গ্রন্থ পর্যালোচনা – ‘উতল সময়ের স্মৃতিমন্থন এবং পূর্ণতার বছরগুলি’: এম এম আকাশ

Published in বণিকবার্তা on Monday, 13 August 2018

‘উতল সময়ের স্মৃতিমন্থন এবং পূর্ণতার বছরগুলি’

এম এম আকাশ

‘উতল সময়ের স্মৃতিমন্থন এবং পূর্ণতার বছরগুলি’— যেমন অধ্যাপক রেহমান সোবহানের একটি সাধারণ বই নয়, তেমনি এ নিবন্ধটি কোনো সাধারণ পুস্তক পর্যালোচনা নয়। এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়াজড়ি করে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সেখানে রেহমান সোবহান নামে এক উজ্জ্বল চরিত্রের ভূমিকা এবং আমার নিজস্ব মূল্যায়ন। তাই লেখাটি অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। আমি আশা করব পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি হবে না; তারা শেষ পর্যন্ত এটি পড়বেন।

স্যার বইটি আমার হাতে দিয়েছিলেন ২১ নভেম্বর, ২০১৫ সালে। সেখানে স্বহস্তে লিখেছিলেন নিচের পঙিক্তমালা—

আকাশকে, একটি রূপকল্পের ওপর পূর্ববর্তী প্রজন্মের এক সদস্যের অনুধ্যান, উষ্ণ শুভেচ্ছাসহ রেহমান সোবহান (স্বাক্ষর অস্পষ্ট) হাতে পাওয়ার পর বইটা আমার রুদ্ধশ্বাসে পড়া হয়ে যায়।

এখানে ‘রূপকল্প’ বলতে অধ্যাপক সোবহান তাঁদের প্রজন্মের স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশের ‘রূপকল্পকে’ বুঝিয়েছিলেন। তাঁর প্রজন্মের সার্থকতা ও কৃতিত্ব এখানে যে, তাঁরা সেই স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হননি, বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই সঠিকভাবেই এ গ্রন্থের নামের পঙিক্ত ‘উতল সময়ের স্মৃতিমন্থন’ পর পরেই ইতিবাচক আরেকটি পঙিক্ত যুক্ত হয়েছে, ‘পূর্ণতার বছরগুলি’। শুধু স্বপ্ন বাস্তবায়ন নয়। সেই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার যোদ্ধা ছিলেন স্যার। যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়ার তৃপ্তি অর্জন করেছিলেন। বিষয়বস্তু ও ইংরেজি রচনাশৈলী উভয়ের এত অনুপম মেলবন্ধন স্যারের অন্য কোনো রচনায় আমি আগে কখনো পাইনি। স্যারের ইংরেজি গদ্য সর্বদাই খুব প্রাঞ্জল. কিন্তু এ বইয়ে তা হয়েছে সুস্বাদু এবং অর্জন করেছে ভিন্নমাত্রার সাহিত্য গুণ। আমার মনে পড়ে ভূমি সংস্কার সম্পর্কে তাঁর আরেকটি বইয়ের কথা। আরেকভাবে ব্যতিক্রমী ওই বইটি ছিল গভীর বিশ্লেষণে ভরপুর এবং সে সম্পর্কে আমার আরেক তীক্ষধী স্যার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান মন্তব্য করেছিলেন, এজন্য অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত। একসময় অতীতে ওই বইটি সম্পর্কে আমি বাংলায় একটি পর্যালোচনাও লিখেছিলাম। স্যারের সেটি এতই পছন্দ হয়েছিল যে, তিনি তাঁর রচনাবলির তৃতীয় খণ্ডে ইংরেজি পুস্তকটির পর আমার বাংলা পর্যালোচনাটিও সন্নিবেশন করেছিলেন। আজ আমি পুনরায় স্যারের আরেক ধরনের এক অনবদ্য বই সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য কলম ধরেছি। জানি না, এবার আগেরটার মতো সফল হব কিনা!

এটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আকীর্ণ কোনো বই না হলেও এতে বিশ্বস্তভাবে বিধৃত আছে স্যারের নিজের জীবনের অভিনব অপূর্ব বিবর্তনের কাহিনী। স্যার নিজেই বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, তাঁর জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ শাসিত কলকাতার এক নামজাদা নার্সিং হোমে, খোদ ব্রিটিশ ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে। তাঁর মা ছিলেন ঢাকার বিখ্যাত নওয়াব পরিবারের দুহিতা। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ রাজকীয় পুলিশ সার্ভিসের কর্মকর্তা। যাকে বলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম, সেটাই ছিল স্যারের নিজের উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত জন্ম। এ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন— ‘এই স্মৃতিকথায় বিবৃত হয়েছে সেই শিশুর কথা, যে তার নিজের অভিজাত পারিবারিক পটভূমি অতিক্রম করে অবশেষে জড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তানের আইয়ুববিরোধী অশান্ত আন্দোলনে আর সেই পথ ধরেই পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ভয়ঙ্কর মুক্তিযুদ্ধ।’ [বইয়ের পৃ: xvi]

