চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in মানব জমিন on 7 December 2023

অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কিংবা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার যে আলোচনা এটাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ এর সঙ্গে অর্থনীতি এবং রাজনীতি অনেক কিছুই জড়িত। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার জন্য আমাদের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এমন কিছু হলে তা সাধারণের জন্য, উদ্যোক্তাদের জন্য, শ্রমিকদের জন্য ইতিবাচক হবে না। সুতরাং তাদের যেসব সাবধানতা বা সতর্কবাণী, যেসব ইস্যু নিয়ে তারা বলছে তা আমাদের অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন। দেশের রিজার্ভ, অর্থনৈতিক ঝুঁকিসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।

বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির বিষয়ে যে আলোচনা আছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, শ্রমিক অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন, কীভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে- এসব নিয়ে তারা অনেক বছর ধরেই বলে আসছে। এমনকি ইপিজেড, স্পেশাল ইকোনমিক জোনে ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। এসব তারা বলার জন্যই নয়, আমাদের দেশের শ্রমিকদের জন্য এসব আমাদেরই করার কথা ছিল। শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার আমাদেরই দিতে হবে।

এসবের বাইরেও তারা যেসব কথা বলছে- সুশাসন, লিঙ্গসমতা; এইসব বিষয়েও আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। আবার তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। তাদের গালাগালি করে কোনো লাভ হবে না। তাদের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার মধ্যদিয়ে আমাদের মধ্যেও এইসব বিষয়ে ছাড় দেয়ার মানসিকতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আমরা অনেক কিছু করেছি। আবার অনেক কিছু করিনি। তাই এসবের গুরুত্ব অনুধাবন করে এগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকারভাবে করতে হবে। আমরা দেখেছি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের বাজার সুবিধার উপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কোনো কোনো জায়গায় শুল্কের উপর আরও শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় বাজার সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা যাতে এটার সম্মুখীন না হই। এমনটা হলে দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে সার্বিক পরিস্থিতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের কাছ থেকে যেসব পরামর্শ, সংস্কারের প্রস্তাব ও চাহিদা রাখা হয়েছে তা পালন করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দিন দিন দেশের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি একটি চাপের মধ্যে আছে। পাশাপাশি কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যদিয়েও যাচ্ছে-একথা অনস্বীকার্য। আমাদের অর্থনীতির যে বিভিন্ন সূচক রয়েছে, সেসবেও এটা প্রতিফলিত হচ্ছে। রিজার্ভের প্রতিনিয়ত অবনমন হচ্ছে, টাকার মান কমছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির যে উচ্চ প্রবণতা, সেটি ঊর্ধ্বমুখীই রয়ে গেছে। কিছুটা নিম্নমুখী হওয়ার যে কথা ছিল তা হয়নি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার যে ক্ষতি হচ্ছে তা অব্যাহত আছে। মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে থাকার ফলে নিম্নমধ্যবিত্ত, স্থির আয়ের মনুষ, নিম্ন আয়ের মানুষ সবার ক্রয়ক্ষমতার উপর এটার একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

এই পরিস্থিতি অর্থনীতিতে নতুন বিনিয়োগ, নতুন ঋণ, ঋণের হার, সুদের হার, বৈদেশিক বিনিয়োগ এসব কিছুতে আবার নেতিবাচিক প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এটা প্রবৃদ্ধিতেও একটা চাপ সৃষ্টি করবে। এমনটি এটা জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে। এসবের সবটাই যে এখানকার ছিল তা নয়, আমাদের একটি কোভিড মহামারি গিয়েছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়ে এগুলো মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে পারতাম, সেসব পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দুর্বলতা ছিল। আমাদের ঋণখেলাপির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হচ্ছে। গ্লোবাল রিপোর্ট অনুযায়ী গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭০ বিলিয়নের উপরে ডলার পাচার হয়েছে। একটি হুন্ডি চক্র গড়ে উঠেছে। যারা এটাকে সহায়তা করছে, অনেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে দেশের বাইরে বাড়িঘর বানাচ্ছেন। পুঁজি পাচার করছেন। কানাডায় বাড়ি হচ্ছে, সিঙ্গাপুরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে, মালয়েশিয়ায় ব্যবসা খোলা হচ্ছে। এসব নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। করখেলাপির কথা তোলা হয়েছে। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার তা নেয়া হচ্ছে না। করখেলাপি, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা হচ্ছে না। এরজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার বা আইনি ব্যবস্থা নেয়ার মতো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এসবের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যে সংস্কার দরকার সেটাও হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে যখন বাইরে থেকে অর্থনীতির উপর এমন একটি চাপ এলো তখন আমরা আর সেটি সামাল দিতে পারছি না। এটা তখন কঠিন হয়ে দেখা দিলো।

তিনি বলেন, বিগত এক দশকে দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে। এসবের প্রতিকার উল্লেখ করে তিনি জানান- আমাদের টাকা পাচারকারী, ঋণখেলাপি, করখেলাপি, হুন্ডি এসবের বিরুদ্ধে জোরালো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের মধ্যে যারা সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজার ব্যবস্থাপনা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। এসব দক্ষতার সঙ্গে করে অর্থনীতিকে আরেকটি ভারসাম্য অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে। এটা যন্ত্রণাহীন হবে না। একটা যন্ত্রণার মধ্যদিয়েই এটা করতে হবে। আমাদের সুদের হারকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। আমাদের বিনিময় হারকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। ইতিমধ্যে মানুষ বাজারে গিয়ে বেদনা অনুভব করছে। তাই বেদনা অনুভব করলেও আরও ব্যবস্থা নিয়ে এটাকে সামাল দিতে হবে। পুরনো কথা আবারো বলতে হবে- সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। অর্থনীতিতে এখন যে অনিশ্চয়তা রয়েছে কাটিয়ে নিশ্চয়তা, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ, একটি অনিশ্চয়তা আরও অনেক অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। এখন সামনে নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচনের সময়ে তো আর অর্থনীতির চাকা থেমে থাকবে না। নির্বাচনের ডামাডোলে যেন অর্থনীতি থেকে দৃষ্টিটা অন্যদিকে চলে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এটা সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এখন অর্থনীতি যে চাপের মধ্যে আছে সেটা যাতে আরও অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সেটা দেখতে হবে। নির্বাচনের পরে আমরা সংস্কার করবো- এসব বললে হবে না। যেগুলো এখন করা যায়, তা এখনই শুরু করে দিতে হবে। অপেক্ষা করা যাবে না। সুদের হার, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হার, বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এখন এই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে দেশ থেকে যাতে সম্পদ বাইরে চলে না যায়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি নজরদারি ও খবরদারি বাড়াতে হবে। তাদের যে ক্ষমতা দেয়া আছে, তা প্রয়োগ করতে হবে।

আবার এই সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি তা চালু করতে হবে। অবস্থা ভেদে অব্যাহত রাখতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং বাজার স্তর থেকে ভোক্তা স্তরের মধ্যে যে মধ্যস্বত্বভোগী গড়ে উঠে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাজারে যে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা গড়ে উঠে তা দেখতে হবে। ধরা যাক, কাওরান বাজার থেকে মিরপুরে এসেই যে পণ্যের দাম হেরফের হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। আমদানি থেকে খুচরা ক্রেতা পর্যায় পর্যন্ত কয়েক স্তরে দাম বেড়ে যায়। এটা দেখতে হবে। এসব নিয়ন্ত্রণে আমাদের ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ও অধিদপ্তরকে কাজে লাগাতে হবে। এইসব প্রতিষ্ঠানের যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা আছে তা প্রয়োগ করতে হবে।