গ্যাসের দাম বৃদ্ধি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে প্রভাব ফেলবে: ড. ফাহমিদা খাতুন

Published in যুগান্তর on Monday 1 July 2019

গ্যাস ও করের চাপে পিষ্ট হবে জনজীবন

নতুন বাজেটে বিভিন্ন নিত্যপণ্যে ভ্যাটসহ (মূল্য সংযোজন কর) বাড়তি কর আরোপের পর অর্থবছরের প্রথম দিনই গ্যাসের দাম বাড়াল। আজ থেকেই অবশিষ্ট পণ্যের ওপর ভ্যাট এবং গ্যাসের মূল্য কার্যকর হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা ও সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তে সব শ্রেণীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সব নিত্যপণ্যের দাম, বিদ্যুৎ, পরিবহন, বাসা ভাড়া, কৃষিপণ্য এবং সেবার খরচ বাড়বে। সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস উঠবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের।

তাদের মতে, দেশে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে রফতানি ও শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থনীতিতে বৈষম্য কমানো ও শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জোরালো সুপারিশ করেছেন তারা। এদিকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন। সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, জ্বালানি দুর্নীতি না কমিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ানো সুশাসনের পরিপন্থী।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন করের পর গ্যাসের দাম বাড়ানো হল। ফলে এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষের জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, জ্বালানি ও ভ্যাটের সঙ্গে সবকিছু জড়িত। বিশেষ করে পণ্যের দাম, পরিবহন ব্যয় এবং বাসাভাড়া। ফলে এর প্রভাব জীবনযাত্রার সবগুলো খাতেই পড়বে। তিনি আরও বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ফলে বড় একটি শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যাবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্তরা হয়তো সঞ্চয় ভেঙে খাবে, অথবা তাদের জীবনযাত্রার মান কমবে। তার মতে, দেশের উৎপাদিত পণ্যের খরচ বেড়ে যাবে। এর ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত এবং দেশীয় শিল্প আরও প্রতিযোগিতায় পড়বে। তিনি বলেন, দেশের বণ্টন ব্যবস্থায় সমস্যা রয়েছে। ফলে কিছু মানুষের আয় বাড়লেও তাদের সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি তেমন লাভবান হয় না।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সদ্য বিদায়ী সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন রোববার যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন কর আরোপের পর গ্যাসের দাম বাড়ানো হল। এতে ব্যবসার খরচ বাড়বে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সুদের হার কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সুদের হারতো কমেনি। এর মানে হল পুঁজির খরচ বেশি। এছাড়াও বাংলাদেশে জমির দাম বেশি। এরপর ব্যবস্থাপনা ব্যয়, শ্রমিকের খরচ বেড়েছে। ফলে কিসের ওপর ভিত্তি করে শিল্পায়ন হবে, তা বুঝে আসে না। তিনি বলেন, রফতানিকারকদের টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হল। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চালু হওয়ার আগে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করা উচিত। এটি করতে না পারলেই সমস্যায় পড়বেন দেশি উদ্যোক্তারা। এ কারণে আমি মনে করি, গ্যাসের দাম ও কর বাড়ানোর আগে আরও চিন্তা করা উচিত। কারণ অর্থনীতিতে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে আয় বাড়ানোর জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ চাপে পড়বে। ৫টি মৌলিক চাহিদার ৩টির বিপরীতেই কোনো না কোনোভাবে কর বাড়ানো হয়েছে। বরাদ্দের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এছাড়াও শিল্পের কাঁচামালের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এরপরই রোববার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়।

সহজে ব্যবসা করা সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের সূচককে বলা হয়, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট। ওই রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। এর মানে হল, বাংলাদেশে ব্যবসা করা অত্যন্ত কঠিন। বিশ্বব্যাংকের ওই রিপোর্টে বাংলাদেশের ব্যবসা করার ব্যাপারে যে প্রতিবন্ধকতার কথা বলা হয়েছে- এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুতের সংযোগের অভাব ও দাম বেশি, জমিস্বল্পতা, বিভিন্ন আইনকানুনে সীমাবদ্ধতা, পুঁজির সহজলভ্যতার অভাব (ঋণের সুদ বেশি) এবং চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া। এরপর গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় আরও পিছিয়ে পড়বেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটে বাড়তি কর আরোপের কারণে প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবন-যাত্রার খরচ অনেকাংশেই বাড়িয়ে দেবে। এবারের বাজেটে সুনির্দিষ্টভাবে যে সব উদ্যোগ মধ্যবিত্তকে চাপে ফেলবে এর মধ্যে রয়েছে- করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানো। বিভিন্ন মহলের দাবির পরও আগের বছরের মতো করমুক্ত আয় সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। পোশাকে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কেউ পোশাক কিনলে আগে মোট দামের ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। নতুন বাজেটে তা আরও আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়াও পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে দর্জি দোকানের মূল্য পরিশোধের ওপর নতুন করে ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের ওপর কর বাড়ানো এবং খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়াও পুরো বাজেটে প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। যা ভোক্তা শ্রেণীর ব্যয় বাড়াবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ অর্থনীতির সাম্য নীতির পরিপন্থী।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন যুগান্তরকে বলেন, এবারের বাজেটে বিভিন্ন পণ্যে কর বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানো হয়নি। এরপর গ্যাসের দাম বাড়ানো হল। স্বাভাবিকভাবে এটি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিু ও মধ্যবিত্তরা এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, সীমিত আয়ের চাকরিজীবী এবং গ্রামের নিু আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলবে।

বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করছেন ফখরুল ইসলাম। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে তিনি বলেন, সবকিছুর খরচ বেড়ে গেল। কিন্তু আমাদের আয় বাড়েনি। বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত। মতিঝিলের সিএনজিচালক চাঁন মিয়া জানান, গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মালিক প্রতিদিনের জমা কম নেবেন না। ফলে বাড়তি গ্যাসের দাম আমাদের যাত্রীর কাছ থেকেই আদায় করতে হবে।

এদিকে গণপরিবহনে ব্যবহৃত সিএনজি গ্যাসের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে রোববার এ দাবি জানানো হয়।

গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। দলটির পলিটব্যুরোর এক বিবৃতিতে বলা হয়, সংসদে বাজেট পাসের আগেই গ্যাসের দাম ৩২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া হল। এতে শুধু গৃহস্থালিতেই প্রভাব পড়বে না, পরিবহন, শিল্প খাত ও বিদ্যুৎ খাতসহ সব ক্ষেত্রেই দাম বাড়বে। এ দাম বৃদ্ধির প্রভাব গরিব-মধ্যবিত্তের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করবে।