আইএমএফের সঙ্গে ঋণচুক্তি ও কাঠামোগত সংস্কার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in কালের কন্ঠ on 16 July 2023

আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসছে। এমন একটি সময়ে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে নতুন অর্থবছরের বাজেট। কেমন হলো নতুন বাজেট? এ সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো কৌশল কি পাওয়া যাচ্ছে বাজেটে? প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, বাস্তবে সেটা কতখানি সম্ভব? রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কি পূরণ হবে? সর্বোপরি এই বাজেট বাস্তবায়ন কি সহজ হবে? এসব বিষয় নিয়ে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে কথা বলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব

কালের কণ্ঠ : নির্বাচনের বছরে এসে যে বাজেটটি জাতীয় সংসদে পাস হলো, সেটা কিভাবে পর্যালোচনা করবেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বাংলাদেশে সাধারণত নির্বাচনী বছরে যখন সামষ্টিক অর্থনীতিতে একধরনের স্থিতিশীল পরিবেশ থাকে এবং নির্বাচন কাঠামোতে যখন একধরনের প্রতিযোগিতমূলক পরিস্থিতি থাকে, তখন বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন রকমের প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। সরকারের মন্ত্রী বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি—তাঁরাও নির্বাচনের মাঠে সেসব প্রকল্পের উল্লেখ করেন। তবে দুটি কারণে এবারের নির্বাচনের পরিস্থিতি ভিন্ন। একটি হলো, সামষ্টিক অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জ যাচ্ছে বাংলাদেশে, তাতে এই মুহূর্তে সরকারের বড় রকমের আর্থিক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার সামর্থ্য সীমিত।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এটি বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকভাবে চতুর্থবারে নির্বাচনে যাওয়া, তাই নতুন করে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিগত সময়ে যেসব বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলো শেষ করা। অর্থনীতির সুফলগুলো নিশ্চিত করা। এই সরকারের চতুর্থবার হওয়ার কারণে যেকোনো নতুন সরকারের বাজেট দেওয়ার চেয়ে তার প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিত ভিন্ন। সেদিক থেকে এবারের বাজেটকে ঠিক আসলে নির্বাচনী বাজেট বলা যাবে না।

নির্বাচনী বাজেটে যে ধরনের ইঙ্গিত থাকে—যেমন নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়ার কমিটমেন্ট, নতুন নতুন প্রকল্প প্রস্তাব করা—এগুলো এবার নেই। বরং প্রকল্পের সংখ্যা কমানো হয়েছে। বাজেটে প্রকল্প শেষ করার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

কালের কণ্ঠ: ‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’—এটা ছিল এবারের বাজেটের শিরোনাম। তো এই ‘স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে’ যাত্রার চ্যালেঞ্জগুলো কী দেখছেন আপনি?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: দেখুন, স্মার্ট বাংলাদেশের বিষয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয় বা আইসিটি বিভাগ তাদের অবস্থান ধীরে ধীরে পরিষ্কার করছে। কিন্তু এখনো এ ঘোষণাটি আমরা রাজনৈতিক ঘোষণা হিসেবে দেখছি। এটির পূর্ণ অবয়ব ফুটে উঠবে তখন, যখন বর্তমান সরকারি দল নির্বাচনী ইশতেহারে যাবে। নির্বাচনী ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশের পূর্ণ অবয়ব তারা হয়তো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এবারের বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রা বা সে ধরনের জায়গাটি তেমন রেখাপাত করা হয়নি। বরং ডিজিটাল বাংলাদেশের যে অভিযাত্রা সেটির বিভিন্ন ঘাটতি পূরণে সরকারি-বেসরকারি খাত কাজ করে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে প্রচেষ্টা ও সক্ষমতার ক্ষেত্রে যে উদ্যোগগুলো সরকার নিচ্ছে, এটা ইতিবাচক, প্রশংসনীয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণাটা আকর্ষণীয়। কিন্তু এটাকে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ভেতর নিয়ে আসা, সেটি এখনো চলছে। সামগ্রিকভাবে দেশে এবং সোসাইটির ভেতরে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি সম্ভবত পরবর্তী পাঁচ বছরে দেখা যেতে পারে।