সেই অশান্ত যাত্রার প্রত্যক্ষ ঘটনাবলি নিয়েই লেখা হয়েছে এ বইয়ের প্রথম ১৩টি অধ্যায়। পরবর্তী চারটি অধ্যায়ে লেখকের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বিজয় অর্জনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। দৃশ্যত শেষ চারটি অধ্যায়ে বর্ণিত সময়টাই ছিল অধিকতর অশান্ত, কিন্তু লেখক এ পর্বকে চিহ্নিত করেছেন ‘পূর্ণতা প্রাপ্তির’ সময় হিসেবে। বইটির প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম— ‘যে পরিবার আমি উত্তরাধিকারী সূত্রে পেয়েছিলাম এবং যে পরিবার আমি নিজে বেছে নিয়েছিলাম।’ সত্যি সত্যিই যে পরিবারে তাঁর জন্ম, সেখান থেকে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ। তিনি নিজেই লিখেছেন, “যে পরিবারটিতে আমি মানুষ হয়েছিলাম, সেখানে আমার ‘ইলিশ মাছ’ খাওয়ার জন্য আগ্রহ বোধ করা বা রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলসংগীত শুনে মুগ্ধ হওয়ার কোনো কথা ছিল না।” অধ্যাপক সোবহান তাঁর ২১ বছর পর্যন্ত প্রায় পুরো সময়টাই কাটিয়েছিলেন বাংলাদেশের বাইরে। শিশু বয়সে দার্জিলিংয়ে সুদূর কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছে অবস্থিত অভিজাত স্কুলে, তরুণ বয়সে ছিলেন লাহোরে, পড়েছেন এক অভিজাত কলেজে এবং অবশেষে যৌবনে পড়াশোনা করেছেন লন্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। জীবনের এসব পর্ব অতিক্রম করে অবশেষে ১৯৫৭ সালের জানুয়ারিতে মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর ঢাকায় প্রথম পদার্পণ। সেই থেকে তাঁর জীবনের দ্বন্দ্বময় এক বিচিত্র পরীক্ষার শুরু। সেই জীবন ছিল এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অশান্ত যাত্রা এবং আদর্শবাদী এক তরুণ রেহমান সোবহানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ এক সৈনিক রেহমান সোবহানে পরিণত হওয়ার কাহিনীটি এ বইয়ে আমরা পাব। দার্জিলিং, লাহোর ও লন্ডন তার পরবর্তী অশান্ত ঢাকা জীবনের গতিপথ প্রত্যক্ষভাবে নির্ধারণ করতে না পারলেও তাঁর চরিত্র ও মানস গঠনে জীবনের এই প্রাথমিক দুই দশকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বইয়ের দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়ের বিবরণে সেই গঠনমূলক পর্বের কথা লিপিবদ্ধ আছে। তবে আমার পড়ে মনে হয়েছে, ওই বিবরণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাঁর কেমব্রিজ জীবনের বিবরণ। সময়টি ছিল ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬। তাঁর জীবনের ১৭ বছর থেকে ২০ বছর, যখন তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোকিত জগদ্বিখ্যাত অধ্যাপকদের কাছে, পরবর্তীকালে ততোধিক আলোকিত জগদ্বিখ্যাত ছাত্র-সহপাঠীদের সঙ্গে অতি উজ্জ্বল এক সময় কাটিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন আলোকিত শিক্ষক ও সহপাঠীর নাম উল্লেখ করলেই পাঠক এ পর্বের গুরুত্বটি বুঝতে পারবেন।

আমার ধারণা তাঁর জীবনের কেমব্রিজ অধ্যায়কে কেন্দ্র করেই উদ্ধৃত হয়েছে এ বইয়ের শুরুর ও শুরুতে উদ্ধৃত কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের অমর চরণ—

‘সেদিন প্রত্যুষে বেঁচে থাকাটাই ছিল এক উজ্জ্বল আনন্দ, কিন্তু একজন যুবকের জন্য সময়টা ছিল খোদ স্বর্গের চেয়েও বেশি।’

(ওয়ার্ডসওয়ার্থ এ চরণটি লিখেছিলেন ফরাসি বিপ্লবের শুরুর দিকে ওই বিপ্লবের উৎসাহী তরুণ অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে।)

২১ বছর বয়সে ঢাকায় পদার্পণের মুহূর্তে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মনে বোধ হয় এ রকম একটি উদ্দীপনাই সঞ্চারিত হয়েছিল। তবে সামনে ফরাসি বিপ্লব নয়, সামনে ছিল র্যাডিকেল ষাটের দশক এবং পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ। আর তখন তিনি ছিলেন ২১ বছরের এক প্রত্যয়দীপ্ত জেদি, আদর্শবাদী— উদ্দীপনায় ভরপুর যুবক। সম্ভবত পরবর্তী ষাটের দশক ছিল স্যার এবং স্যারের প্রজন্মের অনেকেরই জন্য জীবনের আরেক সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। ভাগ্যকে নিজের মুঠোয় নিয়ে বদলে দেয়ার মতো এমন জীবন অনেক প্রজন্মই পায় না। ‘রেহমান সোবহানরা’ তা পেয়েছিলেন।

শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য

আলোচ্য বইটির প্রথম ছয়টি অধ্যায়ের শিরোনাম নিম্নরূপ— উত্তরাধিকারী সূত্রে পরিবার এবং নিজের চয়নকৃত পরিবার, কলকাতায় বেড়ে ওঠা, দার্জিলিংয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়ায় ঘেরা বিদ্যালয়ের দিনগুলি, লাহোর: নওয়াবনন্দনদের মাঝে, লন্ডন: কল্পনা ও বাস্তব এবং কেমব্রিজ: রূপান্তরের দিনগুলি। এ ছয় অধ্যায়ে আমরা রেহমান সোবহানের ক্রমবিবর্তনের এক চমকপ্রদ পরিচয় পাই। আমরা জানতে পারি অধ্যাপক সোবহান শুধু সহপাঠীদের মধ্যে স্কুল ও কলেজ জীবনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন ছাত্রই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, খেলাধুলায় পারদর্শী, একজন মুষ্টিযোদ্ধা এবং এমনকি ব্রাজিলীয় নৃত্যকলা ‘সামবা’ নৃত্যে সুপটু সুরসিক এক ব্যক্তি। আরো জানা যায়, নিউইয়র্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত ব্রাজিলীয় সামবা নাচের আসরে বর্তমান স্ত্রী রওনক জাহানকে নিয়ে তিনি এখনো মাঝে মাঝে হানা দিতে ভালোবাসেন।

