ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে এসএমইর দিকে নজর দিতে হবে: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in দৈনিক জনকন্ঠ on Monday 27 July 2020

গার্মেন্টসেই আলো ॥ অর্থনীতির ধকল কাটছে

একের পর এক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বিদেশী বিনিয়োগের অবারিত সুযোগ দীর্ঘস্থায়ী বন্যা চাপে ফেলতে পারে ক্ষতি মোকাবেলায় প্রস্তুত কৃষি মন্ত্রণালয়

করোনা মহামারীতে দুনিয়াজোড়া সঙ্কটের মধ্যেও মুখ তোলার লক্ষণ দেখাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এই মহামারীর ভয়াল থাবায় বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতির মাঝেও দেশের অর্থনীতিকে টেনে বের করার নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। মহামন্দায় পড়া বিশ্ব অর্থনীতির মাঝেও একের পর এক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখার জন্য। সঙ্কটের এই সময়ে সংস্কারের ঘোড়া ছুটিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য দরজা পুরোপুরি খুলে দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে চীন ফেরত জাপানী বিনিয়োগকে টার্গেট করা হয়েছে। এজন্য নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, বিদেশী বিনিয়োগ এলে লাল ফিতার ফাঁসের পরিবর্তে, লাল-কার্পেট অভ্যর্থনা জানানো হবে। সে আলোকেই তৈরি করা হচ্ছে এক শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল। তবে এক্ষেত্রে বাদসাধছে করোনাকালীন দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে আউশ ও আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে করোনার চাপের মধ্যেও নতুন করে আরও চাপে পড়বে অর্থনীতি। এক্ষেত্রে কঠোরভাবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং বন্যা পরবর্তী দ্রুত কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচী গ্রহণই বন্যার চাপ সামলে ওঠার ক্ষেত্রে সরকারের জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এবারও নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক। ইতোমধ্যে এ খাতে করোনার প্রভাব কাটতে শুরু করেছে। বিদেশী ক্রেতারা আবার ফিরে আসছেন। ফিরে আসছে বাতিল হয়ে যাওয়া ক্রয় আদেশগুলোও। সেই সঙ্গে আসছে নতুন ক্রয় আদেশও। গতবারের তুলনায় বর্তমানে ৭০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ আসছে। তার সঙ্গে রফতানি আয়ের চিত্রও মিলে যাচ্ছে। যার সুফল আগামী দুই মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতি পেতে শুরু করবে।

দেশের তৈরি পোশাক খাত শুধু রফতানি আয়ের প্রধান খাতই নয়, দেশের সবেচেয়ে বড় কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী একটি খাতও। ফলে দেশের একটি বিশাল ভোক্তা শ্রেণীর নেতৃত্বও দিচ্ছে এই খাত। এখন এ খাতে বেতন ভাতা নিশ্চিত করা গেলে এই ভোক্তা শ্রেণীর কারণেই দেশের আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানের জন্য ঘোষিত ঋণ প্যাকেজ ইতোমধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এর আগে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল থেকে এর আগে এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন দেয়া হয়েছে শ্রমিক-কর্মচারীদের। করোনা পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ায় আরও তিন মাসের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ চেয়েছেন তৈরি পোশাক মালিকরা। তবে সরকার আরও এক মাসের অর্থাৎ জুলাই মাসের বেতন-ভাতা বাবদ ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য প্রয়োজন হবে ২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।

সরকার আশা প্রকাশ করছে, তৈরি পোশাক শিল্পে ক্রয় আদেশ ফিরে আসতে শুরু করায় আগস্ট থেকে গার্মেন্টস কোম্পানিগুলো নিজেরাই তাদের আয় দিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারবে। কারণ, এরই মধ্যে অনেক কারখানায়ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজ করার মতো পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ চলে এসেছে। ফলে করোনাভাইরাসের শুরুর দিকে বিপর্যস্ত রফতানি আয়ের শীর্ষ খাতটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

