জরুরি ভিত্তিতে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারকে আর্থিক অনুদান দিতে হবে: ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in প্রথম আলো on Thursday 23 April 2020

এই সংকটে বাড়িওয়ালা–ভাড়াটে সমঝোতা হবে কি?

আবদুল খালেক গুলিস্তানের ফুটপাতে জুতা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে তাঁর আয় পুরোপুরি বন্ধ। দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে ঘরবন্দী আবদুল খালেক।

তিনি বলছিলেন, ‘অনেক কষ্টে আছি। ছেলেমেয়ের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আয় নেই আমার। ঘরভাড়া কীভাবে দেব?’

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মাসুদ রানা। দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে পুরান ঢাকায় ভাড়া থাকেন। করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনোমতে ঘরে আছি। আমার অফিস বন্ধ। বেতন পাইনি। ঘর ভাড়া দেওয়ার টাকা হাতে নেই। ঘরভাড়া দেওয়া নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ এখন ঘরবন্দী। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ বিপদে পড়েছেন। হাতে কাজ নেই, বেকার হয়ে ঘরবন্দী। ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাঁরা ঘরভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন, তাঁদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

ভাড়াটিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বাহারানে সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভাড়াটেরা বড় বিপদে আছি। করোনাভাইরাসের কারণে ঢাকাসহ সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। নিম্ন আয়ের মানুষের হাতে টাকা নেই। কিন্তু বাড়িওয়ালারা তো আর তা বুঝতে চাইবেন না। এমন মহামারির সময় সরকারের কাছে আমাদের জোর দাবি, সরকার যেন তিন মাসের (এপ্রিল, মে ও জুন মাস) বাড়িভাড়া মওকুফের ঘোষণা দেয়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার কয়েকজন বাড়িওয়ালা প্রথম আলোকে বলেন, ভাড়ার টাকায় বহু বাড়িওয়ালার সংসার চলে। যদি ভাড়াটেরা বাড়িভাড়া না দেন, তাহলে কীভাবে তাঁরা সংসার চালাবেন? আবার ঋণ নিয়ে বহু মালিক বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সেই ঋণের টাকা তো মাসে মাসে পরিশোধ করতে হয়।

মহামারির এই সময়ে নিম্ন আয়ের যেসব মানুষের বাড়িভাড়া দেওয়ার সংগতি নেই, তাঁদের যেন কোনোভাবে বাসা থেকে বের করে না দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। তাঁরা মনে করেন, দুপক্ষকেই মানবিক হতে হবে। বাড়িওয়ালার উচিত হবে না ভাড়াটেকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া বা ভাড়ার জন্য চাপ দেওয়া। তেমনি ভাড়াটেকেও চেষ্টা করতে হবে সংকট উত্তরণের পর ভাড়া পরিশোধ করা। তা ছাড়া সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে আর্থিক সহায়তা করা।

একজন অর্থনীতিবিদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময়ে ভাড়া দেওয়া নিয়ে ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালার মধ্যে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটার সমাধান কিন্তু সরকারকে করতে হবে। এই সময়ে যাঁরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, যাঁরা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাঁরা বাড়িভাড়ার টাকা কোত্থেকে দেবেন? এসব দরিদ্র মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় জরুরি ভিত্তিতে এককালীন হলেও অন্তত দু-তিন মাসের জন্য আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।

আর ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও সাঈদ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ভাড়া না দেওয়ার কারণে এই সময়ে যেন কোনো বাড়িওয়ালা ভাড়াটেকে বের না করে দেন। নিম্ন আয়ের যেসব মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাঁরা ভাড়া কীভাবে পরিশোধ করবেন? অবশ্যই বিষয়টি মানবিকভাবে দেখতে হবে।

বাড়িভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটের মধ্যে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার সমাধান করতে হবে সরকারকে—এমনটাই মনে করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে যাঁদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁরা কোত্থেকে বাড়িভাড়া দেবেন? সে ক্ষেত্রে সংক্রামক আইন অনুযায়ী যে উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে, সেই কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের কাছে একটা সুপারিশ জমা দিতে পারে। সেই সুপারিশ অনুযায়ী, সরকার একটা প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। ওই প্রজ্ঞাপন না মানলে তা হবে অপরাধ। দুই মাস কিংবা তিন মাস যাতে ভাড়া দেওয়ার জন্য ভাড়াটেকে সময় দেওয়া হয়।’

সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার

করোনাভাইরাসের কারণে হঠাৎ করে কর্মহীন মানুষ বাড়িভাড়া নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায়। ঢাকার মানিকনগর এলাকায় দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন মোহাম্মদ সোহাগ। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি করেন।

সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসাভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির বিল দিয়ে আমার খরচ পড়ে যায় ১৫ হাজার টাকা। আমার তো এখন এই টাকা দেওয়ার সংগতি নেই। কঠিন এই সময়ে সরকার যদি দুই মাসের জন্য হলেও বাড়িভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকুফ করে দিত, তাহলে একটু দুশ্চিন্তামুক্ত হতাম।’