১৯৩৬ থেকে ১৯৫৭— এ কাল পর্বের দুটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হচ্ছে ‘১৯৪৭-এর দেশ ভাগ’ এবং ‘১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন’। পাঠকদের কৌতূহল হবে নিশ্চয়ই এ দুই মুহূর্তে তরুণ রেহমান সোবহান কী ভাবতেন এবং কী ভূমিকা রেখেছিলেন? অধ্যাপক সোবহানের সরল স্বীকারোক্তি অনুসারে, সে সময় তিনি রাজনীতি সম্পর্কে এতই অজ্ঞ ছিলেন যে এ ঘটনাবলি তখন তাঁর মাথার ওপর দিয়ে দ্রুত বয়ে গেছে। তাঁকে স্পর্শ করেনি, তিনি তেমন একটা আলোড়িতও হননি। ১৯৪৭ সালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর এবং তিনি তখন দার্জিলিংয়ের দেয়ালঘেরা সেন্ট পল স্কুলে বন্দি। তাঁর নিজের কথায়, সে সময় প্রতিদিন ভোরে তিনি কলকাতা থেকে আসা ইংরেজি কাগজ স্টেটসম্যান পড়তেন। তবে কাগজ খুলে তিনি প্রথম পৃষ্ঠায় অল্প একটু নজর বুলিয়েই দ্রুতই চলে যেতেন ‘ক্রীড়া’-সংক্রান্ত খবরের পাতায়। সেটাই ছিল তাঁর প্রধান মনোযোগের বিষয়। এ জীবন ছিল রেহমান সোবহানের ভাষায় একটি ‘Cocoon-like Existence’ গুটিপোকার গুটিতে আবদ্ধ এক অস্তিত্বের মতো। আরো তিন বছর পর ওই স্কুল থেকেই ১৯৫০ সালে সিনিয়র কেমব্রিজ ফাইনাল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন রেহমান সোবহান। বয়স তখন তাঁর মাত্র ১৪ বছর। এরই মধ্যে নয়-নয়টি বছর কেটে গেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়ায় ঘেরা চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ এক বিদ্যালয়ে।

বিদ্যালয় পর্ব শেষ হলে রেহমান সোবহানকে পাঠানো হলো লাহোরের বিখ্যাত নওয়াবনন্দনদের কলেজ এইচিনসন কলেজে। সেখানে তাঁকে উচ্চ মাধ্যমিক কেমব্রিজের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। সেখানেই তাঁর প্রথম বাঙালি, বাংলা ভাষা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাতের সুযোগ তৈরি হয়। আলোচ্য গ্রন্থের ৯৪ পৃষ্ঠায় একটি ঘটনার বিবরণ রয়েছে, যা থেকে তাঁর তদানীন্তন জাতীয় সম্মানবোধের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। এইচিনসনের নওয়াবনন্দনরা ছিলেন সব পশ্চিম পাকিস্তানি। তাদের কাছে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ছিল ‘কালো-খাটো-নেটিভদের’ একটি দেশ। একদিন তাদেরই একজন কেউ রেহমান সোবহানকে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাঙালিদের কেন খরগোশের মতো এত উচ্চ প্রজনন হার?’ বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ রেহমান সোবহান তখন পাঠান ও পাঞ্জাবিদের যৌনপ্রবণতা নিয়ে এমন শক্ত এক জবাব দিয়েছিলেন যে এর পর থেকে তাঁর পাঞ্জাবি সহপাঠীরা কখনো তাঁকে জাতীয় পরিচয় নিয়ে ঘাঁটানোর সাহস পায়নি। যদিও রেহমান সোবহান পাশাপাশি এ গ্রন্থে অকপটে এটাও স্বীকার করেছেন, তিনি বোকার মতো তখন ভাবতেন ‘একই দেশের কীভাবে দুটো জাতীয় ভাষা থাকতে পারে।’ ১৯৫২ সালে চাচা সাইদুজ্জামানকে এ প্রশ্ন করেও ছিলেন তিনি। বিজ্ঞ চাচার উত্তর ছিল, কেন সুইজারল্যান্ডে দুটি জাতীয় ভাষা— ফরাসি ও জার্মান আর কানাডায়ও রয়েছে দুটি ভাষা— ফরাসি ও ইংরেজি। এভাবে নিজ দেশ সম্পর্কে জ্ঞানের আলোয়-আঁধারে কেটে গেছে তাঁর এইচিনসন কলেজের জীবন। এ কলেজ ছেড়ে দেন তিনি ১৯৫২ সালে। কলেজের শেষ বর্ষে ১৯৫২ সালেই তিনি এইচএসসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে উত্তীর্ণ হন এবং লাভ করেন ‘চার্চিল হাউজ স্বর্ণপদক’। কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে বাবার সঙ্গে আরো এক বছর পশ্চিম পাকিস্তানে কাটিয়ে (১৯৫২-৫৩) তিনি অস্থির হয়ে পড়েন পাকিস্তানের বাইরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কেন? তাঁর বাবা তখন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে ঢাকার ট্যানারি ব্যবসায় মালিক হয়েছেন। তিনি রেহমানকে লন্ডনে পাঠালেন এ আশায় যে, সেখানে রেহমান ‘চর্ম শিল্পের সর্বশেষ প্রযুক্তি’ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে দেশে ফিরে এ শিল্পের হাল ধরবেন। লন্ডনে ‘চর্মবিদ্যা’ অর্জনের জন্য কিছুদিন বৃথা চেষ্টা করে, কিছুদিন ক্রিকেট ও ফুটবলের ম্যাচ দেখে এবং কিছুদিন ইংল্যান্ডের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে রেহমান অবশেষে দেখলেন তাঁর কলেজ জীবনের সহপাঠীরা এবং বন্ধু কামাল হোসেন এসে অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের দেখে তাঁর মনে আরো উচ্চতর লেখাপড়ার এক অদম্য স্পৃহা জেগে উঠল। এতে ঘৃতাহুতি দিলেন তাঁর এক বন্ধু ইফতি ইস্পাহানীর বাবা মীর্জা হাসান ইস্পাহানী। তিনি রেহমানকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘হে যুবক, একটি উটকে সুইয়ের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করানো যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন হবে তোমার কেমব্রিজে ভর্তি হওয়া।’

কিন্তু যত কঠিনই হোক, রেহমান সোবহানের হাতে ভর্তি হওয়ার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুঁজি ছিল। প্রথম পুঁজি তাঁর চমত্কার রেজাল্ট ছাড়াও সঙ্গে ছিল তাঁর নানা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ট্রিনিটি কলেজ কেমব্রিজের সাবেক ছাত্রদের থেকে মনোনীত ফেলো স্যার খাজা নাজিমউদ্দিনের পক্ষ থেকে অধ্যক্ষকে লেখা একটি ভর্তির সুপারিশপত্র। এ দুয়ের জোরে অনায়াসে রেহমান সোবহান কেমব্রিজে ‘অর্থনীতি’ বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলেন।

