিক আদেশ অমান্যের জন্য বহুবার তাকে শাস্তিস্বরূপ বদলি করে দেয়া হয় এমন সব জায়গায় যেখানে মেয়েদের স্কুল ছিল না।

তার পিতা ও কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক তাকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত রওনক নিজেই তার সংকল্প এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তার পরিবেশগত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেতে পেরেছেন। ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় মুন্সীগঞ্জের এভিজেএম গার্লস স্কুলের ছাত্রী হিসেবে সব শিক্ষার্থীর মধ্যে সপ্তম ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হন রওনক।

অল্প বয়স থেকেই রওনক বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই হবে তার সমগ্র বিশ্বের কাছে পৌঁছানোর বাতায়ন, তাই তিনি কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সর্বোত্তম ফলাফল অর্জনকে গুরুত্ব দিয়েছেন, যাতে স্কলারশিপ নিয়ে হার্ভার্ড কিংবা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন এবং তারপর নিজের যোগ্যতার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ক্যারিয়ার গড়তে পারেন। এ প্রচেষ্টায়ও পিতার উৎসাহ পেয়েছেন। কেননা রওনকের বাবা কখনো চাননি যে তার মেয়েরা স্কুল কিংবা কলেজ থেকে ঝরে পড়ুক এবং দিন শেষে কোনো সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমে তাদের শিক্ষাজীবন, কি চাকরি জীবনের সমাপ্তি ঘটুক।

১৯৬৫ সালে রওনক স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে হার্ভার্ডে পড়তে যান এবং ১৯৭০ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। প্রথম কোনো বাংলাদেশী নারী হিসেবে হার্ভার্ড থেকে তিনি এ খেতাব অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে রওনক তার গবেষণা শেষ করেন এবং তার পরই কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপের প্রস্তাব আসে তার কাছে। আর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তার ‘পাকিস্তান: ফেইলিউর ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’ নামক গ্রন্থটি ১৯৭২ সালে, যা সে সময়ের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ একাডেমিক কাজগুলোর মধ্যে একটি। অর্ধশতাব্দী পরও গ্রন্থটি এখনো দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস ও রাজনীতির শিক্ষার্থীর জন্য পড়া বাধ্যতামূলক।

রওনকের সঙ্গে পরিচয়ের আগে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ হয় চিঠির মাধ্যমে। তখন আমি এবং হামিদা হোসেন মিলে সাপ্তাহিক ফোরাম সম্পাদনা ও প্রকাশ করতাম। রওনক পত্রিকাটির জন্য বিদেশ থেকে এক বছরের গ্রাহক হিসেবে টাকা পাঠান। কিন্তু তিনি পত্রিকাটির কপি পাচ্ছিলেন না, তাই তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে চিঠি লিখতে থাকেন। সাপ্তাহিক ফোরামের সব কপি নিয়ে আমি প্রত্যাশা করছিলাম যে মোটা গ্লাসের চশমা পরা ভীষণদর্শন কোনো নারীর সঙ্গে দেখা হবে বুঝি! কিন্তু ছোটখাটো যে রওনকের সঙ্গে আমার দেখা হলো, তার চেহারা ছিল বুদ্ধিমান হাইস্কুল পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর মতো, যে স্পষ্টভাষী, হাসিতে পরিপূর্ণ আর ফোরামের ডেলিভারি হাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে প্রস্তুত।

রওনক মাত্র ২৭ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন, যা আরেকটি বিরল অর্জন, বিশেষ করে একজন নারীর জন্য। তিনি ১৯৭০ সালের নভেম্বরে দেশে ফিরে আসেন এবং ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের সাক্ষী হন। কিন্তু জাতির উচ্ছ্বাসের সে মুহূর্তে তার পরিবারে নেমে আসে অপ্রত্যাশিত শোকের ছায়া। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন রওনকের বাবা আহমাদুল্লাহ। এ অল্প বয়সে, ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে রওনককে তার পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়।