কারখানা মালিকরাও বলছেন, এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ক্রয়াদেশ এসেছে তাতে বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সাহস জোগাচ্ছে। অনেকগুলো বড় ব্র্যান্ড স্থগিত ও বাতিল করা ক্রয়াদেশের পণ্য আবার নিতে শুরু করায় পোশাক রফতানি গত জুনে বেশ খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস ও টিকা আবিষ্কার না হওয়ায় একধরনের অনিশ্চয়তা আগামী দিনগুলোতে থেকে যাবে বলেই মনে করছেন তারা।

তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে বিক্রয়কেন্দ্র খোলার পরপরই ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করেছেন। কারখানায় গতবারের চেয়ে বর্তমানে ৬০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত ক্রয়াদেশ এসেছে। বিদেশী ক্রেতারা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্রয়াদেশ দিয়েছে। তারপরের ক্রয়াদেশও আসছে। তবে আসার গতিটা কম। করোনায় বড়সড় ধাক্কা খাওয়ার কারণে বড় লিড টাইমে কাজ দিচ্ছে না বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড। তারা কম লিড টাইমের ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। ফলে আগামী ছয় মাস পোশাক রফতানি কতটা হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে বর্তমানে ক্রয়াদেশ আসার হার ভাল। পোশাকশিল্প টিকে থাকার লড়াইয়ে এটি সহায়তা করবে। অনেক সময় ক্রেতারা কারখানা বুকিং দেয়ার পরও নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ক্রয়াদেশ দেন না। ফলে কিছুটা অনিশ্চয়তা তো আছেই। তবে করোনার শুরুর দিকে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় যেভাবে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম, বর্তমানে ক্রয়াদেশ আসার হার দেখে ভরসা পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমরা টিকে যেতে পারব।

বিদেশী ক্রেতাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরাও বলছেন, ক্রয়াদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভাল। চীন ও তুরস্ক থেকে যেসব ক্রয়াদেশ সরে যাচ্ছে, তার একটি অংশ বাংলাদেশে আসছে। কারণ, বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম। আবার উদ্যোক্তারাও বর্তমান চ্যালেঞ্জের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিচ্ছেন। ফলে শীঘ্রই বাংলাদেশের পোশাক রফতানি খাত ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, যেসব ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছিল, সেগুলো ক্রেতারা নিচ্ছেন। অন্যদিকে নতুন ক্রয়াদেশ আসার যে প্রবণতা রয়েছে, সেটিও ইতিবাচক। যদিও জুলাই-আগস্ট লিংক পিরিয়ড, প্রতিবছরই মাস দুটিতে ক্রয়াদেশ কিছুটা কম থাকে। তিনি বলেন, সরবরাহকারীদের কাছে ক্রয়াদেশের চাহিদা বেশি থাকায় বর্তমানে বেশ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। তাতে কিছু ক্রেতা গতবারের চেয়ে কম দাম দিচ্ছেন। তবে অধিকাংশই আগের দামে ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, বড় কারখানাগুলো টিকে থাকার মতো ক্রয়াদেশ পেলেও ছোট ও মাঝারি কারখানা সেভাবে পাচ্ছে না। তাই অন্তত দুই মাস তাদের শ্রমিক-কর্মচারীর মজুরির জন্য সহায়তা দরকার।

বিগত ২০০৭-২০০৮ সালের বৈশি^ক মন্দার মতো এবারও দেশের তৈরি পোশাক খাতই অর্থনীতিকে টেনে তুলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি খুব বেশি না হলেও অন্যান্য খাতেও রফতানি আয় বাড়বে। যা অর্থনীতিকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ধরে রাখতে সহায়তা করবে। তবে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আসন্ন কোরবানির বিপুল পরিমাণ পশুর চামড়া অপচয় না করে তা রফতানির ব্যবস্থা করা। যেহেতু পরিবেশগত ছাড়পত্রের কারণে প্রক্রিয়াজাত চামড়া বাংলাদেশ থেকে রফতানির সুযোগ কম। বর্তমানে মাত্র কয়েকটি চামড়া শিল্প কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে বিদেশে প্রক্রিয়াগত চামড়া রফতানি করার। সেক্ষেত্রে সীমিত সময়ের জন্য কোরবানির পশুর ওয়েট-ব্লু চামড়া রফতানির সুযোগ দিলে বিপুল পরিমাণ কোরবানির চামড়া নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। এতে চামড়া খাতে রফতানি আয় বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ শিল্প খাতে বাড়বে অর্থ প্রবাহ। যা সার্বিক রফতানি বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেও সহায়তা করবে।

