খেলাপি ঋণ কমানো ও বাজার কারসাজি নিয়ন্ত্রণ কোনোটাতেই সাফল্য দেখা যাচ্ছে না – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিক বার্তা on 4 September 2023

বাংলাদেশের অন্যতম আর্থ-উন্নয়নবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো। তিনি আঙ্কটাডের প্রডাক্টিভ ক্যাপাসিটি ইনডেক্সের উচ্চপর্যায়ের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে অর্থনীতিতে আরেকটি স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টোরাল ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্বের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। সিপিডির আগে বিআইডিএস, ইউএসএআইডি ও ইউএনডিপিতে কাজ করেছেন। ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক ও এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালক। বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে অ্যাডভাইজার গ্রুপের সদস্য ছিলেন। দেশ-বিদেশে প্রচুর গবেষণাপত্র ও গ্রন্থের লেখক। চলমান অর্থনীতির নানা দিক, সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

বর্তমানে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় কষ্টে আছে। গত বছর শ্রীলংকাও এমন সংকটে পড়েছিল। শ্রীলংকা মূল্যস্ফীতি দুই অংক থেকে এক অংকে নামিয়ে আনতে পেরেছে। কিন্তু আমরা সম্ভাবনাময় অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি?

এখানে দুটি জিনিস কাজ করে। একটা হলো মুদ্রানীতি, আরেকটা হলো বাজারবহির্ভূত কিছু অনুঘটক। শ্রীলংকায় কোনো ম্যাজিক কাজ করেনি। তারা মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করেছে এবং তাদের সরকারের অন্য কয়েকটি নীতিমালা এখানে কাজ করেছে। যখন মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে তখন সরকারকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিতে হয় এবং সুদের হারের ওপর হাত দিতে হয়। সুদের হার যদি বাড়ানো হয় তাহলে মানুষের ঋণ নেয়া কমে। সুদের হার কম থাকলে মানুষ ঋণ নিতে চায়, বাজারে মুদ্রার প্রবাহ বাড়ে। আমাদের দেশে বহুদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার ধরে রেখেছে। ব্যাংকগুলোর ওপর নির্দেশ ছিল ঋণের জন্য সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের ওপর সুদের হার ৬ শতাংশ রাখতে হবে। অথচ আমাদের মূল্যস্ফীতি ২০২৩-এ গড়ে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। তার মানে হচ্ছে, মানুষ অনেক সস্তায় ঋণ নিতে পারছিল। আবার আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রেখে প্রকৃত অর্থে কম টাকা নিয়ে ঘরে ফিরত। এ ধরনের মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নয়। মুদ্রানীতি ছাড়াও বাজারে অসৎ ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে নীতিনির্ধারকরা সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনেকাংশেই সফল হয়েছে। শ্রীলংকাও তাই করেছে। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঠিক ও দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে সফলতা এসেছে। দেশটির অর্থনীতি খুব তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমরা কিন্তু এখনো কষ্ট করছি। শ্রীলংকা মুদ্রানীতি ছাড়াও আর্থিক নীতির মাধ্যমে সরকারি ব্যয় অনেকখানি কমাতে পেরেছে এবং রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। যদিও শ্রীলংকায় এখনো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে, কিন্তু তারা অনেক সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করেছে।

আমাদের সরকার আমদানি কমিয়ে ‍দিয়েছে। এ পদক্ষেপ কতটুকু সফল হয়েছে বলে মনে করেন?