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা  সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ  দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িভাড়া নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে সমাধান করার সুযোগ খুবই সীমিত। যদি কোনো বাড়িওয়ালা স্বপ্রণোদিত হয়ে বাড়িভাড়া মওকুফ করেন কিংবা পরে নেন, সেটার ভেতর ব্যবস্থাগত কোনো সমাধান নেই। মূল সমাধানের জায়গাটা হলো রাষ্ট্রের হাতে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ এখন যে পর্যায়ে এসেছে, তাদের সরকারিভাবে প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা না দিলে, তারা খুব দ্রুত দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। যেহেতু দেশের ভেতর সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা নেই, তাই এখন অ্যাডহক (জরুরি) ভিত্তিতে একটা সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এককালীন হলেও নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারকে আর্থিক অনুদান দিতে হবে।’

ভাড়াটেদের বাসা থেকে বের না করে দিয়ে সব বাড়িওয়ালাকে মানবিক আচরণ করা উচিত বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক বাড়িওয়ালার এখন না খেয়ে থাকার মতো পরিস্থিতি নেই। ভাড়া না পেলে তিনি না খেয়ে মারা যাবেন না। সামাজিক একটা জনমত তৈরি করতে হবে। এতে করে একজন বাড়িওয়ালা নিজেও লজ্জা পাবেন, আমি কেন এই সময়ে ভাড়ার জন্য চাপ দেব। বিষয়টি সামাজিক প্রচারে আসা উচিত। সরকারকেও প্রচার করা উচিত। যাঁদের সংগতি আছে, তাঁরা যেন করোনা পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত ভাড়া না চান।’

ভাড়ার টাকায় সেসব বাড়িওয়ালা সংসার চালান, তাঁদের ব্যাপারে সরকারি পদক্ষেপ চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাকালে কোনো বাড়িওয়ালা ভাড়া পাক কি না পাক, বিপদের সময় কোনো ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে ঘোষণা দিতে হবে, করোনাকালে আপনি আপনার ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করতে পারবেন না। এটা একটা আইন করে ফেলতে হবে। অনেক বাড়িওয়ালা আছে, যাদের বাড়িভাড়া প্রধান ইনকামের উৎস নয়। ঘর থেকে একটা মানুষকে সরিয়ে দেওয়া একটা অমানবিকতা।’

বাড়িভাড়ার সংকট সমাধানে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটেকে যৌক্তিক ও মানবিক আচরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন সবাই। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অনেক মালিক তো বাড়িভাড়ার ওপর নির্ভরশীল। তবে নিম্ন আয়ের মানুষদের যদি ক্যাশ ট্রান্সফার করা যায়, সেটা ভালো একটা সমাধান হতে পারে। আবার যাঁরা বাড়িওয়ালা আছেন, যাঁরা অবস্থাসম্পন্ন, যদি তাঁরা মেনে নেন যে তিন মাসের ভাড়ার টাকা পরবর্তী সময়ে নেবেন। অর্থাৎ বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের মধ্যে একটা সমঝোতার মতো হতে হবে।’

কাউকে বাড়ি থেকে বের করা যাবে না

কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ, যাঁরা বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না, তাঁদের কাউকে যেন ঘর থেকে বের না করে দেওয়া হয়, সেই আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।

আর ঢাকার সাংসদ ও জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ তো চিন্তা করতে পারেননি, হঠাৎ করে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বেন, বেকার হয়ে পড়বেন। ভাড়া না দেওয়ার কারণে আমার এলাকায় যাতে কাউকে বাসা থেকে বের না করে দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছি। এখন পর্যন্ত আমার এলাকায় তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

আর্থিকভাবে সচ্ছল বাড়িওয়ালাদের ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে চাপ না দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জানি, অনেক বাড়িওয়ালা কিন্তু ব্যাংক লোন নিয়ে বাড়ি বানিয়েছেন। তারপরও আমি বলব, বাড়িভাড়া না দিতে পারার জন্য কোনো ভাড়াটেকে যেন বের না করে দেওয়া হয়। বাড়িওয়ালাদের বিষয়টি কনসিডার করতে হবে। ভাড়াটে এবং মালিককে একটা আলোচনা করেই সমাধানের পথে আসতে হবে।’

মেয়র আতিকুল জানান, খুব শিগগির ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের তথ্যভান্ডার তৈরি করবে। নিম্ন আয়ের যেসব মানুষ ভাড়া দিতে পারছেন না, সে ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।

আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘এই সময়ে হঠাৎ করেই তো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, এটা তো সত্য। যে মানুষটা কর্মহীন, তিনি তো সাত দিন আগেও ভাবতে পারেননি তিনি এভাবে কর্মহীন হতে পারেন। মানবিক দিক থেকে ভাড়া মওকুফ হতেই পারে। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা তো এটা করতে পারেন।’

সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বাড়িভাড়া দিতে না পারা নিম্ন আয়ের মানুষকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টা অনেক স্পর্শকাতর। সোশ্যাল সেফটির সব টাকা তো করোনাভাইরাসের জন্য আমরা কাজ করছি। উই হ্যাভ ডাইভার্ট অল দ্য অ্যামাউন্ট ফর দ্য ট্রিটমেন্ট অব করোনাভাইরাস। এখন তো আমাদের যারা পথশিশু, বিচ্ছিন্ন মানুষ, ভবঘুরে, যারা রাজধানীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের আমরা খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি। তবে এ বিষয়টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনব। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করব।’

আর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সোশ্যাল সেফটির আওতায় দরিদ্র মানুষের জন্য তো সরকার কাজ করেই আসছে। সেই একই চিন্তায় লো ইনকাম (নিম্ন আয়) মানুষের জন্য ঘরভাড়ার ব্যাপারে সহযোগিতা দেওয়া হয়, সেটা চমৎকার কাজ হবে।