রফতানি আয়ের পাশাপাশি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার আরও একটি হাতিয়ার হচ্ছে রেমিটেন্স। বর্তমানে রেমিটেন্স বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে। তবে রেমিটেন্স নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চলমান করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সঙ্কটের মধ্যেও জুন মাসে প্রবাসীরা দেশে রেকর্ড ১৮৩ দশমিক ৩০ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। আর পবিত্র ঈদ-উল আজহা সামনে রেখে চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১৬ দিনে ১৩৬ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ রেমিটেন্স দেশে এসেছে। প্রবাসীদের আয় পাঠানোর এই গতি অব্যাহত থাকলে মাস শেষে জুলাইতেও রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স পাবে বাংলাদেশ।

বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের পাঠানো টাকা অর্থাৎ রেমিটেন্সে তৈরি হয়েছে একটা নতুন রেকর্ড, যার ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে গত অর্থবছর। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট এক হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল।

অর্থনীতির এই দুই সূচকের এই ‘উল্লম্ফন’ সাময়িক ইতিবাচক হলেও দীর্ঘমেয়াদে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, করোনা সঙ্কটের কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের দেশে ফেরত আসতে হচ্ছে বলে তাদের সব সঞ্চয় কিংবা ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া অর্থও দেশে আসছে রেমিটেন্স আকারে। ফলে রিজার্ভ বাড়ছে। এ কারণেই মে ও জুনে রেমিটেন্স আর জুন-জুলাইয়ে রিজার্ভে ব্যাপক উর্ধগতি দেখা গেলেও সেটা সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদে এটি দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। তবে রফতানি মোটামুটি ঘুরে দাঁড়ালে এ নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তা থাকবে না।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ আমদানির মাত্রা কমে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় দাতা সংস্থাগুলো বড় অঙ্কের অনুদান দিচ্ছে। এগুলো এখনও ব্যবহার না হওয়ায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

রেমিটেন্স বাড়ার পেছনের সম্ভাব্য কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক প্রবাসী করোনার কারণে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা জানেন না আর ওই দেশে যেতে পারবেন কি না। ফলে তাদের যা কিছু সঞ্চয় আছে, সব পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ কারণেই সম্ভবত রেমিটেন্স বেড়েছে। এসব শ্রমিকরা প্রবাসে কাজের জন্য ফিরতে না পারলে এখনকার এই ‘উর্ধগতি’ টেকসই হবে না। এ নিয়ে বরং সামনে দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে।

এক্ষেত্রে অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হবে। আর এ গতিশীলতা আনতে হলে বিদেশ ফেরতদের যেমন আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, তেমনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র উদ্যেক্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তাদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। অন্যদিকে, বিদেশ ফেরত বাংলাদেশীদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ১১টি খাতে তাদের ঋণ প্রদানের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। যে সকল প্রবাসী দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে তাদের স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত করতে পারলে আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে যেমন গতি আসবে, তেমনি তারাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়া থেকে মুক্ত থাকবেন। তবে অনেক বিদেশ ফেরত শ্রমিকই আবার বিদেশ যেতে শুরু করেছেন এবং অনেকে নতুন করেও যাচ্ছেন। ফলে রেমিটেন্স নিয়ে যতটা দুশ্চিন্তার আশঙ্কা করা হচ্ছে, ততটা দুশ্চিন্তা নাও থাকতে পারে শেষ পর্যন্ত।