তার দেশে ফেরার মাত্র চার মাসের মধ্যে ও পিতাকে হারানোর শোক সামলানোর আগেই বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত নিপীড়ন শুরু হয়। হার্ভার্ডে রওনকের কয়েকজন শিক্ষক তার পরিস্থিতি অনুধাবন করে তাকে একটি একাডেমিক পদে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন, যাতে তিনি তার পাকিস্তান: ফেইলিউর ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশনের প্রকাশনাকাজ শেষ করতে পারেন। খুব কম লেখকই এমন একটি বই লিখতে ও প্রকাশ করতে পারেন, যেখানে গবেষণার অনুমান, যুক্তি ও ফলাফল রিয়েল টাইমের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। হার্ভার্ডে থাকাকালীন ১৯৭২ সালে কেনেডি ইনস্টিটিউটে রওনক বাংলাদেশের ওপর একটি সেমিনার কোর্স পড়ান, যেটা সম্ভবত এ নতুন রাষ্ট্রের ওপর আমেরিকায় প্রথম একটি কোর্স।

১৯৭২ সালের মাঝামাঝি রওনক স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরেন, ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাসের পর তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। রওনকের বয়স তখন সবে মাত্র তিরিশ এবং তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র আর দুজন নারী বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। এ ধরনের একটি দায়িত্ব পালনের জন্য একজন শিক্ষক হিসেবেই নয়, একজন প্রশাসক হিসেবেও রওনককে নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে হয়েছিল। সে সময় ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি ছিল অস্থির। অনেক সময় ছাত্রদের মোকাবেলা করতে হতো; যাদের একাংশ ছিল সশস্ত্র বন্দুকধারী এবং যারা শিক্ষকদের কাছে অযাচিত সব দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হতো। রওনক সাহস ও ন্যায্যতার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

বিভাগীয় প্রধান হিসেবে তিনি অনেক নতুন পাঠ্যসূচির প্রচলন করেন। তার পাশাপাশি গবেষণা কার্যক্রমের উদ্যোগ নেন। তিনি ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে দুটি নির্বাচনী এলাকায় নাগরিকদের ভোটদানের আচরণ এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের (এমপি) ওপর জরিপভিত্তিক গবেষণার কাজ হাতে নেন, যেটি ছিল বাংলাদেশে নাগরিকদের ভোটদানের আচরণ ও সংসদ সদস্যদের ওপর ভিত্তি করে তথ্য তৈরি করা বিষয়ক প্রথম গবেষণা। অচিরেই রাজনৈতিক বিষয়ে রওনকের গবেষণা এ অঞ্চলের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী তার স্বীকৃতি এনে দেয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তার পাণ্ডিত্য স্বীকৃতি পায় এবং তিনি সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। পুরুষপ্রধান বয়স্ক পণ্ডিতদের মধ্যে দাঁড়িয়েও তুলনামূলক তরুণ, প্রতিভাবান ও স্পষ্টভাষী নারী হিসেবে রওনক তার মত প্রকাশ করতে কিংবা সাংগঠনিক ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে পিছপা হতেন না। ১৯৭৫ সালে খুশবন্ত সিংয়ের নেয়া রওনকের (সঙ্গে আরো ছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কমরেড মণি সিংহ ও আইনজীবী কামাল হোসেন) একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক টাইমস ও ভারতের ইলাস্টেটেড উইকলিতে। ১৯৭৭ সালে রওনক বাংলাদেশের ওপর বক্তৃতা দিতে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহর সফর করেন, যেখানে মন্ত্রী ও একাডেমিক পর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হন।

একই সময়ে তিনি রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও উন্নয়ন বিষয়ে গবেষণা ও লেখালেখি শুরু করেন। বিশেষ করে গবেষণা ও প্রচার কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীদের অসহায় অবস্থার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তিনি উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। ১৯৭৩ সালে অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী গবেষণা সংগঠন ‘উইমেন ফর উইমেন’ প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে নারী বিষয়ক একটি সম্পাদিত ভলিউম প্রকাশ করেন। ১৯৭৪ সালে বুখারেস্টে জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সম্মেলনে বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ পান। ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোয় জাতিসংঘের প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের প্রথম দিনে এনজিও ফোরামের দুটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৭৭ সালে ঢাকায় ‘নারী ও উন্নয়ন’ বিষয়ক দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সম্মেলনের অয়োজন করেন, যা ছিল এ অঞ্চলে এ ধরনের প্রথম কোনো সম্মেলন। ১৯৭৯ সালে তিনি সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলো নথিভুক্ত করে প্রকাশ করেন, যেটি ছিল এ বিষয়ে অগ্রগামী একটি কাজ এবং যা পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী নারী ও উন্নয়নবিষয়ক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়।

