রাজনৈতিক মতৈক্য ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হবে না: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in The Daily Star on 6 February 2023

এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর ৬ষ্ঠ বার্ষিক অর্থনৈতিক কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে এ কথা বলেন তিনি।

আগামীতে সকল রাজনৈতিক শক্তি সমঝোতায় না আসলে গত দেড় দশকে অর্জিত উন্নয়নকে টেকসই করা সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা না গেলে এসডিজি বাস্তবায়ন, এলডিসি থেকে উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের মতো লক্ষ্যগুলো অর্জন করা সমস্যাপূর্ণ হয়ে যাবে।

রোববার এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর ৬ষ্ঠ বার্ষিক অর্থনৈতিক কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে এ কথা বলেন তিনি।

ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, “রাজনৈতিক শক্তি সমঝোতায় না আসলে, সামাজিক শক্তি এগিয়ে আসে। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন এরই অংশ।”

‘বিল্ডিং রেজিলিয়েন্স টু শকস: প্রায়োরিটিস, চ্যালেঞ্জস অ্যান্ড প্রসপেক্টস’ স্লোগানে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সম্মেলনের ষষ্ঠ আসর।

‘দ্য পাওয়ার ডাইনামিকস বিটুইন স্টেট অ্যান্ড বিজনেস: হাউ ইজ ক্যাপিটালিজম ইভলভিং ইন বাংলাদেশ?’ শীর্ষক অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক রওনাক জাহান।

প্যানালিস্টের বক্তব্যে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “অতীতে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে সমস্যার সমাধান হয়েছে। ১৯৯১ সালে সুশীল সমাজের দেওয়া রূপরেখার আলোকে নির্দলীয় সরকার গঠন হয়েছে। ১৯৯৬ সালে একটি খারাপ নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয়েছিল।”

আর শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবেই ২০০৬ সালে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা চলে গিয়েছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান সেশনে ‘স্টেট-বিজনেস রিলেশনস অ্যান্ড দ্য নেচার অফ দ্য ইভলিউশন অফ ক্যাপিটালিজম ইন বাংলাদেশ: সাম টেনটেটিভ অবজার্ভেশন’ শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন।

তিনি বলেন, “স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে গণ্য না হলেও পরবর্তী সময়ে তাদের ভূমিকা বাড়তে থাকে। ওই সময়ে ব্যবসায়ীদের সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন খাতে চেম্বার, অ্যাসোসিয়েশন গঠন, শক্তিশালীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হতে থাকে। পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে জাতীয় বাজেটে করের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আলোচনাও শুরু হয়।”

“৯০’র দশকের পর গণতন্ত্রের পুনঃসূচনা এবং অর্থনীতির উদারীকরণের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে লিবারেল ক্যাপিটালিজম প্রতিষ্ঠা পাবে বলে ধারণা করা হলেও, রাজনৈতিক শক্তির বিভিন্ন স্বার্থ আর ক্যাপিটালিস্ট এলিটদের (পুঁজিবাদী ধনিক শ্রেণি) কারণে এটি সম্ভব হয়নি,” যোগ করেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে সবাই আলোচনা করলেও রাজনীতিবিদরা কেনো ব্যবসায় নামছেন, এমন আলোচনায় কেউ উৎসাহী হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

অধিবেশনের ফ্লোর ডিসকাশনে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীরা কেন রাজনীতিতে আসছেন তা নিয়ে সবাই আলোচনা করছেন, কিন্তু রাজনীতিবিদরা কেন ব্যবসায় আসছেন তা নিয়ে কেউই কথা বলছেন না।”

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সরকার ও জনগণের সম্পদ লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে দেশের বণিক শ্রেণি পুঁজি গঠন করেছে বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর পরিত্যক্ত সম্পদ লুটপাট, পরবর্তী সময়ে বিদেশি সহায়তা থেকেও লুটপাট এবং আশির দশকে রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে।

“৯০ দশকের পরে শেয়ারবাজার থেকে কারসাজির মাধ্যমেও টাকা হাতানো হয়েছে। বর্তমানে সরকারি প্রকল্পের ব্যয় অতিমূল্যায়িত করেও টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি শ্রেণি। রাষ্ট্র ও জনগণকে শোষণ না করে আগামীতে দেশের পুঁজিবাদকে কতটা এগিয়ে নেওয়া যাবে, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে,” যোগ করেন ড. দেবপ্রিয়।

বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন)-এর প্রতিষ্ঠাতা ড.নজরুল ইসলাম বলেন, “১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশে সমাজতন্ত্রীরা তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ছিল। বণিক শ্রেণি সম্পূর্ণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে না পারায়, রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বায়ত্তশাসন ছিল। সেই সময়ের অর্থমন্ত্রীরা তুলনামূলক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।”

“কিন্তু পরে ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করেছে। সংসদসহ সব জায়গায় তাদের প্রভাব বেড়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তাদের কথা শুনতে হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।

উদাহারণ দিয়ে তিনি বিলেন, “গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দেশে চারগুন করে মূল্যস্ফীতি হলেও ডলারের তুলনায় টাকার মান প্রায় একই জায়গায় রাখা হয়েছে প্রভাবশালীদের স্বার্থে। এটি করতে গিয়ে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বড় একটি অংশ ছাড়তে হয়েছে। দেশ বিপদে পড়ে যাওয়ায় এখন শর্ত মেনে আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে।”

বাংলাদেশে রাজনীতি করতে তুলনামূলক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় বলে মন্তব্য করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান।

তিনি বলেন, “যুক্তরাজ্যে এমপি হতে হলে ৮০ হাজার ডলার লাগে। আর ভোলায় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হতে হলে ব্যয় করতে হয় দেড় কোটি টাকা।”

“রাজনীতির খরচ বেড়ে গেলে আদানি, ট্রাম্পের মত লোকের জন্ম হবে। রাজনীতির খরচ কমাতে না পারলে লিবারেল ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না,” বলেন তিনি।

এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের প্রফেসরিয়াল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট স্বপন আদনান বলেন, ব্যবসায়ীরা যে শুধু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, শুধু তেমনটি নয়। তারা নিজেরাই রাজনীতিক হয়ে যাচ্ছেন।

“শ্রমিকদের স্বর্থের বিষয়টি দেখার কেউ নেই এখানে। তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও কেটে নেওয়া হচ্ছে। শ্রমঅধিকার ও ট্রেড ইউনিয়নে দুর্বলতদার কারণে তারা এখানে বঞ্চিত হচ্ছেন,” যোগ করেন তিনি।