বাণিজ্য ভারসাম্য, চলতি হিসাবের ভারসাম্য, আর্থিক হিসাবের ভারসাম্য—সব ক্ষেত্রেই আমাদের সমস্যা রয়েছে। আমদানি কমানোর ফলে ২০২৩ অর্থবছরে আমদানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছে। চলতি হিসাবের ঘাটতিও অনেকখানি কমানো গেছে। কিন্তু আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানিও কমে গেছে। এটি চলতে থাকলে উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হবে, সাধারণ মানুষের আয় কমে যাবে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ব্যাহত হবে। সেজন্য একটা নীতির সঙ্গে আরেকটা নীতির সমন্বয় থাকা গুরুত্বপূর্ণ। আর আমদানি কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনার চেষ্টার ব্যাপারে বলতে হয়, আমাদের মূল্যস্ফীতিকে এখন আর আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি বলা যাবে না। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব পণ্যের মূল্য অনেক দিন থেকে কমতে শুরু করেছে। তাই আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির ওপর দায় চাপিয়ে শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে পুরোপুরি সফলতা অর্জন করা যাবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক হাতিয়ারটিই ব্যবহার করতে হবে। অবশেষে এ বছরের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটের আর্থিক পদক্ষেপগুলো সম্প্রসারণমূলক। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাবনা রয়েছে। তাই বিভিন্ন খাতের নীতিমালার মধ্যে সাযুজ্য না থাকলে নীতির কার্যকারিতা হারিয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক বাজারে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে তেলের দাম স্থিতিশীল (ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারের কাছাকাছি)। আমরা তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি কেন?

আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম সরকার নিয়ন্ত্রিত। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে সরকার দাম বাড়ায়। কিন্তু দাম কমলে তা কমায় না। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) মুনাফা করে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার সঙ্গে বেশকিছু শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ফর্মুলাভিত্তিক পেট্রোলিয়ামের দাম নির্ধারণ করা। যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বলি আর জ্বালানি তেলের দামের ক্ষেত্রেই বলি, অর্থনৈতিক যুক্তিগুলো এখানে প্রায়ই কাজ করে না। আমরা যদিও বাজার অর্থনীতি চালু করেছি কিন্তু আসলে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনীতির মতো নীতিমালা দেখতে পাচ্ছি।

জ্বালানির জন্য আমরা বড় আকারে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে আমাদের ডলার সংকট আছে। সামনে কোনো বৈশ্বিক সংকট এলে সরকার জ্বালানি সরবরাহ সচল রাখতে পারবে?

এখানেই সমস্যা। আমরা জ্বালানি তেলের জন্য সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও আমাদের উচ্চমূল্যে তেল আমদানি করতেই হবে। আমরা নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না। যদিও বিভিন্ন জিওলজিক্যাল সার্ভের মাধ্যমে জানা গেছে যে বাংলাদেশে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাটা বাস্তবে রূপ দেয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় না। উচ্চমূল্যে জ্বালানি আমদানির জন্য অনেক সময় গোষ্ঠীগত স্বার্থ বিবেচনায় রাখার কথাও শোনা যায়। জ্বালানি সংকট মোকাবেলার জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে কর্মপন্থা নেয়া দরকার। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে জ্বালানির উৎস বহুমুখী করতে হবে যাতে বিপদের সময় শুধু এক-দুটি দেশের ওপর নির্ভর করতে না হয়। দীর্ঘমেয়াদে গ্যাস কূপ খননে বিনিয়োগ করতে হবে।

সম্প্রতি চাল, গম ও পেঁয়াজের পর চিনি রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা বা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ভারত। আপনি বাংলাদেশের বাজারে ভারতের এ সিদ্ধান্তে কোনো ধরনের নিকট প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন?