এই মুহূর্তে জোর করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সমন্বয় করেই ধীরে ধীরে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। এক্ষেত্রে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোটা ইতিবাচক লক্ষণ। এই অবস্থায় আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করার অন্যতম ভরসা হলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। বড় উদ্যোক্তাদের নানা ছাড় দিলেও তারা এই অবস্থায় খুব একটা এগিয়ে আসবে না। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করবে। তাই যে করেই হোক, সরকারকে ওই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তুলে দিতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়ালে আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এসএমই খাতে ঋণ দ্রুত ছাড় করার জন্য আবেদনপত্র সহজ করাসহ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে এসএমইর দিকে নজর দিতে হবে। লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে। ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। তাদের ভবিষ্যত কী? যাদের ন্যূনতম কাজের সুযোগ আছে তারা কাজ করবে। যাদের একেবারেই কোন সুযোগ নেই, তাদের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। দারিদ্র্য নিরসনে সরকারকে বড় বড় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এই ছোট ব্যবসায়ীদের পাশেও দাঁড়াতে হবে।’

অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও চলমান বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন করে আবার চাপে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে দেশের ১৭ জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে তৃতীয় দফার বন্যা চলছে। এতে দেশের আউশ এবং আমনের বেশ ক্ষতি হয়েছে। এই বন্যা আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে এবং অর্থনীতি নতুন করে আবার চাপের মুখে পড়বে।

গত এক মাস ধরেই দেশে বন্যা চলছে। গত ২৬ জুলাই প্রথম দেশে বন্যা শুরু হয়। এরপর ১১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফায় পানি বাড়ে এবং ২১ জুলাই থেকে তৃতীয় দফায় বন্যার পানি বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের ১৬ জেলায় আরও ২ দিন পানি বাড়বে এবং এই বৃদ্ধি চলবে ২৭ জুলাই পর্যন্ত। তারপর থেকে পানি কমতে শুরু করবে। জোয়ার না থাকলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই দেশের সব জায়গা থেকে বন্যার পানি নেমে যেতে পারে বলে শনিবার জানিয়েছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ এনামুর রহমান।

ইতোমধ্যে বন্যার ক্ষতি মোকাবেলায় কৃষি মন্ত্রণালয় আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলে জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি আশা করছেন, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পানি নেমে গেলে আমরা আমন আবাদ করতে পারব। এমন কি আগস্টের ১৫ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত সময় পেলেও আমরা বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব। ইতোমধ্যে আমরা বীজতলা তৈরি করার জন্য বীজ পাঠিয়েছি। বন্যা উপদ্রুত জেলার উঁচু জায়গাগুলোতে বীজতলা তৈরি করা হচ্ছে। যাতে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক আমন আবাদ করতে পারে।

তিনি জানান, মাঠে বেশি ধান নেই। ফলে বন্যায় কৃষির খুব বেশি ক্ষতি হবে না। বন্যায় কিছু আউশের জমি ডুবে গেলেও লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে না। কারণ অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ২ লাখেরও বেশি হেক্টর জমিতে আউশের চাষ হয়েছে।

গত ২০ জুলাই কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ‘বন্যায় প্রাথমিকভাবে প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বন্যায় আউশ, আমন, সবজি, পাটসহ বেশ কিছু ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিকল্প বীজতলা তৈরি, ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে বিকল্প ফসল চাষের ব্যবস্থা, নিয়মিতভাবে আবহাওয়া মনিটরিংসহ প্রস্তুতি চলছে যাতে করে বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতি মোকাবেলা করা যায়।’

দীর্ঘস্থায়ী বন্যা প্রসঙ্গে ড. রাজ্জাক বলেন, বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা সে বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য নেই। তবে ভারত ও নেপালে বৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মোঃ শাহজাহান কবীরও বলেন, প্রকৃতির ওপর তো আমাদের হাত নেই। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরাসহ নানা দুর্যোগ মাথায় নিয়েই আমাদের বসবাস। চাষীরা সরকারের সহযোগিতা পেয়ে যে আউশ চাষ করেছিলেন, তার অনেক ফসলই বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার অবশ্য পরবর্তী ফসলে সহযোগিতা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। কৃষিমন্ত্রী অবশ্য সকল সুযোগ সুবিধার কথা বলেও দিয়েছেন। তাতে হয় তো কৃষক পুষিয়ে নিতে পারবেন।’