কালের কণ্ঠ: বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বাস্তবে সেটা কতখানি সম্ভব।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: প্রবৃদ্ধির বিষয়টি যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমরাও মনে করি, যেকোনো সরকারের সময়কালে সামগ্রিকতার বিচারে সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নতির একটা রিফ্লেকশন দেয়। কিন্তু এবার যে ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে এবং সেটি অর্জনের জন্য যে সূচকগুলোতে যে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করা হচ্ছে, আমাদের কাছে মনে হয়েছে সে জায়গাগুলোতে হিসাবের দুর্বলতা রয়েছে। ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মনে হয়েছে অনেকটা অঙ্কের হিসাব মেলানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার বিচারে সে হিসাবগুলো আদতে রিফ্লেক্ট করানো যাবে কি না সেটি কিন্তু একটা চ্যালেঞ্জের বিষয়।

বিগত পাঁচ বছরে ১ শতাংশ জিডিপি বাড়ানো যায়নি। সেখানে এ রকম একটা চ্যালেঞ্জিং ও অনিশ্চিত পরিবেশে বেসরকারি খাত বিনিয়োগে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেখানে দ্বিধান্বিত, সেখানে এত পরিমাণ বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার হিসাবটি আসলে নড়বড়ে।

কালের কণ্ঠ: পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও কৌশল কি বাজেটে আছে? কী কৌশল থাকতে পারত বলে আপনি মনে করেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বিশেষ সময়টা আসলে এবারের অর্থবছরের ঠিক আগে আগে শুরু হয়। বিশেষ সময়কালটির সূত্রপাত বলা যেতে পারে কভিড সময়কাল থেকে। পরে এর সঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ যোগ হয়েছে। তারপর বৈশ্বিক জ্বালানি রাজনীতি যুক্ত হয়েছে। সুতরাং এটা একধরনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ভেতরে রয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, সরকার সময় বিশেষে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্নমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এর কিছু কিছু জায়গায় সরকার ভালো সফল হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় সরকারের সাফল্য সীমিত। আবার কিছু কিছু জায়গায় যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল, সে উদ্যোগের ঘাটতি আছে।

সামগ্রিকভাবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, সরকার পরিস্থিতিটিকে এখনো একধরনের স্বল্পমেয়াদি সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করছে। সরকার আইএমএফের সঙ্গে ঋণচুক্তিতে গিয়েছে এবং বেশ কিছু কাঠামোগত ক্ষেত্রে সরকারের সংস্কারে অঙ্গীকার করা—এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং ইতিবাচক দিক। এ ধরনের কাঠামোগত সংস্কার উদ্যোগগুলো সরকারের উদার মনে করা দরকার।

কালের কণ্ঠ: এই বাজেট বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন হবে বলে কি আপনি মনে করেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: সরকারের রাজস্ব চাপ থাকা, রিজার্ভের ক্ষেত্রে সীমিত পরিস্থিতি—বলা যেতে পারে যে খোলামেলা বাজেট করার মতো স্পেস স্কেল আসলে সরকারের হাতে এই সময়ে নেই। তার ভেতরে সরকার যে চেষ্টাটি করেছে, সেটি হলো নির্বাচনী বছরে খুব বড় কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত না নিয়ে যতটুকু সম্ভব এই কঠিন সময়টুকু অতিক্রম করা। এখনো এ ধরনের চ্যালেঞ্জগুলোকে একধরনের স্বল্পমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের বিবেচনায় যে ধরনের দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, সে জায়গাগুলোতে এখনো উদ্যোগ নেই। সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যাপকভাবে তার রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা।

বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের আয়ের চ্যালেঞ্জ থাকবে। সরকার যদি ব্যাংকব্যবস্থা থেকে আরো বড় ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রাখে, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ছাপিয়ে, তাহলে সেটি মুদ্রাস্ফীতির ওপর চ্যালেঞ্জ ফেলবে। বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও কিছুটা সময়ের ঝুঁকি থাকতে পারে। টার্গেট মাত্রায় রাজস্ব আদায় না-ও হতে পারে। সব কিছু মিলিয়ে প্রত্যাশিত মাত্রায় প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার মতো অর্থ সংস্থান করাতে হিমশিম খেতে পারে।

কালের কণ্ঠ: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে নেতিবাচক ধারায় দেশের অর্থনীতি। ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড দরপতন। মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। এ অবস্থায় দেশের মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার মতো কিছু কি বাজেটে আছে? কী করা যেতে পারত?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: মূল্যস্ফীতির বিষয়গুলোকে যতটা সম্ভব ফিসক্যাল বাজেটারি মেজারস দিয়ে অ্যাড্রেস করা যায়, সে জায়গাটিতে ঘাটতি আছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এবারের বাজেটে এটা দুর্বলতম দিক। করমুক্ত আয়সীমাটি বাড়িয়ে যাতে মূল্যস্ফীতিজনিত অভিঘাত কিছুটা মেটাতে পারে সব আয়গোষ্ঠীর মানুষ—বিশেষ করে নিম্ন আয়গোষ্ঠীর মানুষ—সেই চেষ্টাটি সরকারের উদ্যোগের ভেতরে আছে। এর বাইরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আর্থিক বরাদ্দ বাড়িয়েছে।

মূল্যস্ফীতির একটা কারণ বৈশ্বিক। আরেকটা কারণ অভ্যন্তরীণ। আমাদের এখানে মানি সাপ্লাই বাড়ছে। সেটিও কিন্তু মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলছে। প্রকল্পে অপচয় রোধ করতে হবে। অকারণে অর্থ ব্যয়ও কিন্তু মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। বাজারে মূল্য পরিস্থিতি যতটা না আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে জড়িত, এর বাইরে রয়েছে বাজারব্যবস্থার দুর্বলতা এবং তদারকির কারণেও কিন্তু মূল্যস্ফীতির ঘটনা ঘটছে। সে জায়গাগুলোর জন্য তদারক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা, লোকবল বৃদ্ধি করার জন্য বাজেটে যে ধরনের প্রস্তাবনা, সে প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য থাকতে পারে। যেমন—প্রতিযোগিতা কমিশন, ভোক্তা অধিকার রক্ষা কমিশন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ—এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য বাজেট বৃদ্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে। এর জন্য কিন্তু বাজেটে সে রকম বরাদ্দ আমরা দেখছি না।

কালের কণ্ঠ: রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তা কি পূরণ হবে?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। সরকারি হিসাবে সেটি ১৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দরকার। সরকারকে অতিরিক্ত প্রায় এক লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা জেনারেট করতে হবে। প্রবৃদ্ধির মূল পার্থক্য হচ্ছে যে বর্তমান অর্থবছরেই একটা বড় ঘাটতি থাকার কথা, সরকার মনে করছে যে ঘাটতি হবে না। সিপিডির হিসাবে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার একটা ঘাটতি এই অর্থবছরেই থাকবে। সুতরাং সেই হিসেবে আগামী অর্থবছরের জন্য যে টার্গেট, সেটি অর্জন করা মোটেই সহজসাধ্য নয়। বাজেটে ঘোষিত মেজারস যেগুলো আছে, সেগুলো দিয়ে আমরা খুব বেশি আশা করছি না। এ ক্ষেত্রে যে ধরনের উদ্যোগগুলো দরকার, বিশেষ করে করজালের বাইরে যাঁরা রয়েছেন, যাঁরা কর ফাঁকি দিচ্ছেন এবং যাঁরা ভুল ফিন্যানশিয়াল স্টেটমেন্ট দিচ্ছেন এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যাঁদের করজালে আনা যাচ্ছে না, সেগুলো টার্গেট করে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেগুলোর ক্ষেত্রে এখনো ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেই।

এনবিআর ধীরে ধীরে একধরনের সমন্বিত ব্যবস্থায় যাওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে সব ধরনের লেনদেন ধীরে ধীরে নেটওয়ার্কের ভেতরে আনা, ফিন্যানশিয়াল রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে একধরনের ক্রস চেক করার ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়া দরকার। রাজস্ব আদায়ের জন্য দেশব্যাপী যে ডিজিটাল ফিন্যানশিয়াল সিস্টেম চালু হওয়া দরকার, সে উদ্যোগগুলো এখনো ভালোভাবে নেওয়া হয়নি। সেদিকে এনবিআরের খুব দ্রুত সময় যাওয়া দরকার।

কালের কণ্ঠ: এখন তো মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যেসব কৌশল নিয়েছে তা কতটা কার্যকর হবে বলে মনে করেন আপনি?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বর্তমান সময় কিছুটা উচ্চ মূল্যস্ফীতিরই সময়। বিশ্বব্যাপী কভিড-পূর্ব সময়কালের মূল্যস্ফীতিতে এখনো আমরা যেতে পারিনি। তেলের বাজারে সংকট, অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সাপ্লাইয়ে বিভিন্ন রকমের অনিশ্চয়তা—এগুলো রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে আপনি হয়তো কিছুটা মূল্য কমে আসার একটা প্রবণতা দেখবেন। বৈশ্বিক পর্যায়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির একটি সময়কাল যাচ্ছে। তার চেয়ে আমাদের এখানে একটা মূল্যস্ফীতির প্রবণতা রয়েছে, যেটি বাজারব্যবস্থার বাইরে। সেটির ক্ষেত্রে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়—এদের যৌথভাবে কাজ করার দরকার রয়েছে।

