উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির দায় না থাকার পরও মূল্যবৃদ্ধির ভুক্তভোগী ভোক্তা – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in The Business Standard on 1 March 2023

ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিইউনিট বিদ্যুতের দাম আরো ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৫ পয়সা করেছে সরকার। এতে মূল্যস্ফীতির এই সময়ে আরো হতাশাই বাড়লো জনতার। কারণ, চলতি বছরেই এনিয়ে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো।

এতে আবাসিক গ্রাহক, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আরো চাপের মধ্যে পড়লো, যখন সবাই কৃচ্ছ্রসাধনের চেষ্টা করছে।

গত দুই মাসে এনিয়ে তৃতীয়বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো; এতে যেসব বাসাবাড়িতে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় তাদের মাসিক বিল বাড়বে ১৮২ টাকা। যেসব আবাসিক গ্রাহক ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে এটা হবে ২৮৫ টাকা।

তবে একটি প্রক্ষেপণ অনুসারে, এই দাম বাড়ানোয় বছরে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় হবে সরকারের।

জানুয়ারির আগে প্রতিকিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের খুচরা বা ভোক্তা পর্যায়ে গড় দাম ছিল ৭ টাকা ১৩ পয়সা, যা এখন পৌঁছাল ৮ টাকা ২৫ পয়সায়।

মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুসারে, নতুন দাম আজ ১ মার্চ থেকেই কার্যকর হবে।

এর আগে গত ১২ ও ৩০ জানুয়ারি দুইবার ৫ শতাংশ করে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের সাথে দাম বাড়ানোর সময়কালের মিল ছিল।

একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর আর্থিক সক্ষমতা সীমিত, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনায় তাদের জন্য বিল উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। ফলে অত্যাবশ্যক পণ্য বা সেবা কেনা তাদের পক্ষে আরো কঠিন হয়ে যাবে।

অর্থকড়ির টানাটানি থাকায়, অনেক ক্ষেত্রেই এসব পরিবারকে খরচের অগ্রাধিকার খাত ঠিক করতে হয়। তাই বাড়তি বিদ্যুৎ বিল দিতে হলে- খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদার পেছনে তাদের ব্যয় কমাতে হবে।

কৃষকের জন্যও ‘খাঁড়ার ঘা’ হতে চলেছে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, অচিরেই যার পরিণাম দৃশ্যমান হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এটা হচ্ছে বোরো ধান রোপণের মওসুম, এই সময়ে উৎপাদিত ফসল- দেশের ৫৪ শতাংশ চালের চাহিদা পূরণ করে। বোরো আবাদ সম্পূর্ণরূপে সেচ-নির্ভর। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনায় ফসলের উৎপাদন খরচও বাড়বে।

“আগে ডিজেলেরও দাম বাড়ানো হয়েছে। এসব দাম বৃদ্ধির ঘটনায় বিপাকে পড়েছে কৃষক, এতে তারা কম সেচ দিতে বাধ্য হবে। আর সেচ কমানোর অর্থই হলো ধান উৎপাদন ব্যাহত হবে”- বলছিলেন তিনি।

জাহাঙ্গীর আলম খান পরামর্শ দেন, এই পর্যায়ে সরকার কৃষকদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য নগদ সহায়তা বা ভর্তুকি দিতে পারে, এতে তারা প্রত্যাশিত পরিমাণে ধান উৎপাদন করতে পারবে।

বিদ্যুতের আরেক দফা দাম বাড়ানোর আঘাত সামলানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির জন্য অতি-গুরুত্বপূর্ণ তৈরি পোশাক খাত-ও।

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন- ফেডারেশন অব দ্য বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-র সভাপতি জসীম উদ্দিন বলেন, ‘গত এক বছরে সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে বার বার বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। এতে আমরা উৎপাদনের সক্ষমতা কমছে এবং আমরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও হারাচ্ছি’।

ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, সিংহভাগ বোঝাটা বহন করে ভোক্তা – উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যারা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছেন।