সে সময় কেমব্রিজে পড়াশোনার খরচ খুব বেশি ছিল না। এক বছরের খরচ ছিল মাত্র ৩ হাজার ১৫০ টাকা, যা ছিল পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মচারীদের মাত্র এক মাসের বেতনের সমান। তবে ভর্তি হওয়াটাই ছিল কঠিন। আর পড়াশোনা আয়ত্ত করে টিকে থাকাটা ছিল ততোধিক কঠিন। বাবা রাজি হবেন কিনা, সে বিষয়ে রেহমানের সন্দেহ থাকলেও দেখা গেল তাঁর ‘বিমাতা’ তাঁর পক্ষে থাকলেন। তিনি রেহমানকে বলেছিলেন, ‘জীবনে কোনো বিষয় নিয়ে খেদ করবে না, যদি কেমব্রিজে যেতেই তোমার মন চায়, তাহলে সেখানেই চলে যাও।’ (বইয়ের ১১৯ পৃ. দ্র.)

কেমব্রিজ— রূপান্তরের বছরগুলো

আমি আগেই উল্লেখ করেছি কেমব্রিজ ছিল অধ্যাপক রেহমান সোবহানের জন্য আদর্শগত রূপান্তরের বছর। ১৯৫৩ সালে ১৭ বছর বয়সে কেমব্রিজে তিনি যখন ঢোকেন তখন পর্যন্ত তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ভাবাদর্শে দীক্ষিত হননি। তখন পর্যন্ত তাঁর মনোভাব ছিল কিছুটা নেহরুর বাম ঝোঁকের প্রতি আকৃষ্ট এবং র্যাডিকেল জাতীয়তাবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। নেহরুর লেখা এবং আরএইচ টনির (R. H. Tawney) সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে নৈতিক লেখাগুলোর প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় সহানুভূতি। কিন্তু কেমব্রিজে পড়তে পড়তে এবং কেমব্রিজে অধ্যয়নরত ভারতীয় ও শ্রীলংকার ছাত্রদের নিয়ে গঠিত ‘কেমব্রিজ মজলিস’ সংগঠনে বিভিন্ন পদে (প্রথমে সাধারণ সম্পাদক, পরে সভাপতি) অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় নানা সেমিনারে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল তাঁর রাজনৈতিক আত্মপরিচয় (Identity)। সে সময় যেসব শিক্ষক তাঁর চিন্তাকে কিছুটা র্যাডিকেল দিকে ধাবিত করতে সহায়তা করেছিলেন, নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে তদানীন্তন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও কেমব্রিজের স্বনামধন্য অধ্যাপক মরিস ডব এবং প্রথাবিরোধী অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসনের নাম অগ্রগণ্য। এঁরা উভয়ই ছিলেন একাডেমিক মহলে সমাজতন্ত্র ও মার্ক্সের মতবাদেও ব্যতিক্রমী সমর্থক। আরো যেসব শিক্ষকের নাম এ পর্যায়ে রেহমান সোবহান তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন— নিকোলাস ক্যালডর, নোয়েল আনান, ডেনিস রাবার্টসন, অস্টিন রবিনসন, পিয়োরো স্রাফা ইত্যাদি। এরা সবাই অর্থনীতিশাস্ত্রে ছিলেন একেকজন দিকপাল! কল্পনা করুন আপনি এমন এক জায়গায় পড়াশোনা করছেন, যার করিডোরে ডজনখানেক নোবেল বিজয়ী হাঁটাচলা করছেন। আর সহপাঠীদের মধ্যে আছেন গণ্ডা চার-পাঁচ সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ী! এ পরিবেশে আত্ম-অহংকারের কোনো সুযোগ ছিল না। ছিল নির্মোহ জ্ঞানচর্চার এক অনাবিল আবহাওয়া। তবে সহপাঠীদের মধ্যে আজীবন বন্ধু অমর্ত্য সেনের কথাই সবচেয়ে বেশিবার উল্লেখ করেছেন রেহমান সোবহান। উল্লেখ করেছেন মাহবুবুল হকের (পাকিস্তানের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সের প্রণেতা) কথাও। পাকিস্তান থেকে আসা পদার্থবিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ নোবেল বিজয়ী আব্দুস সালামও তখন কেমব্রিজে একটু উঁচু ক্লাসে পড়তেন। তিন বছর কেমব্রিজে অধ্যয়নকালে (১৭ থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত) যে রূপান্তরিত দৃষ্টিভঙ্গিটি অধ্যাপক রেহমান সোবহান আহরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেটি তাঁর গ্রন্থের ১৪০-৪১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘কেমব্রিজের পাঠচক্রগুলি আমাকে বিশ্বকে নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছিল।’ সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল অনেকটা বাম-জাতীয়তাবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক দৃষ্টিভঙ্গি। রেহমান সোবহান বা অমর্ত্য সেন দুই বন্ধুর কেউই কখনো সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টি বা কমিউনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণ করেননি। তাঁদের আমলে প্রধানত স্ট্যালিন প্রশ্ন নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছিল, তা তাঁদেরকে কমবেশি নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং হয়তো সেই বিতর্কের প্রভাবেই তাঁরা রাজনৈতিকভাবে কমিউনিজমকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পূর্ণ সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে সাধারণ শ্রমজীবী শ্রেণীর দুঃখ-দুর্দশা, শোষণ, নির্যাতন এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধ ও সামরিক জোট গঠন ইত্যাদির বিরুদ্ধে তাঁরা উভয়ই ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। সেন এ প্রগতিশীল চিন্তাধারা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আহরণ করে কেমব্রিজে নিয়ে এসেছিলেন আর রেহমান সোবহান কেমব্রিজের আলোকিত করিডোর ও ক্যাম্পাসের কফির দোকানে দিনভর রাতভর বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে তা শুষে নিয়েছিলেন তাঁর মগজের ভেতরে। অর্জন করেছিলেন তাঁর রূপান্তরিত প্রগতিশীল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি।

