এডিপির ব্যয় সর্বকালের মধ্যে নিম্ন অবস্থানে চলে গেছে – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in বণিক বার্তা on 19 December 2023

অর্থবছ‌রের প্রথম ৪ মা‌সে নিট বি‌দেশী সহায়তা ৩৫% ক‌মে‌ছে

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিট বৈদেশিক অনুদান মূলত এডিপিতে ব্যয়ের জন্য প্রকল্প সাহায্য হিসেবে আসে। কিন্তু এ বছর এডিপির ব্যয় সর্বকালের মধ্যে নিম্ন অবস্থানে চলে গেছে। এডিপিতে আমরা অর্থ ব্যয় করতে না পারার কারণে বৈদেশিক অনুদানের প্রবাহও কমে যাচ্ছে। আরেকটি দিক হচ্ছে, এ বৈদেশিক অনুদানের অর্থ আমরা যেখানেই ব্যয় করি না কেন সেটি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে জমা হতো, যা টাকার মূল্যমান বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখত। ফলে অনুদান কমে যাওয়ায় আমরা বেশি পরিমাণে চড়া সুদে বিভিন্ন শর্তযুক্ত স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিচ্ছি। এছাড়া অনুদানের অর্থ কমে যাওয়ায় আমাদের আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্যতাও কমে গেছে। এ অবস্থা থেকে চলতি বছর এমনকি আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরও বেরুতে পারব কিনা সেটি দেখার বিষয়।’

কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আহরণ না হওয়ায় সরকারকে উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় মেটাতে স্থানীয় ও বিদেশী ঋণের পাশাপাশি বৈদেশিক সহায়তার অর্থের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ অর্থ মূলত উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা হয়ে থাকে। বছর দেড়েক ধরে দেশে নিট বৈদেশিক সহায়তার প্রবাহ নিম্নমুখী। এর মধ্যে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে নিট বৈদেশিক সহায়তা কমেছে ৩৫ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) শ্লথগতির কারণেই এর পরিমাণ কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশে নিট বৈদেশিক সহায়তা এসেছে ৯৬ কোটি ৩৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৪৮ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। এ সময়ে নিট বৈদেশিক সহায়তা কমেছে ৩৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রকল্প সহায়তা এসেছে ১৬২ কোটি ৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২০২ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার। সে হিসাবে এ সময়ে প্রকল্প সহায়তা কমেছে ২০ শতাংশ। এর বাইরে এ বছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৫৫ লাখ টাকার খাদ্যসহায়তা এসেছে, যেখানে গত বছরের একই সময়ে খাদ্যসহায়তা এসেছিল ১ কোটি ২৫ লাখ ডলারের। মাসভিত্তিক বৈদেশিক সহায়তার প্রবাহ বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর ছাড়া বাকি তিন মাসেই এর পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে।

বৈদেশিক সহায়তার অর্থপ্রবাহ গত অর্থবছর থেকেই নিম্নমুখী। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৭৫০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের নিট বৈদেশিক সহায়তা এসেছে। যেখানে আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৮৪৮ কোটি ১৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এক বছরের ব্যবধানে নিট বৈদেশিক সহায়তা কমেছে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মোট ৯১৯ কোটি ৮২ লাখ ডলারের বৈদেশিক সহায়তা এসেছিল। তার আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৮ কোটি ৫০ হাজার ডলার। অবশ্য গত অর্থবছরে খাদ্যসহায়তা কিছুটা বেড়েছিল।

বৈদেশিক সহায়তার অর্থ এডিপিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়ে থাকে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপির মোট আকার নির্ধারিত রয়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রা ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকার ও প্রকল্প ঋণ বা অনুদান ৯৪ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৪৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে, যা মোট এডিপির ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৪৭ হাজার ১২২ কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে, যা সে অর্থবছরের মোট এডিপির ১৮ দশমিক ৮১ শতাংশ ছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এডিপি বাস্তবায়নে শ্লথগতির কারণেই বৈদেশিক সহায়তা কমে গেছে। বৈদেশিক সহায়তা কমে গেলে সরকারকে ব্যয় নির্বাহের জন্য ঋণ বেশি নিতে হয়। তাছাড়া রিজার্ভের মজুদ ও আমদানি ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্যতাও কমে যায়।

উল্লেখ্য, সরকারের বাজেট ঘাটতির একটি অংশ পূরণ হয় বৈদেশিক অনুদানের মাধ্যমে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা পরবর্তী সময়ে সংশোধন করে কমিয়ে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৮ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়। আলোচ্য অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এডিপির জন্য প্রকল্প ঋণ বা অনুদান ধরা হয়েছিল ৭৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য অনুদান বা ঋণ ধরা হয়েছিল ৩০ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয় করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশী অনুদান থেকে ২ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা ও সহায়ক অনুদান থেকে ব্যয় হয়েছে ৫৬ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এডিপির জন্য প্রকল্প ঋণ বা অনুদান ধরা হয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য অনুদান বা ঋণ ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯০ কোটি টাকা।