তবে আশার বিষয় হলো, বোরোতে বাম্পার ফলন হয়েছে এবং অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও চাল আমদানি করা যাবে। আবার বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ও পুনর্বাসন কর্মসূচী শুরু করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। রবি ফসল উৎপাদনেও সরকারের বড় কর্মসূচী আছে। এসব কর্মসূচী অব্যাহত থাকলে বন্যার চাপ সামলে নেয়া সম্ভব হবে।

অবশ্য শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, চাল ব্যবসায়ীরা একের পর এক কারসাজি করে যাচ্ছেন। ফলে বন্যার সুযোগে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে যাতে চালের মূল্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে না যায় সেজন্য সরকার তথা খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জোরদার মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।

তবে অর্থনীতি পুরোপুরি চাঙ্গা করতে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের দিকেই কড়া নজর দিতে হবে সরকারকে। করোনাভাইরাস ইস্যুতে চীন থেকে সরে যাওয়া বিদেশী বিনিয়োগের কিছু অংশ যাতে বাংলাদেশে আসে, সে লক্ষ্যে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। এ সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে চীন থেকে বড় ধরনের বিনিয়োগ পাওয়ার আশায় রয়েছে সরকার। এজন্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ নেয়াসহ বিভিন্ন নীতিমালা সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বৈদেশিক মুদ্রার (এফসি) এ্যাকাউন্ট খোলারও সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে এখন থেকে বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা কোন বিদেশী বিনিয়োগকারী তার লভ্যাংশের অর্থ এফসি এ্যাকাউন্টে রাখতে পারবেন। যেকোন সময় এ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ নিজ দেশে বা অন্য দেশে নিয়ে যেতে পারবেন। আবার বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে লভ্যাংশের অর্থ বাংলাদেশে বিনিয়োগও করতে পারবে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে নানা উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই শিথিলতা এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগ বাড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে।

করোনার উৎপত্তিস্থল চীন থেকে মুখ ফেরানো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী বিনিয়োগ নিজেদের দেশে টানতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশসহ অনেক দেশ। তবে বিনিয়োগ-উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা পর্যালোচনা করে কর্পোরেট ট্যাক্স, ভ্যাট কমানো, ক্ষেত্রে বিশেষ শতভাগ কর অব্যাহতি প্রদান, দ্রুত ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুসহ একগুচ্ছ সুপারিশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটি।

করোনা পরবর্তী বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হয়ে নতুন গন্তব্যে স্থিরের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকৃষ্টের সামগ্রিক কর্মকৌশল ও ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এ বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি ইতোমধ্যে গঠন করে সরকার। এ কমিটি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে সভা করে তাদের সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করেছে।

কমিটি প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্পোরেট কর হার ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, নির্দিষ্ট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৫০ থেকে শতভাগ কর অব্যাহতি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগে ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদান, ভ্যাট হার ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা, ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করা, ইটিটি স্থাপনের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি সংস্কারমূলক সুপারিশ করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশীরা সংস্কারের ক্ষেত্রে সাবলীল। বাংলাদেশের মতো খোলা অর্থনীতি খুব কম দেশে রয়েছে। এ দেশে বিনিয়োগের জন্য সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাকে আহ্বান জানাচ্ছি আমরা। অভ্যর্থনার জন্য বিছিয়ে রেখেছি লাল কার্পেট। এমন বিপুল সম্ভাবনা খুব কম দেশেই মজুত।

বাংলাদেশের মতো বিপুল সম্ভাবনাময় বাজারও বিশ্বে খুব কম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্যবসা করার পথ সহজ হওয়ার (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) ক্রমতালিকায় ওপরে উঠে এলেও, এ দেশে বিনিয়োগের পথ বাস্তবে মসৃণ হয়েছে কতখানি? জমি-জট, লাল ফিতার ফাঁস, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেয়ার চক্করে নতুন বিনিয়োগ বা ব্যবসা করা এখনও যথেষ্ট ঝাকমারি। ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় গড় সময়ও অনেক ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দেশের তুলনায় এখনও বেশি লাগে। দ্রুত সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই সব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন এদেশে বিনিয়োগে বিদেশী লগ্নিকারীদের ভরসা তৈরির জন্য।