এফবিসিসিআই- এর সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বোঝাট ভোক্তার ওপরই পড়বে’।

‘সরকার আমাদের (ব্যবসায়ীদের) বলছে, জিনিষপত্রের দাম না বাড়াতে। কিন্তু, বিদ্যুতের দাম বার বার বাড়ানো হচ্ছে। বাড়তি এই ব্যয় সমন্বয় না করলে– আমরাই বা কীভাবে টিকে থাকব?’- প্রশ্ন রাখেন তিনি।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামালের মতে, জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রভাব ইতোমধ্যেই শিল্পখাতের মুনাফা সীমায় প্রভাব ফেলেছে।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কামাল বলেন, ‘শেষমেষ এই দাম বৃদ্ধির বোঝা ভোক্তাকেই বইতে হবে’।

অনেকেই এই বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তবে এতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই।

এর আগে গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীতে বিদ্যুৎ ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জানান, এখন থেকে সরকার প্রতি মাসে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করবে। এই লক্ষ্যে একটি গাইডলাইনও তৈরি করা হচ্ছে।

তবু এ পদক্ষেপকে অনিশ্চিত-ই বলছেন ব্যবসায়ীরা

বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, ব্যবসা পরিচালনাতে সরাসরি প্রভাব ফেলায় – ব্যবসায়ীরা জ্বালানি ও বিদ্যুতের একটি নির্ভরযোগ্য মূল্য নির্ধারণ চান।

‘ডেলিভারির অন্তত তিন মাস আগে আমরা অর্ডার নেই, তাই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির একটি অনুমানযোগ্য মূল্য নির্ধারণ করা হোক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা’।

তিনি জানান, গত জানুয়ারিতে গ্যাসের দাম বাড়ার পর অনেক কারখানাই বিদ্যুতের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। কিন্তু, দুই মাসে তিনবার বিদ্যুতেরও দাম বাড়ানোয় বিদ্যুৎ বিল দেওয়া আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, আর তাতে উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে।

‘এখন আমরা যদি পণ্যের দাম বাড়াই, তাহলে বিক্রিতে ভাটা পড়বে; এভাবে চলতে থাকলে কারখানাগুলো বন্ধ হতে থাকবে, মানুষের বেকারত্ব বাড়বে’- সতর্ক করেন তিনি।

স্থানীয় চিন্তক সংস্থা- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধির পেছনে কোনো দায় না থাকার পরও ভোক্তাদের মূল্যবৃদ্ধির ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, অত্যধিক ক্যাপাসিটি চার্জ, উচ্চ দামে বিদ্যুৎ ক্রয় এবং ক্রয় চুক্তিতে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনাও সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ্যে এসেছে। এসবের দায় কেন সাধারণ ভোক্তাকে নিতে হবে। মোয়াজ্জেম বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়বে, কৃষকের জন্যও সেচও হবে আরো ব্যয়বহুল, এতে ধান ও চালের দাম বাড়তে চলেছে বলাই বাহুল্য।

এর আগে, গণশুনানি ছাড়াই গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের ক্ষমতা সরকারকে দিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন-২০০৩ এর সংশোধনী পাশ হয় জাতীয় সংসদে। সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধিও এই ক্ষমতার বলে করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

এর আগে বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর দেওয়া মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠানের পরই গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন দাম নির্ধারণের ঘোষণা দিত বিইআরসি।

সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক ক্ষতিপূরণের যুক্তি দিয়ে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো খুচরা/ ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫.৪৩ শতাংশ এবং পাইকারিতে ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়।

আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কোনো প্রকার গণশুনানি ছাড়াই ডিজেল, অকটেন, কেরোসিন ও পেট্রোলের দাম সমন্বয় করতো। অন্যদিকে, শুনানির মাধ্যমে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ঠিক করতো বিইআরসি।

এনিয়ে চতুর্থবারের মতো গণশুনানি ছাড়া বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর নতুন-লদ্ধ ক্ষমতার প্রয়োগ করলো বাংলাদেশ সরকার।