কালের কণ্ঠ: অর্থনীতির নানামুখী চাপ রয়েছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সেভাবে আসছে না। করণীয় কী?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আমাদের কাছে মনে হয়, এবারের বাজেটে সরকারের উচিত ছিল রেমিট্যান্সকে আরো কিছুটা উৎসাহিত করা। এবং প্রয়োজনবোধে সে জায়গাটির ক্ষেত্রে প্রণোদনা যেটি রয়েছে সেটি কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া। তবে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি হলো ফরেন মার্কেটের যেকোনো ট্রানজেকশন মার্কেট রেটে হবে। যদি এটি হয় তাহলে আশা করা যায়, ইনফরমাল মার্কেটের সঙ্গে ফরমাল মার্কেটের এবং বাংলাদেশের যে বিভিন্ন রেট রয়েছে, যার কারণে বিভিন্ন ধরনের ডাইভারশন হয় ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রানজেকশনে, এগুলোকে মার্কেট রেটে নেওয়ার কারণে এই ডাইভারশন কমে আসবে। ফলে হুন্ডি বা এ ধরনের প্রবণতা যদি তুলনামূলক কমে আসে, তাহলে রেমিট্যান্সে তার একটা প্রভাব পড়বে। কেননা উচ্চ মূল্যে যদি আমাদের ব্যাংকাররা কিনতে পারেন, যাঁরা কি না হুন্ডি সিস্টেমে বাড়তি টাকায় পাঠান, তাঁরা বেশি টাকায় ফরমাল চ্যানেলে পাঠানোর ব্যাপারে উৎসাহিত থাকবেন।

কালের কণ্ঠ: সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমালেই কি মূল্যস্ফীতি কমবে? নতুন মুদ্রানীতি কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বাংলাদেশের বিচারে মুদ্রানীতিতে যে অল্প কয়েকটি বিষয় রয়েছে, তার আলোকে আসলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগগুলো নেয়। কিন্তু বাংলাদেশে বাজারব্যবস্থায় মার্কেটের ওপর মনিটরিং, ট্রানজেকশন—এগুলো অনেক সময় প্রপারলি মনিটর করা কষ্টকর। এর ফলে বিভিন্ন ঘোষিত নীতি—কে কিভাবে বাস্তবায়ন করছে এবং না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া—এটি সব সময় সহজ নয়। তার মধ্যেও সংকোচনমূলক যে মুদ্রানীতি—এই সময়কালে সেটির যৌক্তিকতা রয়েছে বলে আমরা মনে করি। মানি ফ্লো কোথায় কিভাবে হচ্ছে, সেটিকে কিছুটা হলেও সীমিত রাখার ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতাও প্রয়োজন পড়বে। প্রকল্পের ক্ষেত্রে সব দিক বিবেচনা করে অর্থ বরাদ্দের ব্যাপার যেন থাকে। সেটি যেন প্রপারলি বাস্তবায়িত হয়।

মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে মুদ্রানীতির যে ভূমিকা সেটি মুদ্রা সরবরাহ ও মার্কেট রেট, ইন্টারেস্ট রেট ও কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো যে রেটে ট্রানজেকশন করার কথা—বলা হচ্ছে মার্কেট রেটে চলে যাবে ধীরে ধীরে কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোর এই রেটগুলো। সেটিও হয়তো এই সময়কালের একটি যৌক্তিক অবস্থান। তবে মনিটরি পলিসির বাইরে রয়েছে ‘নন-মার্কেট আসপেক্ট’। বাজারব্যবস্থার ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে আমাদের, সে জায়গাগুলোতে পর্যাপ্ত নজর রাখা দরকার। সে জায়গাগুলোতে যদি পর্যাপ্ত উদ্যোগ না থাকে, শুধু মুদ্রানীতি নিয়ে সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতিকে স্বাভাবিক জায়গায় রাখা দুরূহ হবে।

কালের কণ্ঠ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: ধন্যবাদ।

শ্রুত লিখন : রায়হান রাশেদ