কেমব্রিজ থেকে যে নতুন রেহমান সোবহান ২১ বছর বয়সে প্রথমে করাচিতে, পরে স্থলপথে কলকাতা হয়ে ঢাকায় পা ফেললেন, সেই রেহমান সোবহান ছিলেন রোমান্টিক, আত্মবিশ্বাসী এবং বিশ্বজয়ের প্রত্যয়ে দীপ্ত।

রেহমান এরই মধ্যে স্থির করেছেন যে পশ্চিম পাকিস্তান নয়, পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকাই হবে তাঁর নিজস্ব স্থায়ী ঠিকানা। সেখানে তিনি রাজনৈতিক অর্থনীতি চর্চা করবেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ধারাকে সঠিক পথে পরিচালিত ও প্রভাবিত করার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করবেন। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে রিডারের চাকরির অফার দিয়েছিল, অনেকগুলো বহুজাতিক কোম্পানির নিয়োগপত্রও যুবক রেহমানের পকেটে তখন ছিল, বাবাও তাঁকে তখন পশ্চিম পাকিস্তানেই থাকতে বলেছিলেন, আর বাবার পরামর্শ ছিল— ঢাকায় যদি যাওয়াই স্থির হয়, তাহলে সেখানে চামড়া শিল্পে আত্মনিয়োগ করা হোক! কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে ভবিতব্যের অমোঘ বিধানের মতো রেহমান সোবহান ঢাকার দিকেই ছুটে এসে থিতু হলেন। হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তরুণতম রিডার।

রেহমান সোবহানের অশান্ত ঢাকা জীবন

আলোচ্য বইয়ের সপ্তম থেকে চতুর্দশ অধ্যায় পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে রেহমান সোবহানের ঢাকাই জীবন। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তরুণ শিক্ষক, পরবর্তীতে পাকিস্তানের ভেতরে একজন স্বায়ত্তশাসনের দুঃসাহসী প্রবক্তা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে অন্যতম রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ বা এর একজন একনিষ্ঠ মুখপাত্রের ভূমিকায় তাঁকে এ সময় উজ্জ্বল ও সোচ্চার হতে দেখেছি আমরা। এ সময়ই তাঁর মানসে জন্ম নিয়েছিল সেই বহুকথিত ‘নতুন বাংলাদেশের রূপকল্প’। এটাই সেই বিখ্যাত ষাটের দশক, যেখানে একটু পরেই শুরু হয়ে যাবে এমন এক চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ, যেখানে রেহমান সোবহান রূপান্তরিত হবেন তাঁর নিজের ভাষাতেই পলিটিক্যাল ইকোনমিস্ট (রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ) থেকে পলিটিশিয়ান ইকোনমিস্ট (রাজনীতিবিদ অর্থনীতিবিশারদ)-এ। এ পর্বে রেহমান সোবহানের স্মৃতিচারণ শুধু আর ব্যক্তিগত আত্মকথনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছে একটি ইতিহাস— পাকিস্তানের মৃত্যু এবং বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেহমান সোবাহান যোগদান করেন ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে। আর ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে তিনি বাধ্য হন তাঁর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেয়ার জন্য ছদ্মবেশে বহু পথ হেঁটে ভারতে যেতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাঁর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপায়ণ ক্ষেত্র। শিক্ষক হিসেবে অর্থনীতি বিভাগে তাঁকে শুরু করতে হয়েছিল প্রথম বর্ষে ‘অথনৈতিক ইতিহাস’ বিষয়ে পাঠদানের মাধ্যমে। তাঁর প্রিয় দুটি বিষয় তিনি পড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন— একটি ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ইতিহাস’ এবং অন্যটি ‘আমেরিকার অর্থনৈতিক ইতিহাস’। প্রথমটির জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন Maurice Dobb-এর নোটস আর দ্বিতীয়টির জন্য ব্যবহার করেছিলেন Frank Thistlewaite-এর নোটস। কিছুদিন পর ডিপার্টমেন্টের তদানীন্তন চেয়ারম্যান মীর্জা নুরুল হুদা তাঁকে এমএ ক্লাসের ছাত্রদের Monetary Theory পড়ানোর দায়িত্ব দেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। ওই সময় এমএ ক্লাসের কোনো কোনো ছাত্র ছিলেন বয়সে তাঁর চেয়ে বেশি। কিন্তু রেহমান সোবহান ঘাবড়াননি। এরপর ১৯৬০ সালে রেহমান নিজেই উদ্যোগী হয়ে বিভাগে একটি নতুন কোর্স চালু করতে সক্ষম হন ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস এবং নিজেই তাঁর এ প্রিয় বিষয়টি পড়াতে শুরু করেন।

এছাড়া যখন নতুনভাবে পাঠক্রমে ‘পাকিস্তানের অর্থনীতি’ বিষয়টি চালু হলো, তখন সেটার পাঠদানের দায়িত্বও রেহমানের ওপর বর্তায়। তাঁর এসব প্রিয় বিষয়ে পাঠদান, গবেষণা ও গবেষণালব্ধ নতুন জ্ঞানের প্রচারের মাধ্যমে তিনি ক্রমে ছাত্রদের সচেতন করে তুললেন বিদ্যমান বাস্তব অর্থনৈতিক জটিলতাগুলো সম্পর্কে। পাকিস্তানের অর্থনীতি পড়াতে গিয়ে তিনি সেখানে নিয়ে এলেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিকাশমান আঞ্চলিক বৈষম্যের বিবরণ। ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করলেন নানাভাবে ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনারে তিনি ও তাঁর সচেতন ছাত্ররা ক্রমাগত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে নাজেহাল করতে লাগলেন পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর শীর্ষ ব্যক্তিদের।