দেখুন, প্রত্যেকটি দেশই তাদের নিজেদের বাজারের অবস্থাটা বিবেচনা করে এবং তাদের দেশের ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে নীতিমালা নির্ধারণ করে। সেটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। যদিও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী, এ ধরনের রক্ষণশীল পদক্ষেপ নেয়া কাম্য নয়। কিন্তু নিজেদের দেশের ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে এটা কোনো নতুন বিষয় নয়, অন্যান্য দেশও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদী পদক্ষেপ নেয়। সেজন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এটা হঠাৎ করে এসে যাচ্ছে এমন তো নয়। কোনো সময় চাল, কোনো সময় পেঁয়াজ, কোনো সময় চিনি—পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদা অনুযায়ী ভারত এমন সিদ্ধান্ত নেয়। এটা কোনো সময় ভারত, আবার কোনো সময় আরেক দেশ। এ সমস্যা মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের বিভিন্ন পণ্য আমদানি করার উৎসগুলো বাড়াতে হবে। শুধু একটা দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকা যাবে না। পণ্য কেনার বাজার বহুমুখী করতে হবে। নতুন নতুন দেশ খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এজন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া উচিত। নিষেধাজ্ঞা আসার আগেই বাজারের অবস্থা বুঝে আমাদের বিকল্প উৎস খুঁজে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সঠিক সময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্য দেশগুলোও তো পণ্য কিনতে চাইবে। যে আগে তৎপর হয়ে পদক্ষেপ নেবে সে সফল হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, পণ্য কীভাবে বাজারে আসতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা আমদানির পরও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মুনাফা বাড়ানোর চেষ্টা চলে। আর যেসব পণ্য আমরা দেশীয়ভাবে উৎপাদন করতে পারি সেগুলোর উৎপাদন ও সরবরাহ কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমাদের দেশের বাজারে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকজন মিলে। তাদের কয়েকজন পেঁয়াজ আমদানি করছে, কয়েকজন তেল আমদানি করছে, কয়েকজন চিনি আমদানি করছে। বাজার নিয়ন্ত্রণেও তারা ভূমিকা রাখে।

এটাকে অনেকে সিন্ডিকেট বলে। সিন্ডিকেট ম্যানেজমেন্ট আমরা কেন করতে পারছি না?

সিন্ডিকেট যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এটাই তো নীতিনির্ধারকরা স্বীকার করতে চান না। বাণিজ্যমন্ত্রী একবার সিন্ডিকেটের ক্ষমতার কথা বলে এখন আবার তা অস্বীকার করছেন। যদি সিন্ডিকেট না থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদেরই দায়িত্ব দাম বাড়ার কারণ খুঁজে বের করা। তাদেরকে বাজারে জিনিসপত্রের সরবরাহ ও দামের ওপর নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা করতে হবে। তাদেরই দায়িত্ব বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা। বাজারে অদৃশ্য শক্তির হাত যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে কে পারবে?

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ আগস্ট নাগাদ দেশে ৩১৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, চালু হয়েছে ১৮৩টি কারখানা। এটা আমাদের সার্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?

অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন খাতের কারখানার মাধ্যমে উৎপাদন করা জরুরি। এর ফলে মানুষের আয় সৃষ্টি হয় যা দিয়ে মৌলিক চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়। এতে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। মানসম্পন্ন জীবনযাপনও নিশ্চিত করা যায়। যে কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে এবং যেগুলো নতুন তৈরি হয়েছে সেগুলো কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কতখানি ভূমিকা রাখছিল বা রাখবে সেটি দেখার বিষয়। কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণ জানা প্রয়োজন। কারণ কর্মসংস্থানের জন্য এটি ভালো খবর নয়। আমাদের দেশে যুব বেকারত্ব এখনো অনেক বেশি। দেশে গড় বেকারত্ব কম হলেও যুব বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। তাই কর্মসংস্থানের উৎসগুলো কমে গেলে তা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সম্প্রতি একটি খবর পাওয়া যাচ্ছে, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানুয়ারির পর থেকে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি এবং ছাড় ও পরিশোধের তথ্যগুলো প্রকাশ করছে না। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