১৯৭৭ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হন এবং ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের ওপর আরেকটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এবার তিনি একটি নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণার কৌশলগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। ততদিনে তিনি আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত হয়ে পড়েছিলেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করছিলেন। ১৯৮২ সালে কুয়ালালামপুরে জাতিসংঘের এশিয়া প্যাসিফিক ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (এপিডিসি) পক্ষ থেকে তাকে নারীবিষয়ক কর্মসূচির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। এপিডিসিতে দুই বছরের কাজের সময়ে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক কর্মসূচি গড়ে তোলার পর ১৯৮৫ সালে জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (আইএলও) গ্রামীণ নারী, কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন বিভাগের প্রোগ্রাম প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যা রওনককে বিশ্বব্যাপী নারীবিষয়ক কর্মসূচি গ্রহণ ও তা সম্প্রসারণের সুযোগ এনে দেয়। ১৯৯০ সালে রওনক পুনরায় একাডেমিক জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের সাউদার্ন এশিয়ান ইনস্টিটিউটে শিক্ষাদান ও গবেষণার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এটি ছিল আদর্শ স্থান, যা তাকে শিক্ষা দানের পাশাপাশি নিজের গবেষণা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছিল। একজন একাডেমিক হিসেবে এ স্বাধীনতাকে তিনি সবসময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

আমাদের একাডেমিক সহযোগিতা

রওনক যখন আন্তর্জাতিক পরিসরে বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন আমি ছিলাম তার বন্ধুদের মধ্যে একজন, যে তাকে বিদেশে যেতে নিরুৎসাহিত করেছিল। রওনককে আমি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে (বিআইডিএস) একজন গবেষণা পরিচালক হিসেবে আমার সঙ্গে কাজে যোগদানের জন্য প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিলাম, কারণ আমার মনে হয়েছিল তার রাজনীতি ও লিঙ্গবিষয়ক প্রজ্ঞা বিআইডিএসের গবেষণা কার্যক্রমে যথেষ্ট বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করবে এবং শুধু ‘অর্থনৈতিক’ অধ্যয়নের পরিবর্তে ‘উন্নয়ন’ অধ্যয়নের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতিকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে। তাছাড়া একাডেমিক ক্ষেত্রগুলোয় আমাদের আগ্রহগুলোও মিলে যায়। তার বইতে পাকিস্তানের সমাপ্তির প্রাসঙ্গিকতাকে চমত্কারভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছিলেন, এ ধরনের বিশ্লেষণ আমিও করতে পছন্দ করি। আমরা প্রায়ই একডেমিক বিষয়ে এবং রাজনীতি নিয়ে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক করতে পছন্দ করতাম। রওনক ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন এবং সংসদ সদস্যদের ওপর করা তার দুটি বড় গবেষণাকাজের প্রথম খসড়া আমাকে পাঠান। আমার মনে হয় আমিই মাত্র একজন ব্যক্তি যে প্রকৃতপক্ষে তার গবেষণাপত্রের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছে ও বিস্তৃত লিখিত মন্তব্য প্রদান করেছে।

১৯৯৩ সালের দিকে আমি যখন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রতিষ্ঠা এবং তার পাশাপাশি তত্কালীন উদীয়মান শাসন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা শুরু করি, তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমাকে পরামর্শ দেয়া হয় যে আমি যেন আমেরিকার সুশাসনবিষয়ক গবেষণার অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে ও তাদের সুপরিচিত কয়েকজন চিন্তাবিদের সঙ্গে আলোচনা করতে সেখানে যাই। আমাকে সাহায্য করার জন্য ফোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে রওনক আমার সঙ্গে থাকবেন, যাতে আমি রাজনীতিতে তার কাজ এবং থিংক ট্যাংক সংস্কৃতি সম্পর্কে তার বিস্তৃৃত জ্ঞান আমার কাজে লাগাতে পারি। রওনক ও আমি নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, হার্ভার্ড, ইয়েল ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি বিভিন্ন গবেষকের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। সিপিডি গঠনে প্রাথমিক অবদানকারীদের একজন হিসেবে রওনককে তাই আমি স্বীকৃতি জানাই।