এ সময় অর্থনীতি বিভাগে তাঁর সহকর্মী ও ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম তিনি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এসব শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক মকসুদ আলী, অধ্যাপক মাযহারুল হক, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এবং আবু মাহমুদের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সেই সময়কার উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ (সাবেক প্রধান উপদেষ্টা), মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম (সাবেক অর্থ উপদেষ্টা), ড. মুহাম্মদ ইউনূস (নোবেল বিজয়ী— গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা), এ. আর. খান (বামপন্থী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ), স্বদেশ বোস (বামপন্থী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ), রাশেদ খান মেনন (বিখ্যাত বামপন্থী রাজনীতিবিদ) প্রমুখ। এ সময় তাঁকে প্রতি সপ্তাহে ৬ ঘণ্টা লেকচার (দুটি বিষয়ের প্রত্যেকটি বিষয়ে ৩ ঘণ্টা করে) এবং ৬ ঘণ্টা টিউটোরিয়াল ক্লাস নিতে হতো। বিএ ক্লাসে ছাত্র ছিল গড়ে ৫০ জন। এমএ ক্লাসে ৬০ থেকে ৭০ জন। ক্লাসে অধ্যাপক সোবহান ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতেন নিজে নিজে চিন্তা করে জ্ঞান আহরণের জন্য। তিনি লেকচার মেথডে বিশ্বাসী ছিলেন না। যদিও স্যারের লেকচার আমরা যারা শুনেছি, তারা জানি তা কত মনোমুগ্ধকর হতে পারে। (চলবে)

অধ্যাপক রেহমান সোবহান লিখেছেন, কেমব্রিজ পড়াকালে এমএতে তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল প্রতি সপ্তাহে একক ছাত্র হিসেবে জোয়ান রবিনসনের সঙ্গে মুখোমুখি প্রতি সপ্তাহে ১ ঘণ্টা করে ‘টিউটোরিয়াল’ করার। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এত পাতলা হয়নি যে একজন শিক্ষক একজন ছাত্রের টিউটোরিয়াল নেবেন। ফলে রেহমান সোবহান যেটি করেছিলেন তা হচ্ছে, পাঁচ-ছয়জন করে ছাত্র নিয়ে একেকটি টিউটোরিয়াল গ্রুপ গঠন এবং গ্রুপের মধ্যে ছাত্রদের দিয়ে পেপার তৈরি করে তা উত্থাপন করানো এবং তার ওপর সবাই মিলে আলোচনা করার ব্যবস্থা করা। এ ব্যবস্থা ছাত্রদের মধ্যে নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা এবং গবেষণা করার প্রেরণা জোগাতে সক্ষম হয়েছিল। এ সময় অধ্যাপক সোবহান পত্রপত্রিকায় বহু রাজনৈতিক কলামও লিখেছেন। বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে বক্তব্য রেখেছেন। একাডেমিক এক্সচেঞ্জের আওতায় অনিয়মিতভাবে দেশ-বিদেশে ঘুরেও এসেছেন। ঢাকার সন্ধ্যাকালীন দেশী-বিদেশী অভিজাত আড্ডাগুলোয়ও তিনি ছিলেন একজন নিয়মিত অংশীদার। বিদেশীরাও সেসব আড্ডায় যোগ দিতেন। সেসব আড্ডায় যোগদানকারী বিদেশী দূতাবাসের বিশেষত আমেরিকান দূতাবাসের সদস্যরা তাঁকে বিশ্বাস না করলেও তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। কারণ তাঁদের ধারণা ছিল বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রাজনেতিক অসন্তোষের সঠিক খবরটি তিনিই দিতে পারবেন। এ সময়ে নিজের আত্মপরিচয় বর্ণনা করতে গিয়ে স্যার লিখেছেন:

‘কিছু কিছু মহলে আমাকে তখন মনে করা হোত, আমি যেন এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সামুদ্রিক পাখি, পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী এবং তার বহিস্থ পৃষ্ঠপোষক, উভয়ের কঠোর সমালোচনায় সদা প্রস্তুত এক ব্যক্তি।’ (পৃ.- ২১০ দ্র.)

অধ্যাপক সোবহান এ সময় রাজনীতির দিকে কতখানি তীব্রভাবে ঝুঁকে পড়েছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে একটি রোমান্টিক ঘটনার বর্ণনায়। বেশ খোলামেলা কিন্তু সত্যনিষ্ঠ ও সংযত ভাষায় রেহমান সোবহান বর্ণনা করেছেন তদানীন্তন ভাস্কর্য শিল্পী নভেরা আহমেদের সঙ্গে তাঁর সখ্য এবং তা নিয়ে ঢাকা শহরে ফিসফাস গুজবের কথা। ১৯৬১ সালে রেহমান সোবহান তখন ২৫ বছরের অবিবাহিত রোমান্টিক সুদর্শন এক যুবক। নভেরা আহমেদও ছিলেন একাকী নারী। নভেরার একক গৃহে রেহমানের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। কিন্তু নভেরা ও রেহমানের রোমান্টিক পর্বটি কেন সেদিন আরো বেশি অগ্রসর হলো না, তার সমাপ্তি কেন দ্রুত টেনে দিতে হলো, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বর্তমান সময়ের পরিণত রেহমান সোবহান লিখেছেন:

‘আমি নভেরার শৈল্পিক মনোভঙ্গির ব্যাপারে অসংবেদনশীল ছিলাম না, কিন্তু আমি তখন আমার জীবনের ভিন্ন এক রাজনৈতিক পর্বের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছিলাম, আমরা দুজনেই বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের দুজনের জগৎ একদমই আলাদা এবং সবসময়ই তা দুই পৃথক মেরুতেই অবস্থান করবে।’

