শুধু জাতীয় আয় নয়, জাতীয় উন্নয়ন দরকার

ড. নুসরাতে আজীজ 

Assistant Professor of Economics at Algoma University, Ontario, Canada
Email: nusrate.aziz@algomau.ca

জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্দেশ করলেও এটাই জাতীয় উন্নয়নের একমাত্র নিয়ামক নয়। সাম্প্রতিককালে অর্থনীতিবিদরা তাই মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) থেকে সরে গিয়ে মোট জাতীয় কল্যাণ (জিএনডাব্লিও) কে একটি দেশের উন্নয়নের মূল সূচক হিসাবে ব্যবহার করার তাগিদ দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, জাতীয় কল্যাণের হিসেবে জাতীয় আয়কেও বিবেচনায় আনা হয়। অধিকন্তু, এতে নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত বিষয়, শারীরিক ও মানুষিক অবস্থা ও বিবেচনায় রাখা হয়। তাই জাতীয় কল্যাণের হিসেব জাতীয় আয়ের হিসাবের চাইতে উৎকৃষ্টতর।

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন জাতীয় আয় দিয়ে মাপা যেতে পারে। কিন্তু একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে শুধু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি দিয়ে পরিমাপ করলে ভুল হবে। একটি দেশের উন্নয়ন বলতে সে দেশের নাগরিকদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক, স্বাস্থ্যগত, অবকাঠামোগত, পরিবেশগত উন্নয়নকে বুঝায়।

উদাহরণস্বরূপ, কোনো দেশে যদি ৯০ ভাগ মানুষের আয় কমে, কিন্তু সে দেশের শুধু ১০ ভাগ মানুষের আয় যদি অত্যধিক বাড়ে তবে সে দেশের জিডিপিতে বেশ প্রবৃদ্ধি দেখা যেতে পারে। কিন্তু এ ধরণের সে প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের কোনো কল্যানে আসে না। এটি জাতীয় আয়ের বন্টনে বৈষম্য বাড়ায়। এতে একশ্রেণীর লোক সুবিধা ভোগ করলেও বেশিরভাগ লোকের জীবন যাত্রার মান কমে যায়। একশ্রেণীর লোকের ভোগ বিলাস বাড়লেও সিংহভাগ লোকের দুঃখ দুর্দশা বাড়ে। এতে জাতীয় কল্যাণ কমে।

বাংলাদেশে আমরা এ ধরণের উন্নয়ন প্রবণতা লক্ষ্য করছি। দেশে কিছু লোক পাহাড়সম অর্থের মালিক হচ্ছে, যারা আবার দেশের বাইরে সে অর্থ পাচার করছে। দেশে বিনিয়োগ না হয়ে এই ধনিক শ্রেণীর অর্থ (যা দেশীয় বিনিয়োগের জন্যে পুঁজি) দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। যাতে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

দেশে আয়ের বৈষম্য যে বেড়েছে তা নিম্নের তথ্য থেকে আরো পরিষ্কার হবে। উল্লেখ্য, অর্থনীতিবিদরা একটি দেশের জাতীয় আয়ের বন্টন সুসম নাকি অসম হয়েছে তা পরিমাপ করার জন্যে ‘জিনি সূচক’ ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের ‘জিনি সূচক’ থেকে দেখা যায়, ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১০ সালে আয়ের বৈষম্য কমলেও ২০১০ এর তুলনায় ২০১ ৫ সালে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে।

অন্যদিকে, ধরুন, একটা দেশে “জাতীয় আয়” বেড়েছে কিন্তু সে দেশে দূর্নীতি খুব বেশি, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অনেক বেশি, সাধারণ মানুষ শোষিত হচ্ছে, জনজীবনে অশান্তি, রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, ব্যক্তি স্বাধীনতা কম, নাগরিকের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, নিত্যপ্রয়োজনীর দ্রব্যমূল্য সাধারণ নাগরিকের নাগালের বাইরে, বেকারত্ব বেশি সে দেশে জাতীয় আয় বাড়লেও জাতীয় কল্যাণ কমে যায়।

বাংলাদেশকেই উদাহরণ হিসেবে নেয়া যাক। উল্লেখ্য, “ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট” ২০০৫ সাল থেকে মোট জাতীয় কল্যাণের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। কিন্তু তাদের সংগ্রহে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের মোট জাতীয় কল্যাণের তথ্য রয়েছে ২০০৬ সাল থেকে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো জাতীয় কল্যাণের সূচক পরিমাপ করছে বলে আমার জানা নেই। আমার আলোচনা তাই ২০০৬-২০১৭ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

অন্যদিকে, আমি জাতীয় আয় এবং মূল্যস্ফীতির তথ্য দিচ্ছি বিশ্ব ব্যাঙ্কের সংগৃহিত তথ্য থেকে। জেনে রাখা ভালো যে, বিশ্বব্যাঙ্ক সাধারণত তথ্য নেয় প্রতিটি দেশের জাতীয় জরিপ থেকে।