সিপিডি কাজ শুরু করার পর রওনক সবসময়ই সিপিডির সঙ্গে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জন্মের ২৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে নিউইয়র্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সিপিডির প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদার হওয়ার জন্য রওনক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সম্মেলনের জন্য তহবিল সংগ্রহসহ কার্যত সমস্ত সাংগঠনিক কাজগুলো সামলিয়েছেন তিনি। সম্মেলনের পেপার ও আলোচনা অত্যন্ত সফল হয়। সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত বিষয়গুলো একত্র করে তা বইয়ের আকার দেন রওনক। ২০০০ সালে জেড বুকস প্রকাশনী কর্তৃক ‘বাংলাদেশ: প্রমিজ অ্যান্ড পারফরম্যান্স’ শিরোনামে বইটি প্রকাশ হয়। এমন একটি ত্রুটিহীন বৃহৎ একাডেমিক ইভেন্টের আয়োজন করে রওনক প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি কেবল একজন পণ্ডিতই নন, সাংগঠনিক ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতারও অধিকারী, যা তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে এবং পরে এপিডিসি ও আইএলওর কাজেও প্রমাণ দিয়েছেন।

১৯৯০-এর দশকে যখন বিভিন্ন কাজে আমি নিউইয়র্ক যেতাম, তখন আমাদের সবসময়ই দেখা হতো। আমি ব্যক্তি রওনককে আরো ভালোভাবে জানতে পারলাম ও একাডেমিক আলোচনার পাশাপাশি আমরা সিনেমা, থিয়েটার, অপেরা, জাদুঘর, ভালো রেস্তোরাঁয় গিয়েছি। দেখেছি রওনক তার উপস্থিতি দিয়ে যেমন একটি ঘরকে আলোকিত করতে পারে, আবার প্রয়োজনে তীব্র কঠোরও হতে পারে। এ মুহূর্তে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সম্ভবত নভেম্বরের দিকে আমি জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশী সহকর্মী আদিল খান তার অ্যাপার্টমেন্টে আমাদের সবাইকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তানের হাফিজ পাশা, ইউএনডিপির এশিয়া বিভাগের এএসজি। তিনি ছিলেন ধূমপানে আসক্ত। রওনকসহ অনেকেই যা পছন্দ করতেন না। আদিলের বসার ঘরে হাফিজ হঠাৎ একটি সিগারেট ধরিয়ে বসলে রওনক তাকে তিরস্কার করা শুরু করেন এবং প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বারান্দায় যেতে বাধ্য করেন।

১৯৯০ দশকের শেষের দিকে রওনক স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণাকাজে আগ্রহী হতে শুরু করেন। সিপিডির সঙ্গে যৌথভাবে তিনি নারীর স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য খাতে নাগরিক কণ্ঠস্বর নিয়ে দুটো সংলাপের আয়োজন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে, কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ গঠনের উদ্যোগ নেন। ২০০৬ সাল থেকে ব্র্যাক স্কুল অব পাবলিক হেলথভিত্তিক বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে নাগরিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।

২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রওনক ও আমি আমাদের জীবনের একটি নতুন পর্বে প্রবেশ করি। আমরা থাকি কিছু সময় নিউইয়র্কে রওনকের অ্যাপার্টমেন্ট আর কিছু সময় ঢাকার গুলশানের আমার বাড়িতে। ২০০৬ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনিশিয়েটিভ ফর পলিসি ডায়ালগে একজন ভিজিটিং স্কলার হিসেবে জো স্টিগলিত্জ আমাকে আমন্ত্রণ জানান। সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট আমাকে রওনকের পাশে আর একটি অফিস দেয়। তখন আমি দক্ষিণ এশিয়ায় দারিদ্র্যের ওপর একটি বড় প্রকল্প হাতে নিই। ২০১০ সালে সেজ প্রকাশনী কর্তৃক ‘চ্যালেঞ্জিং দি ইনজাস্টিস অব পোভার্টি: এজেন্ডাস ফর ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া’ শিরোনামে বইটি প্রকাশ হয়। রওনক আমাকে তার মন্তব্য এবং সম্পাদকীয় পারদর্শিতা দিয়ে কাজটি করতে সহযোগিতা করেছিল। বইটি আমি আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হিসেবে গণ্য করি।

২০১০ সালে রওনক কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দেয়ার পর দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটি তাদের মর্যাদাপূর্ণ রজনী কোঠারি চেয়ারে এক বছরের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানায়, যেখানে বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানানো হয় গবেষণাকাজে অংশ নেয়ার জন্য। রওনকের বক্তৃতা প্রদান উপলক্ষে সিমলা, ত্রিভান্দ্রম এবং বেঙ্গালুরুতে গিয়েছি আমরা। ২০১২ সালে সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন রওনক। এরপর সিপিডির সঙ্গে বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস মিশেলসেন ইনস্টিটিউটের যৌথ অংশগ্রহণে দুটি প্রকল্প হাতে নেন। যার ফলে ২০১৫ সালে প্রকাশ হয় রওনকের আরেকটি বই ‘পলিটিক্যাল পার্টিস ইন বাংলাদেশ’ এবং জাতীয় সংসদের ওপর একটি মনোগ্রাফ।

গত বছর আমরা দুটি বড় একাডেমিক প্রকল্প হাতে নিই। রওনক নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে আরেকটি বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের। আমরা সম্মেলনের একটি সম্পাদিত ভলিউম প্রকাশের পরিকল্পনা করছি। এছাড়া আমরা বঙ্গবন্ধুর ওপর আমাদের নিবন্ধগুলোও একত্র করি, যা ২০২২ সালে প্রথমা প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: ফিলোসফি, পলিটিকস অ্যান্ড পলিসিস’ নামে। গত এক দশক জুড়ে রওনকের অপার উৎসাহে আমি আমার স্মৃতিকথা লেখার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। বঙ্গবন্ধু যুগের শেষ অবধি আমার গল্প নিয়ে এ পর্যন্ত দুটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। আরো একটি চূড়ান্ত ভলিউমের কাজ শেষের দিকে। এ উদ্যোগে রওনক অনুপ্রেরণার উৎস, সমালোচক ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। আমাদের একসঙ্গে জীবন পরিচালনার আরো কঠিন দায়িত্বের সঙ্গে রওনকের ওপর এ ধরনের কঠিন দায়িত্বও চাপানো হয়েছে।

রওনক সবসময়ই স্বাধীনচেতা, কোনো প্রভাবশালীর অন্যায় আদেশ মানতে তিনি প্রস্তুত নন। তাই তিনি গবেষণা, লেখালেখি ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পছন্দ করেন। বেশ কয়েকবার যখন তাকে মন্ত্রী করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছিল, তখন তিনি আগে থেকেই তার অনিচ্ছার বার্তা পৌঁছে দেন। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ পদে নিয়োগের প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

অনেক বেশি স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বের রওনক গত কয়েক বছরের অপ্রত্যাশিত চাপগুলো বহন করেছেন, সবসময় যে হাসিমুখে তা নয়, তবে তিনি এখনো আমার পথচলার সঙ্গী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেন কাজ করছে না, কেন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং এর নেপথ্যের প্রভাবগুলো কী—সমাজের অপ্রকাশিত এমন অনেক বিষয়ের ওপর গুরুতর পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার ক্ষমতা এখনো রওনকের রয়েছে। তার নিজের জীবনের গল্পও কম আকর্ষণীয় হবে না, যা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গেই নয় বরং সারা বিশ্বে নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সমান্তরাল গতিতে এগিয়েছে। আমি তাকে এসব বিষয়ে লেখার জন্য উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করব, তবে রওনক যেমন আমার কাজের ক্ষেত্রে তার সময় ও মেধা দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছে, ততটা পারব কিনা সে বিষয়ে আমি অনেকটাই সন্দিহান।

আমি সবসময় ভাবি রওনক আমাকে যতটা দিয়েছে, তার প্রতিদানে আমি কতটা দিতে পারছি। আমার কাছে রওনক সবসময় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার অপার উৎস। তিনি একজন ব্যতিক্রমী মানুষ, তার বুদ্ধিমত্তা, কাজ করার দক্ষতা, অসামান্য সততা ও সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্যতার জন্য আমার জীবনসহ সবকিছুই দ্বিধাহীনভাবে আমি তার হাতে তুলে দিয়েছি। এসব বিশেষ গুণ একত্র হয়েছে এমন একজন ব্যক্তির মধ্যে, যে সর্বদা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে জীবন উপভোগ করতে পারে, তার চেয়ে অনেক তরুণ বয়সী মানুষের চেয়ে বেশি। বাইরের জগৎ যখন আমার কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন লাগতে থাকে, তখন রওনকের উপস্থিতি আমাকে আশার আলো দেখাতে সাহায্য করে। রওনকের সঙ্গে আমি যে অনন্য এক জীবন কাটাচ্ছি, সেজন্য প্রতিদিন আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, রওনক আমার জীবনে যে উজ্জ্বলতা, আনন্দ ও প্রশান্তি এনেছে, তা অনেক বড় পাওয়া।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান