জিআই টাঙ্গাইল শাড়ি প্রসঙ্গ: বাংলাদেশে মাল্টিডিসিপ্লিনারি জিআই টাস্কফোর্স গঠন জরুরি

Download Presentation

বাংলাদেশের হাতে এখনো সময় আছে। ভারতের জিআই আইন অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে আপত্তি জানানো যায়, আপিল করা যায়। সুতরাং বাংলাদেশের দ্রুতসম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, বিশ্ব মেধা সম্পদ সংস্থা, সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এবং আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।  

ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে চলমান অসন্তোষে, ‘টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি: প্রক্রিয়া, পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের করণীয়’ শিরোনামে সাংবাদিকদের সাথে একটি আলাপচারিতা অনুষ্ঠিত হয় শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখে, সিপিডি কার্যালয়ে। ড. ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি এই আলোচনাটি সভাপতিত্ব করেন। আলাপচারিতায় অংশ নেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি এবং কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।

ড. ফাহমিদা খাতুন তাঁর প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন বাংলাদেশের বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক সত্ত্ব দিতে সিপিডি সবসময় কাজ করে এসেছে। যেকোন এলাকার বৈশিষ্ট্য জড়িত পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক করার মাধ্যমে সেই পণ্যের ওপর একটি আইনত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক হলেও টাঙ্গাইল শাড়ির সত্ত্ব প্রতিবেশী দেশ ভারত নিয়েছে এবং এ নিয়েই সমালোচনা ঝড় উঠেছে। এ বিষয়টি কেন গুরুত্বপূর্ণ, কেন  এমন ঘটল এবং এ মূহুর্তে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন উপস্থিত সকলে।

সভায় মূল বক্তা ড. ভট্টাচার্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের আলোকে এ বিষয়ে তাঁর উপস্থাপনা তুলে ধরেন। এই উপস্থাপনায় তাকে সহায়তা করেন নাইমা জাহান তৃষা, প্রোগ্রাম সহযোগী, সিপিডি।

তিনি বলেন ভারতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের বিষয়টি দীর্ঘদিন প্রক্রিয়াধীন ছিল। তিনি আক্ষেপের সাথে বলেন বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে বিষয়টি ৪ বছর ধরে বিকাশ লাভ করেছে, অথচ আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, উৎপাদক, তাঁতি, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী কেউই কোনো অভিযোগ করেনি।

সিপিডি গত ১০ বছর আগে, বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সাথে যৌথভাবে একটা বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে সরকারের সাথে দেনদরবার করে জামদানি শাড়িকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। এই উদ্যোগে রুবি গজনবীর অবদানকে তিনি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। টাঙ্গাইল শাড়ির বিষয়টিও ব্যতিক্রম নয়। সেই কাজের ধারাবাহিকতায় সিপিডি, চিন্তক সংগঠন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।

ভারতে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই আবেদনে তথ্যের অসংগতি, তাদের বক্তব্যকে উধৃতি করে ড. ভট্টাচার্য বলেন, ভারত বলেছে টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদকেরা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন। দেশভাগের সময় টাঙ্গাইল থেকে হিন্দু তাঁতশিল্পীরা দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ পারি দেয়, তাই টাঙ্গাইল শাড়িও পশ্চিমবঙ্গের। কিন্তু আদতে টাঙ্গাইল অঞ্চলে শুধু হিন্দু নয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকে এই শাড়ি তৈরিতে জড়িত আছে কারন তাঁতি বৈশিষ্ট্যটি পেশাভিত্তিক, ধর্মভিত্তিক নয়।

ড. ভট্টাচার্য বলেন, জিআই স্বীকৃতির জন্য তার ভৌগোলিক উৎস, সুনাম এবং অবহিতকরণের বিষয় বুঝতে হবে। এর সাথে সুনির্দিষ্টভাবে অর্থনৈতিক স্বার্থও সংশ্লিষ্ট আছে।

একটি উদাহরণ দিয়ে ড. ভট্টাচার্য বলেন আমাদের উদ্যোগহীনতা, অজ্ঞতা এবং অসচেতনতা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের যে ২১টি পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত, তাঁর মধ্যে ‘ঢাকাই মসলিন’ও আছে। কিন্তু ভারত ‘বাংলার মসলিন’ বলে জিআই পণ্যের সত্ত্ব পেতে ইতমধ্যেই আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা হয়ত এখনো অবগত নয়।

তাই ভবিষ্যতে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে বাংলাদেশ ও ভারতের যা কিছু সমনামী কিংবা অভিন্ন পণ্য আছে সেগুলো পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর এর অধীনে নিবন্ধন করতে হবে। এবং এটি তারাহুড়ো না করে স্বচ্ছতা, সততা এবং যৌক্তিকভাবে নিয়ম অনুযায়ী পরিপালন করতে হবে। ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে তাদের দক্ষ আইনজ্ঞ নিয়োগ করতে হবে। জিআই জার্নালে নিয়মিতভাবে পরীবিক্ষণ করতে হবে। এছাড়া বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আইন- প্যারিস কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি (১৮৮৩), মাদ্রিদি এগ্রিমেন্ট অন ইনডিকেটর অব সোর্স (১৮৯১), লিসবনি এগ্রিমেন্ট ফর দ্য প্রোটেকশন অব অরিজিন অ্যান্ড দেয়ার ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন (১৯৫৮) এবং ডব্লিউটিওর বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্ব আইন (ট্রিপস-১৯৯৪) যা আমাদের পণ্যকে সুরক্ষা দেবে।

এছাড়া, মেধাসত্ত্ব আইনে ঐতিহ্যগত জ্ঞান (ট্রাডিশনাল নলেজ) বলে আরেকটি ধারা যুক্ত হয়েছে। প্রথাগত বিভিন্ন জ্ঞান, গান, রূপকথা নিজের বলে দাবি না করতে পারলে, যে ধরণের আয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেটা থাকবেনা। যেমন তিনি লাললনগীতির উদাহরণ দিয়ে বলেন, আগামীতে কেউ যদি লালনগীতিকে নিজস্ব সম্পদ বলে নিবন্ধন করে তাহলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে।

চেতনা, উদ্যোগহীনতা এবং সচেতনতার অভাবে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে উত্তরণ করতে জিআই সম্পর্কিত একটি দক্ষ টাস্কফোর্স দ্রুততার সাথে গঠন করার প্রস্তাব করেন ড. দেবপ্রিয়। কারণ মেধাসত্ত্ব বিষয়টি মাল্টিডিসিপ্লিনারি। এটিকে একক কোন ডিসিপ্লিন দিয়ে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। এখানে নৃতত্ব, ইতিহাসজ্ঞান, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ, সরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন যারা বিষয়গুলো সম্পর্কে তৎপর থাকবেন, পরীবিক্ষন এবং মূল্যায়ণ করবেন।

সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, বলেন বর্তমান বিষয়টিকে শুধুমাত্র কেস স্টাডি হিসেবে না দেখে, আমাদের সক্ষমতা বৃহত্তর পর্যায় কিভাবে বাড়াতে পারি, সেদিকে নজর দিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া এবং ফলাফল দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আইনী ও মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিশেষগজ্ঞের দরকার হবে, ডাব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি-তে যেতে হলে দক্ষ জনবল প্রয়োজন- এখানে আমদের দূর্বলতা রয়ে গেছে। বৃহত্তর পরিসরে সক্ষমতা বৃদ্ধিই এখন আমাদের করণীয়।

আলোচনা শেষে ড. খাতুন ধন্যবাদ জানান নেটিজেনদের, যারা এই বিষয়টির প্রতি ক্ষোভ এবং নিন্দা প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তোলেন। তাদের এই সচেতনতাবোধ দেশপ্রেমেরই নির্দেশক।