এ ঘটনার এক বছর পরই রেহমান সোবহান তাঁর প্রথম জীবনসঙ্গিনী হিসেবে ‘সালমা হোসেনকে’ বেছে নেন বা অধ্যাপক সোবহানের ভাষায়, সালমা হোসেনই তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হন। সালমা হোসেনের চাচা ছিলেন পাকিস্তানের তদানীন্তন অন্যতম বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যার হাত ধরে বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনীতির যাত্রা হয়েছিল। সোহরাওয়ার্দী পরিবার ছিল পাকিস্তানের দু-চারটি অভিজাত পরিবারের মধ্যে একটি। আর বিদুষী সালমা হোসেন ছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম সর্বকনিষ্ঠ ব্যারিস্টার (মাত্র ২১ বছর বয়সে) এবং সমগ্র পাকিস্তানের দ্বিতীয় মহিলা ব্যারিস্টার। অধ্যাপক সোবহানের বর্ণনা থেকে আমরা আরো জনতে পারি, ইচ্ছা করলে সালমা হোসেন পাকিস্তানের যেকোনো উচ্চবিত্ত-উচ্চপদস্থ অভিজাত কাউকে স্বামী হিসেবে বেছে নিতে পারতেন। অথবা প্যারিসে নিজের অর্জিত ব্যক্তিগত স্কলারশিপ নিয়ে চলে গিয়ে সেখানে সিন নদীর তীরে বসে তাঁর উপন্যাস লেখার আজন্ম লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারতেন। কিন্তু কেন যে তিনি সে পথে না হেঁটে মধ্যবিত্ত রেহমান সোবহানকে বেছে নিলেন, তা আজো অধ্যাপক সোবহানের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। এ বইয়ে রেহমান সোবহান ও সালমা সোবহান— এ দুই পাখির প্রথম সংসার যাত্রার একটি নিটোল সুখী বর্ণনা আছে (২২৪-২২৮ পৃ.), তা আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।

রাজনীতির ডামাডোলে অধ্যাপক সোবহান

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন চালু হয়। আইয়ুব খান আজম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠান। আজম খান অবশ্য তার গণতন্ত্র প্রীতির কারণে ওই পদে বেশি দিন স্থায়ী হননি। তবে পদত্যাগ করে ফিরে যাওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উপকার তিনি করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরাচারী ভিসি পল নিউম্যানকে তিনি বরখাস্ত করে দিয়ে যান। কারণ হিসেবে যে ঘটনা এর পেছনে কাজ করেছিল, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির তদানীন্তন সম্পর্কের বিষয়ে আলোকপাত করে। দুর্ভাগ্যবশত সে ধরনের সম্পর্কের জের আজো অব্যাহত আছে। সে ঘটনায় সেদিন তদানীন্তন ভিসি নিউম্যানকে মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা ঘেরাও করেছিল, কারণ ওই বিভাগের বিখ্যাত ছাত্র তালুকদার মনীরুজ্জামানকে ষড়যন্ত্র করে কম নম্বর দিয়ে প্রথম শ্রেণী থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, ঠিক তখনই এনএসএফের (সরকারি ছাত্রদল বা মস্তান বাহিনী) পাণ্ডারা নিউম্যানকে বাঁচানোর জন্য ঘেরাওকারী সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রেহমান সোবহান। তিনি লিখেছেন, পরে এটি নিয়ে খুব হইচই হয়, কাগজে লেখালেখি হয় এবং অবশেষে আজম খান নিউম্যানকে প্রত্যাহার করে নেন।

এ ধরনের ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে রেহমান সোবহান জড়িয়ে পড়েন আইয়ুববিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ছাত্ররাজনীতির অনেক কাছে তিনি নেমে আসেন। হরতাল-স্ট্রাইক এসব আন্দোলনে প্রকাশ্য সমর্থন দেয়ার কারণে পুলিশের নজরে এসে যান তিনি। এমনো হয়েছে, কখনো কখনো এ সময় তাঁকে আত্মগোপনেও থাকতে হয়েছে।

১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থনীতি বিভাগের অন্যতম সিনিয়র শিক্ষক আবু মাহমুদের ওপর মোনেম খানের অনুচর এনএসএফ বাহিনী হামলা চালায়। এর পেছনে অবশ্য অর্থনীতি বিভাগের একটি প্রশাসনিক অন্যায় জড়িত ছিল। আবু মাহমুদ, কে.টি হোসেন ও রেহমান সোবহান এ তিনজন তখন বিভাগের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন আর গনি সাহেব ছিলেন সরকারের বিশ্বস্ত ভিসি। এ সময় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বিভাগীয় চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে করাচিতে চাকরি নিয়ে চলে যান। সুযোগ পেয়ে আবু মাহমুদকে ডিঙিয়ে জুনিয়র শিক্ষক কে.টি হোসেনকে চেয়ারম্যান পদে বসানোর নির্দেশ দেন ভিসি ওসমান গনি। আবু মাহমুদ আদালতে তা চ্যালেঞ্জ করেন এবং মামলায় জয়ী হয়ে বিভাগের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। এ তথাকথিত অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই প্রশাসনিক মদদ নিয়ে এনএসএফের গুণ্ডা বাহিনী সেদিন আবু মাহমুদকে আক্রমণ করে আহত করে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন রেহমান সোবহান এবং অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে না নেয়া পর্যন্ত তাঁর পাশেই তিনি ছিলেন। রেহমান সোবহান লিখেছেন, এ ঘটনার পর তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজ্জাক স্যারের বাসায় গিয়ে তাঁকে এক হতভম্ব বিমূঢ় অবস্থায় দেখেন। এ অকল্পনীয় ঘটনার কারণে সেদিন অধ্যাপক রাজ্জাক তার ঘরের মেঝেতে বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন এবং পরের কয়েকটি দিন কোনো কথাই বলতে পারেননি। এ ঘটনায় বিরোধী দলের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিলেন। তারা ভিসির পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। হলে হলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে এনএসএফের লাঠালাঠি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঢাকাসহ সারা দেশ অশান্ত হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু কিছু বিরোধিতার পর পুনরায় সব ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অন্ধকারের কালো থাবা নেমে আসে। কে.টি হোসেন পুনরায় চেয়ারম্যান নিয়োজিত হন, আবু মাহমুদের আক্রমণকারীরা শনাক্ত হলেও তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। এমনকি প্রফেসর রাজ্জাককেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র শুরু হলে তিনি অবশেষে ১৯৬৭ সালে ছুটি নিয়ে ইংল্যান্ড চলে যান। আনিসুর রহমানও তখন পর্যন্ত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। প্রফেসর নুরুল ইসলামও তখন পূর্ব পাকিস্তানে নেই। স্বয়ং আবু মাহমুদ অহর্নিশি হুমকিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে অবশেষে পদত্যাগ করে ইউএনওতে চাকরি নিয়ে ব্যাংককে চলে গিয়েছিলেন। অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদও যারপরনাই বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ করে দেশের ভেতরেই ইউনাইটেড ব্যাংকের অর্থনৈতিক পরামর্শক পদে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এ যেন অনেকটা ‘একে একে নিভেছে দেউটির’ মতো অবস্থা।