আমি মনে করি যে তথ্যের সংকট হচ্ছে সঠিক অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের একটি বড় প্রতিবন্ধক। কারণ সঠিক ও হালনাগাদ তথ্য থাকলেই সঠিক নীতিনির্ধারণ সম্ভব। এছাড়া তথ্যের অভাবে গবেষকরা ঠিকমতো বিশ্লেষণ করতে পারেন না। অনেক সময় হয়তো নীতিনির্ধারকদের কাছে তথ্য আছে, কিন্তু জনগণকে সেগুলো জানানো হচ্ছে না। কিন্তু তথ্য জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। আমরা তথ্যের জন্য আবেদন করলে তার জন্য অনেক দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। বৈদেশিক ঋণের স্থিতি, ছাড় ও পরিশোধের তথ্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটি একটি দেশের অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরে। বৈদেশিক ঋণের বোঝা ক্রমে বাড়ছে। এসব ঋণের অনেকগুলো পরিশোধের সময় ঘনিয়ে আসছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এটি কতখানি শঙ্কার কারণ হতে পারে তা বোঝার জন্য হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করতে হবে।

আমাদের আর্থিক খাতের একটা বড় সংকট হচ্ছে ঋণখেলাপি। বড় বড় ঋণখেলাপিরা সহজেই ঋণ পেয়ে যাচ্ছে। ফের খেলাপি হচ্ছে, কিন্তু তাদের আইনি জালে আটকানো যাচ্ছে না কেন?

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়ার পরও তাদেরকেই বড় আকারের ঋণ দেয়া প্রমাণ করে যে ঋণখেলাপিরা কতটা প্রভাবশালী। কখনো কখনো ঋণগ্রহীতারা খেলাপি হতেই পারে। যখন দেশের ভেতরে বা বাইরে কোনো সংকট সৃষ্টি হয় তখন মানুষের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতেই পারে। এর ফলে তারা ঋণখেলাপি হতে পারে। যেমন কভিড কিংবা ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে কিংবা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ব্যবসা খারাপ হয়ে যেতে পারে। তখন ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ পরিশোধ করা কষ্টকর হতে পারে। কিন্তু এখন যে ঋণখেলাপিরা ঋণ নিচ্ছে তারা অনেকেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। ঋণখেলাপি কিংবা বাজারে কারসাজি—সব একই সূত্রে গাঁথা। দুষ্ট পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। বিভিন্ন খাতে সুশাসনের অভাবে একটি গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি হয়েছে যা নিজেদের অনুকূলে নীতিমালা তৈরিতে প্রভাব ফেলছে। এ গোষ্ঠীতন্ত্রের সদস্যরা এতটাই প্রভাবশালী যে নীতিনির্ধারকরা তাদের কাছে অসহায়। ফলে খেলাপি ঋণ কমানো ও বাজার কারসাজি নিয়ন্ত্রণ কোনোটাতেই সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। নীতিনির্ধারকরা যেন অসহায় দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। আর সাধারণ মানুষের পকেটে টান পড়ছে। ইচ্ছাকৃত বড় বড় ঋণখেলাপিরা দেশের ব্যাংক খাতকে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

কৃষি, তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্সে নির্ভর করে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। সামনের দিনগুলোয় এগুলো কি আমাদের উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে পারবে?

এ তিন খাতই বাংলাদেশের অর্থনীতির স্তম্ভ। এগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। কিন্তু যেভাবে এ খাতগুলো এতদিন ভূমিকা রেখে এসেছে, তার মধ্যে কিছু কাঠামোগত ও গুণগত পরিবর্তন করতে হবে। যেমন ধরুন কৃষি। এখানে কৃষিপণ্যের বহুমুখিতা যেমন বাড়াতে হবে, আবার কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে মূল্যবর্ধক কৃষি খাত গড়ে তুলতে হবে। আমাদের জমি কম। তাই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। প্রক্রিয়াজাত করে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি বাড়াতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

