কৃত্রিম সংকট বন্ধে সরকারের খবরদারি বাড়াতে হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in সমকাল on 22 January 2023

ক্যাবের বার্ষিক প্রতিবেদন

খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার মান কমিয়েছে দরিদ্ররা

নিত্যপণ্যের দাম ও সেবায় ব্যয় বৃদ্ধির কারণে গত বছর রাজধানীতে গড়ে মূল্যস্ম্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ। এরই প্রভাবে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ বেশি ভুক্তভোগী। দরিদ্র জনগোষ্ঠী খাদ্যাভ্যাস ছাড়াও জীবনযাত্রার মানে কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছেন। ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল শনিবার ভার্চুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে পণ্য ও সেবার মূল্যবিষয়ক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সংগঠনটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ম্ফীতি বৃদ্ধি পেলে সবচেয়ে চাপে পড়েন নির্দিষ্ট আয়ের ও প্রান্তিকের মানুষ। তাঁরা যে ধরনের খাবার গ্রহণ করেন, গত বছর সেগুলোর দামই বেড়েছে বেশি। গ্রামে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু থাকলেও শহরে তা যথেষ্ট কম। অবস্থার উন্নতি করতে সরকারের এদিকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থায় কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের পণ্যের দাম বাড়ানো আমরা দেখেছি। এটি বন্ধে সরকারের খবরদারি বাড়াতে হবে। বিশ্ববাজারে পণ্যের পাশাপাশি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব দেশেও পড়েছে। এ জন্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশে দামে সমন্বয় রাখতে হবে। বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির আভাস মিললে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিনির্ভর পণ্যের সংগ্রহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কিছু পণ্যে শুল্কছাড় ও দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমেও মূল্যস্ম্ফীতি কমানো সম্ভব।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে ক্যাবের পক্ষে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২০১১ সালের পর গত বছর দেশে মূল্যস্ম্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে, যা দেশের লাখ লাখ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের দুর্দশার কারণ। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে ঢাকায় সাধারণ মানুষের কেনাকাটায়। তবে মেগাসিটিতে খাদ্যপণ্যের চেয়ে বিভিন্ন খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ম্ফীতি মধ্যবিত্তদের বেশি নাকাল করেছে।

ক্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেল বছর গড়ে খাদ্য মূল্যস্ম্ফীতি ১০ দশমিক ০৩ এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ছিল ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ। তবে সাধারণ পরিবারের তুলনায় নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর গড় মূল্যস্ম্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শহরাঞ্চলে গত বছর জানুয়ারির তুলনায় অক্টোবর-ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ গড় মূল্যস্ম্ফীতি ছিল। সাধারণ মূল্যস্ম্ফীতি ফেব্রুয়ারি থেকেই বাড়তে শুরু করে। মে মাসে কিছুটা কমে আসে। এরপর জুন থেকে আবার বাড়তে শুরু করে। কিন্তু জ্বালানি তেলের দামের দাম বৃদ্ধির পর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ম্ফীতি অনেক বেড়ে যায়। অক্টোবর-নভেম্বরেও বেড়েছে। এরপর মৌসুমি সবজির সরবরাহ, আমন ধানের বাম্পার ফলনে দাম কমার কারণে ডিসেম্বরে কিছুটা কমে আসে।

তবে ঢাকায় সাধারণ পরিবারের তুলনায় নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর গড় মূল্যস্ম্ফীতির চাপ কম ছিল। খাদ্যপণ্যের চেয়ে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে বার্ষিক মূল্যস্ম্ফীতি ছিল বেশি। খাদ্যপণ্যে ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ম্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৭৬ ও ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ।

বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মূল্যস্ম্ফীতি গত আগস্টে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠেছিল। এর পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ হার কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে। কিন্তু আলোচ্য সময়ে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।

ক্যাবের প্রতিবেদনেও বেশ কিছু পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখা গেছে, চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পণ্যটির বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন কিছু মিল মালিক। তা ছাড়া চালের বাজার করপোরেট কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ফলপ্রসূ হবে না।

সংবাদ সম্মেলনে শুভেচ্ছা বক্তব্যে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘গত এক দশকে দেশের উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের আয় বেড়েছে, সঙ্গে ব্যয়ও। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমলেও এখনও প্রায় ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। এ জন্য মুদ্রাস্ম্ফীতি মানুষের জীবনে কাল হয়ে আসে। যদিও গত বছর বৈশ্বিকভাবেই স্বস্তির ছিল না।’ দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করোনাকাল ও করোনা-পরবর্তী সময়ে অনেকের আয় কমেছে। যদিও হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তবে এ বৃদ্ধি উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে বেশি হওয়ায় অর্থনীতিতে প্রভাব তৈরি করেছে। মূল্যস্ম্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’

উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতির সময়ে নিম্ন আয়ের পরিবারকে সহায়তার জন্য যথাযথ পরীবিক্ষণের সঙ্গে ওএমএস কার্যক্রম শক্তিশালী করা, দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়ানো, অস্থায়ীভাবে আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য, খাদ্যবহির্ভূত মৌলিক পণ্য এবং দুস্থ জনগোষ্ঠীর কাছে নগদ টাকা হস্তান্তর কর্মসূচি বাড়ানো, শহরে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি জোরদার, নিম্ন-মধ্যম ও মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা স্কিম, মৌলিক জ্বালানি পণ্য, বিশেষ করে ডিজেলে ভর্তুকি, পণ্য বাজারে স্থিতিশীল রাখতে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো, সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ক্যাব।