এ সাময়িক অন্ধকার অবস্থায় অধ্যাপক সোবহানও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে এলএসইতে চলে যান। উদ্দেশ্য, পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা নিয়ে গবেষণা করে হয় একটি ডিগ্রির জন্য অভিসন্দর্ভ রচনা করবেন অথবা অন্তত একটি পুস্তক রচনা করবেন। যদিও সেইবার তার দ্বারা এর কোনোটিই সম্ভব হয়নি। রেহমান সোবহানের ভাষ্য অনুযায়ী, এ সময় লন্ডনে তাঁর বিস্তর লেখাপড়া হয়েছিল, কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ব্যুত্পত্তি অর্জন বনাম রাজনীতিবিদ হিসেবে সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা এ দুই আকাঙ্ক্ষার যে কষ্টকর টানাপড়েন তখন তার মনে চলছিল, সেটিই ছিল এ ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। তিনি তত্ত্বচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারলেন না। ১৯৬৯ সালে আইয়ুবের পতনের পরপরই ঢাকায় ফিরে এসে বাস্তব কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

দুই অর্থনীতির প্রবক্তা রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান

রেহমান সোবহানের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক সত্তাকে বোঝার জন্য আমরা আবার একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই। ১৯৬১ সালের জুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ‘দুই অর্থনীতি’ শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আয়োজক ছিলেন যুক্তভাবে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহান। পাকিস্তান যে আসলে একটি কিম্ভূত রাষ্ট্র, যার দুটি অংশের মাঝে রয়েছে হাজার মাইলের ব্যবধান এবং এ অবস্থায় এর দুই প্রাদেশিক অর্থনীতির মধ্যে যে অনেকখানি বিচ্ছিন্নতা ও সমন্বয়হীনতার সমস্যা থাকবেই, তা সাধারণ জ্ঞানে স্বতঃপ্রতীয়মান। কিন্তু তা সত্য হলেও এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সুস্পষ্ট ও সরাসরি বক্তব্য প্রদান করাটা অত সহজ ছিল না। ওই সেমিনারে তাই আড়াল বা ছাতা হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা তদানীন্তন পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চিফ হাবিবুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বক্তব্য রাখতে। তিনিও তখন পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের ভেতরে নিজের ভিন্ন কণ্ঠস্বর প্রকাশে অস্বস্তি বোধ করছিলেন এবং আইয়ুব খানের কোপ নজরে ছিলেন। ফলে এ সুযোগ সানন্দে তিনি গ্রহণ করেন এ আশায় যে, একাডেমিক সেমিনারের মুক্ত পরিবেশে অনেক কঠিন সমালোচনা সহজে ব্যক্ত করা সম্ভব হবে। কিন্তু সেদিন ঘটনা সেভাবে সহজে অগ্রসর হয়নি। ওই সেমিনারে আরেকজন প্রবন্ধ উপস্থাপক ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তাঁর বক্তব্য ঘিরে সারা দেশে তৈরি হলো এক নতুন টেনশন। পরদিন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় দুটি পরস্পর বিপরীত সংবাদ বিপরীত হেড লাইনে প্রকাশিত হলো— একটি ‘আইয়ুব খান বলেন পাকিস্তানের মাত্র একটি অর্থনীতি আছে’, আরেকটি হেডলাইন ছিল ‘রেহমান সোবহান বলেন পাকিস্তানের দুটি অর্থনীতি আছে’। ফলে তখন সারা দেশে বিশাল এক হইচই সৃষ্টি হলো। এভাবে মাত্র ২৬ বছর বয়সে রেহমান সোবহান রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠলেন এবং রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন।

ওই বছর অক্টোবরে রেহমান সোবহানের আরেকটি লেখা অবজারভার পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি যুক্তি দিয়ে দেখান, পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো, দুই প্রদেশকেই সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদান করা। বিনয়ের সঙ্গে অধ্যাপক সোবহান অবশ্য স্বীকার করেছেন, বিষয়টি এমন নয় যে, তিনি একাই শুধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, দুই অর্থনীতি, আঞ্চলিক বৈষম্য ইত্যাদি বিষয়ে বলেছেন বা লিখেছেন, তাঁর পাশাপাশি আগে-পরে অনেকেই সমধর্মী বক্তব্য তখন দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন— ড. এ সাদেক, ড. নুরুল ইসলাম, ড. হাবিবুর রহমান, ড. আখলাকুর রহমান ও ড. মোশাররফ হোসেন। তাছাড়া ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময়েই বাঙালি অর্থনীতিবিদদের প্যানেলের পক্ষ থেকে অনুরূপ বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন আমাদেরকে প্রফেসার সোবহান। অধ্যাপক সোবহানের আরেকটি প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্ম হচ্ছে— ‘Basic Democracies: Works Programme and Rural Development in East Pakistan’. গবেষণাটি তিনি করেছিলেন ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের অধীনে ১৯৬৬ সালে। এর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল তদানীন্তন ক্ষমতা কাঠামোর অংশীদার গ্রামীণ ৮০ হাজার বিডি মেম্বার। আইয়ুবি বুনিয়াদি গণতন্ত্রের মডেলে সামরিক সরকারের ক্ষমতা কাঠামো গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত করার তাগিদে গ্রামে গ্রামে এ প্রভাবশালী মৌলিক গণতন্ত্রীদের সৃষ্টি করা হয়েছিল। এদের তথাকথিত ‘উন্নয়ন কর্মের’ অর্থের জোগান এসেছিল আমেরিকান পিএল ৪৮০-এর সস্তা গম বিক্রির টাকা থেকে।  (চলবে)

লেখক: অর্থনীতিবিদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক