অহংকার করার মতো অর্জন অনেক – মোস্তাফিজুর রহমান

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী

Originally posted in কালের কন্ঠ on 16 December 2021

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আলোকসজ্জা। গত রাতে ক্যামেরায় ধরা পড়া এই ছবি যেন বাংলাদেশের উন্নয়ন সূচকগুলোর প্রতীকী রূপ। ছবি : কালের কণ্ঠ

স্বাধীনতার ৫০ বছরের এই পথযাত্রায় বাংলাদেশের গৌরব ও অহংকার করার মতো অনেক অর্জন আছে। বিভিন্ন আর্থিক ও সামাজিক সূচকে এই অর্জনের প্রতিফলন দেখতে পাই। স্বাধীনতার সময় আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ বছরে। দেশের সাধারণ মানুষের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, খাদ্য উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা ও জীবনমান বেড়েছে।

দারিদ্র্য নিরসনের দিক থেকেও অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর ৮০ শতাংশ মানুষ জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। সেটা করোনা মহামারির আগে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে বেড়েছে এবং এর মধ্যে খুব বেশি ওঠানামা ছিল না। মোটামুটি স্থিতিশীলভাবে বেড়েছে।

আমাদের শিক্ষার প্রসার হয়েছে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় এখন ছেলে-মেয়ের বৈষম্য নেই বললেই চলে। বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা দেশব্যাপী সম্প্রসারিত হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি একসময় ছিল খুবই অন্তর্মুখী। এখন সেটা বহির্মুখী হয়েছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা একটা শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পেরেছি। আমদানি, রপ্তানি, পণ্য, সেবা—এসব বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের অর্থনীতিকে সম্পৃক্ত করেছে। এটাও একটা শক্তির পরিচয়। স্বাধীনতার পর আমাদের কোনো উদ্যোক্তা শ্রেণি ছিল না। স্বাধীনতা-পরবর্তী কৃষি, শিল্প, সেবা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তাঁরা তাঁদের কার্যক্রম এক খাত থেকে আরেক খাতে সম্প্রসারণ করেছেন।

এটাকে ঘিরে আমাদের ব্যাংকিং খাত, ব্যক্তি খাত গড়ে উঠেছে। আমাদের উদ্যোক্তারা দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন কম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছেন। এই অর্জনে শ্রমিক ও কৃষকদের বড় অবদান রয়েছে। যাঁরা প্রবাসী কর্মী, তাঁরাও বড় অবদান রেখেছেন।

গত পাঁচ দশকে আমরা দেখেছি, প্রতিটি প্রজন্ম, আগের প্রজন্ম থেকে মোটামুটি ভালো আর্থ-সামাজিক অবস্থান নিয়ে সামনের দিকে এগিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন হয়েছে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, নারী শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। শিল্প খাতে অনেক নারী শ্রমিক এসেছেন, বিশেষ করে পোশাকশিল্পে। এর ফলে নারীর আয়ের সুযোগ হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। এর প্রতিফলন দেখতে পাই বিয়ের বয়সে। আগে যে হারে বাল্যবিবাহ হতো, সেটা এখন অনেক কমেছে। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে কমে ১.২ থেকে ১.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এগুলো সবই আমাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্জন।

তবে অগ্রগতি কখনো সরলরৈখিকভাবে হয় না। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। আমাদের এখন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হচ্ছে। এর ফলে বাজারের যে শুল্ক সুবিধা, সেগুলোর অনেক থাকবে না। আমাদের শুল্ক সুবিধাহীন বাজারের যে প্রতিযোগিতা, সেই প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জনে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি আমরা। এ কারণে আমাদের বিদেশি ঋণের সুদ বাড়বে। বিদেশ থেকে যেসব ঋণ নিচ্ছি, সেগুলো যাতে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারি, সাশ্রয়ীভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে পারি, সেদিকে নজর দিতে হবে। দেশে অনেক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। সেখানে যেসব শ্রমিক, পেশাজীবী, ব্যবস্থাপক দরকার হবে, এর জন্য তাঁদের প্রস্তুত করতে হবে। এ ছাড়া বিপণন ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ দরকার হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিভিন্ন চাহিদা নিয়ে আসবে। সক্ষমভাবে ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে অনেক ধরনের অবকাঠামো দরকার হবে। যেগুলো ডিজিটাল ইকোনমি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে জড়িত। সেখানে আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে।

সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলোকে মোকাবেলা করতে শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষতা ও মান বৃদ্ধি, আগামীর চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ খাতে বরাদ্দ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, শিল্পের সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনের সম্পর্কের জায়গাগুলোয় আরো বেশি নজর দিতে হবে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমরা এসডিজি বাস্তবায়নের কথা বলছি। সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের আর্থ-সামাজিক যে উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও যেন সমান অধিকার পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সোশ্যাল সেফটিনেস থেকে ধীরে ধীরে আমাদের সোশ্যাল সিকিউরিটির দিকে যেতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা, স্বাস্থ্যবীমা, সর্বজনীন পেনশন প্রকল্প, ন্যূনতম আয় ও শোভন কাজ, এই বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে। বাড়াতে হবে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়। আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও, রেভিনিউ-জিডিপি রেশিও বাড়িয়ে বণ্টনের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি দেশের অগ্রযাত্রায় সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি খুব প্রয়োজন। আগামীতে এগুলোর আরো বেশি প্রয়োজন হবে।

প্রতিযোগিতা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা। সুতরাং সবদিক থেকে সুশাসন, মানুষের অধিকার সুরক্ষা, এগুলোর প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। যুবসমাজ নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। তাঁরা খুব মেধাসম্পন্ন। তাঁদের উদ্ভাবনী শক্তি আছে। আমাদেরই তাঁদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। যাতে আগামীর বাংলাদেশে তাঁরা যোগ্য ভূমিকা রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। আমাদের ২০৪১ সালের ভিশনে বলা হয়েছে—উন্নত বাংলাদেশ, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ এবং পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ। এটা যদি অর্জন করতে হয়, তাহলে আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার নিশ্চিত করে সেখানে পৌঁছাতে হবে। এটা করতে পারলে আমাদের অগ্রগতিকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করতে পারব। আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা বাংলাদেশও গড়তে পারব।

লেখক : সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি