ছোট কারখানাগুলোর দুর্বলতা পোশাক খাতের কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে বড় চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাক খাতটি কোভিড-১৯-এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে যাচ্ছে। যদিও সরকার ঘোষিত প্রণোদনার কারণে এই চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণে কারখানাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। এই খাতের পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটির ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে ছোট, পোশাক সংগঠনের সদস্য নয় এমন এবং নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে অধিক পরিমাণ সমস্যা লক্ষ করা যাচ্ছে। ঋণ প্রাপ্তির জটিলতার কারণে বেশীরভাগ ছোট কারখানাগুলো ঋণের জন্য আবেদন করেনি। ৯০ শতাংশ বড় কারখানার বিপরীতে মাত্র ৪০ শতাংশ ছোট কারখানা এই আবেদন করেন। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কারখানাগুলো অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ও ব্যাংকের আমানতের উপর বেশী নির্ভরশীল ছিল।

এই সকল তথ্য উঠে আসে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্টের (সিইডি) ম্যাপড ইন বাংলাদেশ (এমআইবি) যৌথ গবেষণা থেকে। যা তুলে ধরা হয় “কোভিড-১৯ বিবেচনায় পোশাক খাতে দুর্বলতা, সহনশীলতা এবং পুনরুদ্ধার: জরিপের ফলাফল”, শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে। সংলাপটি শনিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২১-এ আয়োজিত হয়।

সংলাপে সূচনা বক্তব্য প্রদান করে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক, . ফাহমিদা খাতুন। তিনি সিপিডি ও  এমআইবি-এর এই গবেষণার কথা উল্লেখ করে বলেন যে মোট ৬১০টি পোশাক কারখানায় এই জরিপটি পরিচালনা করা হয় যার ফলে কোভিড-১৯ বিবেচনায় পোশাক খাতে দুর্বলতা, সহনশীলতা এবং পুনরুদ্ধারকে বিশ্লেষণ করা সহজতর হবে। এই গবেষণার মাধ্যমে পোশাক খাতকে পুনরুদ্ধারে মধ্যমেয়াদী পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।

সংলাপের সঞ্চালনা করেন এমআইবিএর প্রকল্প ব্যবস্থাপক জনাব সৈয়দ হাসিবুদ্দিন হাসিব। তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে তিনি এই গবেষণার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং তথ্য প্রাপ্তির গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন।

সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক, . খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনার আবেদন প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। সদস্য নয় এমন কারখানাগুলোকে অনতিবিলম্বে এ্যাসোসিয়েশনের সদ্যস্যভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার প্রক্রিয়াটিকে কমপ্লায়েন্সের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) ও বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর দায়িত্ব নিয়ে সামনে এসে শ্রমিকদের তালিকা সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। কারাখানার শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দিকে আরও জোর দেওয়ার কথাও উঠে আসে এই উপস্থাপনায়। তিনি বলেন যে পোশাক খাতের ভবিষ্যতের বিকাশের জন্য ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন বিভাগে আরও বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) বিবেচনা করা উচিত।

পোষাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের অবদানের কথা তুলে ধরে সংলাপের বিশেষ অতিথি শিরীণ আখতার, এমপি বলেন, কোভিডের সময়কালে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করলেও পোশাকশিল্প আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এই সময়ে আমরা অনুধাবন করেছি, আপদকালীন সময়ের জন্য আমাদের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা সবার কাছে সঠিকভাবে পৌছাচ্ছে কী না তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সুশাসনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। যারা কাজ হারিয়েছেন বা যেসকল কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে তাদের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। শ্রমিকেদের প্রশিক্ষন এবং স্বাস্থ্যগত বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এছাড়াও শ্রমিকরা যেনো ন্যূনতম মজুরি পায় সেটাও দেখা দরকার। শ্রমিকরা কখন কোভিডের টিকা পাবেন সে বিষয়েও আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে সংলাপের সম্মানিত অতিথি, বিকেএমইএ-এর সহ-সভাপতি জনাব মোহাম্মদ হাতেম বলেন যে বেশীরভাগ শ্রমিকের পর্যাপ্ত পরিমাণ কাগজ না থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বেতন দেবার ক্ষেত্রে বিজিএমইএ-র পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন সিপিডির প্রস্তাবনার সাথে সহমত প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন যে ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ করতে হবে।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন যে এই গবেষণায় সার্বিক পরিস্থিতি উঠে আসলেও করোনার কারণে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলোকে আলাদা করে দেখার সুযোগ রয়েছে। শ্রমিকদের করোনা পরীক্ষার অপর্যাপ্ততা কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন যে, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা সর্বাগ্রে ভেবে দেখতে হবে। মিসামি গার্মেন্টস ও বিজিএমইএ-এর পরিচালক জনাব মিরান আলী সংলাপে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

সংলাপের সভাপতি, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডি বলেন কোভিড পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি শ্রমিকদের জন্য একটি সামাজিক সুরক্ষা বীমারও প্রস্তাব করেন, যেখানে মালিক, শ্রমিক, সরকার, ক্রেতা এবং উন্নয়ন অংশীদাররা অংশ নেবে।

সিইডিএর উপদেষ্টা অধ্যাপক রহিম বি তালুকদার সংলাপে সমাপনি বক্তব্য প্রদান করেন।

সংলাপে সাংবাদিক, গবেষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশাজীবীসহ অনেকে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত তুলে ধরেন।