২০০৬ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় কল্যাণের সূচক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দেশের জাতীয় কল্যাণ ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বাড়লেও এরপর ক্রমান্বয়ে কমেছে। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের মোট জাতীয় কল্যাণ স্বল্পমাত্রায় নিম্নমুখী হলেও ২০১১ সালের পর থেকে এই সূচক অতিমাত্রায় কমতে থাকে। ২০১৭ সালে এটি পৌঁছে সর্বনিন্ম পর্যায়ে। ২০০৯ এর তুলনায় ২০১৭ সালে জাতীয় কল্যাণ কমেছে শতকরা আট ভাগ।

অন্যদিকে, বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ২০০৬-২০০৮ সালে (কেয়ারটেকার সরকারের আমলে) জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে শতকরা ৬.৯ ভাগ যা ২০০৯ -২০১৭ তে কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৬.৩ ভাগ। গড়ে ২০০৬-২০১৭ দেশের জিডিপি বেড়েছে শতকরা প্রায় ৬.৪ ভাগ। যদিও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ গড়ে শতকরা ৯-১০ ভাগ প্রবৃদ্ধির ক্ষমতা রাখে, কিন্তু বর্তমানে দেশে গড়ে শতকরা ৬ থেকে ৭ ভাগ হরে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্যে মন্দ নয়।

প্রশ্ন হলো – কেন জাতীয় আয় বাড়লেও বাংলাদেশের জাতীয় কল্যাণ কমছে?

২০০৬-২০১৭ সময় কালে প্রতিবছর বাংলাদেশে গড়ে শতকরা ৭.৩ ভাগ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। গত ১২ বছরে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে শতকরা ৮৮ ভাগ। এর মধ্যে ২০০৬-২০০৮ সালে বেড়েছে শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ। আর ২০০৯-২০১৭ সময়কালে বেড়েছে শতকরা প্রায় ৬৩ ভাগ। শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগের বেশি মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্যে ক্ষতিকর। দেশের শতকরা ৭.৩ ভাগ মূল্যস্ফীতি একটু বেশি হলেও তা সহনীয় হতো যদি আয়ের বৈষম্য কমতো। দেশে বরং আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। ফলে দ্রব্যমূল্য নিম্ন থেকে মধ্য আয়ের লোকদের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এতে জাতীয় কল্যাণ কমেছে ।

যেমনটি আগেই বলেছি, দেশে মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা (গণতন্ত্র) আছে কি নেই সেটিও একটি দেশের মোট জাতীয় কল্যাণ নিরুপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রে ভিত্তিক “সেন্টার ফর সিস্টেমেটিক পিস” এর তথ্য অনুসারে, ২০০৬ সালে যেখানে বাংলাদেশ প্রায় অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল, সেটি ২০১৭ সালে সর্বনিন্ম পর্যায়ে নেমেছে। দেশে ২০০৬ সালে শতকরা ৮০ ভাগ গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলেও ২০১৭ সালে সেটি শতকরা ৫৫ ভাগে নেমে গেছে। উল্লেখ্য, ২০০৭-২০০৮ সালে কেয়ারটেকার সরকারের নামে সামরিক শাসন চলছিল। গণতন্ত্র পরিমাপের সূচক অনুযায়ী সে সময়ের মাত্র শতকরা ২০ ভাগ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল।

জাতীয় কল্যাণ নিরুপনে দুর্নীতির সূচকের ও ভূমিকা রয়েছে। “ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের” তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০০৬-০৭ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনে কিছুটা উন্নতি করেছে। যেখানে ২০০৬-০৭ দেশে শতকরা ৮০ ভাগ দুর্নীতি হয়েছিল তা ২০১৭ সালে তা শতকরা ৭২ ভাগে নেমেছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিশ্বব্যাঙ্ক ও প্রায় একই রকম তথ্য দিচ্ছে যে ২০১৭ সালে দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। যদিও বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে এখনো (২০১৭ সালেও) শতকরা ৮০ ভাগের বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। বলাই বাহুল্য, দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দেশে একটি “দুর্নীতি দমন কমিশন” থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দুর্নীতি দমনে তেমন সাফল্য দেখাতে পারছে না। একটা দেশে দুর্নীতিতে যদি শতকরা ৭২ থেকে ৮০ ভাগ সম্পদ চলে যায়, সে দেশে আর কতটা জাতীয় উন্নতি বা কল্যাণ আশা করা যায়?

উপরের তথ্য থেকে এটি পরিষ্কার যে, দুর্নীতি দমন আর গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্যে সবচে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে নির্বাচনের দিন ঠিক হয়েছে। এখনই সময়, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের রাজনৈতিক ইশতেহারে উল্লেখ করতে হবে – ক্ষমতায় গেলে কে কিভাবে আয়ের বৈষম্য আর দুর্নীতি কমাবে, এবং মানুষের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। ক্ষমতায় গেলে, তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে দেশে জাতীয় আয় বাড়া হয়তো অব্যহত থাকবে কিন্তু দেশের সার্বিক উন্নয়ন তথা সর্বসাধারণের জীবন মানের উন্নতি অসম্ভব।