এবার আসি তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে। আমরা সবসময় বলে আসছি যে একটা পণ্যের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে বাংলাদেশের রফতানি খাত কত দিন চলবে। তিন দশকের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এখনো এই একটি রফতানি পণ্য বৈদেশিক মুদ্রার মূল উৎস। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। তখন অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করে রফতানির বাজার ধরে রাখতে হবে। কেননা তখন শুল্ক মুক্ত বাণিজ্য সুবিধা থাকবে না। নতুন সুবিধা যেগুলো সৃষ্টি হবে, সেগুলোর জন্য অনেক কমপ্লায়েন্স পরিপালন করতে হবে। যেমন শ্রম অধিকার, মানবাধিকার, পরিবেশগত নীতিমালা ইত্যাদি পরিপালন করে বাজার সুবিধা পেতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ অন্যান্য দেশের সঙ্গে রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে বা আরসেপে হচ্ছে, যার মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতাসহ অর্থনীতির নানা খাতে সহযোগিতার সুযোগ থাকছে। তবে এর জন্য অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন রেগুলেটরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কমপ্লায়েন্সকে শক্তিশালী করতে হবে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও মানবদক্ষতা বাড়াতে হবে। নইলে আমরা বাজার হারাব। নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। সারা পৃথিবীতে এখন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। তাই আমাদের কম দক্ষতার কাজের চিন্তা বাদ দিয়ে উচ্চ দক্ষতার কাজের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। না হলে আমরা প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছে হেরে যাব।

প্রযুক্তির উন্নয়ন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটের কারণে জনশক্তিনির্ভর অনেক কাজই ভবিষ্যতে বাতিল হয়ে যাবে। আমরা এটা কীভাবে মোকাবেলা করব?

তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে উপার্জনমূলক কিছু করে। তবে সেটার জন্য তাদের মূলধন জোগাড় করে দিতে হবে। নতুন উদ্যোক্তাদের কেউ ঋণ দিতে চায় না। বাংকগুলো নিরাপদে থাকতে চায়। নতুনদের ঋণ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চায় না। অথচ বড় ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি হওয়ার পরও তাদের আবারো ঋণ দেয়া হয়। ছোট ও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। আর প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বলতে হয় যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পাস করা তরুণ-তরুণীরা যাতে তাদের প্রশিক্ষণ কাজে লাগাতে পারে সে ধরনের প্রশিক্ষণই দিতে হবে। ব্যক্তি খাতের নিয়োগকারীরা বলে থাকেন যে ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো থেকে পাস করা ব্যক্তিদের গুণগত মান তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। তাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর মান ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রশিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

আর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোর্স ডিজাইন করতে হবে। এ প্রশিক্ষিত জনগণকে কাজের জন্য বাইরে পাঠানোও সহজ হবে।

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিতে প্রভাব রাখছে, আমরা যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আমাদের সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম বলে মনে করেন কিনা?

সামনের মাসগুলোয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য যে ধরনের কর্মকাণ্ড দরকার সেগুলোয় হয়তো বেশি মন দেবে। যেমন কয়েকটি মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের কথা শোনা যাচ্ছে। ভৌত অবকাঠামো বেশি দৃশ্যমান বলে সরকারগুলোর অবকাঠামোতেই বেশি উৎসাহ থাকে। কিন্তু এতে করে সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার অধীনে কি পর্যাপ্ত সহায়তা রয়েছে? কিংবা আর্থিক খাতের উচ্চ ঋণখেলাপির পরিমাণ কমানো, রাজস্ব আয় বাড়ানো, বহিঃখাতের দুর্বলতা কাটানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশী ঋণের বোঝা কমিয়ে আনা, চলমান প্রকল্পগুলো দক্ষভাবে সম্পন্ন করা, সরকারি ব্যয় কমানো, যুব সম্প্রদায়ের জন্য যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি বহু চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে। আগামী কয়েক মাসে সবকিছু পূরণ করা সম্ভব নয়। এগুলোর কোনো কোনোটি স্বল্পমেয়াদে করা যাবে, আবার কোনো কোনোটির জন্য বেশি সময় লাগবে। আগামী নির্বাচনে যে দল ক্ষমতায় আসবে তাদের শুরু থেকেই সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে যথেষ্ট কাজ করতে হবে।