উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্ব দিতে হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in দেশ রুপান্তর on 22 May 2022

কোভিড-পরবর্তী চাহিদা-সরবরাহে অমিল ও জাহাজভাড়া বৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে। মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দেয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে আমদানি-রপ্তানিতে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতিতে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বেড়েছে। ডলার সংকটে টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। এরপরও ডলারের সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত হারের চেয়ে ব্যাংক ও খোলাবাজারে অস্বাভাবিক মূল্যে কেনাবেচা হয়েছে ডলার, যা দেশের ইতিহাসে ডলারের সর্বোচ্চ দর। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে। দেশের এমন সংকটময় পরিস্থিতি উত্তরণে করণীয় নিয়ে দেশ রূপান্তরের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ ইরশাদের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্ট দুই অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান

ডেফিনেটলি চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি। হঠাৎ করে আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। ডলারের ওপরে চাপ পড়ার এটা একটা কারণ। আবার রেমিট্যান্সও কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। এগুলোতে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। আমার মনে হয় এসব সামাল দেওয়ার জন্য আমদানিটা একটু যৌক্তিককরণ করা দরকার। আমদানি যেভাবে বেড়ে যাচ্ছিল তাতে ডলারের ওপর চাপ পড়েছে বেশি। গুড প্রডাক্টস মেশিনারিজ আমদানি হচ্ছিল বেশি। সব কি মেশিনারিজে ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে? আমদানি করা এসব মেশিনারিজ প্রডাকশনে গেছে কি না, এটাও দেখতে হবে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশের আমদানি ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। তবে রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও আমদানির তুলনায় তা কম থাকা ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় লেনদেন ভারসাম্যে সবচেয়ে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যদিও সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ভোগ্যপণ্য আমদানি বন্ধ করার অ্যাকশনে আগে থেকেই যাওয়া উচিত ছিল। এখন আমাদের ৪২ বিলিয়নের রিজার্ভ আছে, এটা খুব ভালো। তবে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে আগে থেকেই অ্যাকশনগুলো নেওয়া উচিত ছিল। আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্য ঘাটতি ও রেমিট্যান্স ইস্যুতে ডলারের মূল্য আগে থেকেই বেড়ে গেছে। অবশ্য বাংলাদেশে আমরা এখন থেকে সাবধান না হলে বিভিন্ন দেশের মতো হয়ে যাব, এটা তো ঠিক না।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উৎপাদন বাড়ানো। উৎপাদনমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু বাণিজ্য ও সেবা খাত দিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবেন, সেটা তো না। আমাদের শিল্প খাতের উন্নয়ন করতেই হবে। ছোট, মাঝারি, সব ধরনের শিল্পের উন্নয়ন লাগবে। এটা হলে কর্মসংস্থান হবে। পণ্য উৎপাদন হবে। এতে আমদানি কমে যাবে। অনেক জিনিস আছে আমরা দেশেরটাই ভোগ করতে পারব। এ রকম একটা কিছু হিসাব করতে হবে।

তবে এখনই সাবধান হতে হবে। কিছুই হচ্ছে না, আমরা অনেক দেশের চেয়ে ভালো আছি। আগেও অনেক দেশে অনেক কিছু হয়েছে। এগুলো বলে লাভ নেই। বিপদে পড়লে যখন সøাইড পড়তে থাকে, তখন অর্থনীতির সব সূচকই দ্রুত নিচের দিকে নেমে যায়। যদিও উঠতে সময় লাগে। নামার সময় দ্রুত নেমে যায়।

আন্তর্জাতিক বাজারেও জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। মুদ্রাবাজারের বিনিময় হারের অবমূল্যায়নের ফলে এটা আরও উসকে দিচ্ছে। সরকার তো বিদেশে দাম কমাতে পারবে না। খুচরা বাজারে ৯৫-৯৬ টাকায় ডলার বিক্রি হচ্ছে, মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে হবে। আমদানি শুল্ক কিছুটা সমন্বয় করতে হবে। আমদানি থেকে ভোক্তা পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করতে হবে। সাধারণ মানুষের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তার জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি শক্তিশালী করতে হবে। মধ্য মেয়াদি আমদানি প্রতিস্থাপন কীভাবে বাড়াতে পারি, উৎপাদনশীলতা যেগুলো বাড়ানো সম্ভব, সেগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।

পণ্যের দাম বেড়েছে এটা একটা সমস্যা। কিন্তু মানুষের আয় না বাড়লে দাম বাড়লে সমস্যা হয়। আয়বর্ধক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। মধ্য মেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মতো প্রকল্প নিতে হবে। যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, বাজেটে সেগুলোর শুল্ক সমন্বয় করা দরকার। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আরও শক্তিশালী করতে হবে। ভর্তুকি যেটা আছে, সেটা আরও বাড়াতে হবে। কারণ মূল্য সমন্বয় করতে গেলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। সুতরাং আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যেও শুল্ক কিছুটা কমিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া দরকার।

উচ্চমূল্য ও ঘাটতির জন্য সরকার প্রস্তুত ছিল না। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য বাজেটে একটা সুযোগ আছে। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা আমরা দেখেছি। ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে দেখলাম। গুদামজাত করে, সিন্ডিকেশন করে দাম বাড়ানো হয়েছে। এগুলোতে শূন্য সহিষ্ণতা নীতি গ্রহণ করতে হবে। এগুলো যারা করছে, তাদের দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই অনেক দুর্বলতা আছে।

আমরা দেখছি ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের যে বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটা তো কেউ মানছে না। একদিকে সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্যদিকে হয়তো ডলারের আরও কিছু অবমূল্যায়ন প্রয়োজন পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার সরবরাহ করছিল। সরবরাহ বৃদ্ধি করে ডলারের প্রাপ্যতা বাড়ানোর কাজ আবার কিছুটা শুরু করতে হবে বলে আমার মনে হয়।