ডলারের বিপরীতে টাকার মান অতিমূল্যায়িত ছিল – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বিবিসি বাংলা on 5 July 2023

ডলারের বিপরীতে টাকার মান কোন দিকে যাচ্ছে?

টাকার বিপরীতে ডলারের মান এক লাফে ২.৮৫ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৮.৮৫ টাকা। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ডলারের বিপরীতে টাকার ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় দরপতন।

সোমবার অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশ বা এবিবি এবং বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন বা বাফেদা এক বৈঠকের পর যৌথভাবে ডলারের দাম সমন্বয়ের এই ঘোষণা দেয়া হয়।

এতে বলা হয়, আন্তঃব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ১০৮.৮৫ টাকা করে কেনাবেচা করা হবে। একই দামে কেনা হবে রেমিটেন্সও। রপ্তানীর ক্ষেত্রে এক টাকা কমে ১০৭.৫০ টাকা এবং আমদানির ক্ষেত্রে ১০৯ টাকা করে কেনাবেচা করা হবে।

গত এক বছর যাবত ডলারের বিপরীতে টাকার দর ধারাবাহিকভাবে কমছেই। নানা পদক্ষেপ নিয়েও এই দরপতন ঠেকানো যাচ্ছে না।

গত বছরের পহেলা জুন এক মার্কিন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল ৮৯ টাকা। আর ২০২৩ সালের ৪ঠা জুলাই ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৮.৮৫ পয়সা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে ডলার প্রতি দাম বেড়েছে ১৯.৮৫ টাকা।

এতোদিন যাবত বাংলাদেশে রপ্তানি, রেমিট্যান্স এবং আমদানির ক্ষেত্রে আলাদা-আলাদা ডলার রেট ছিল।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত দিয়েছিল, সবক্ষেত্রে যাতে ডলারের একক দর থাকে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান কিভাবে নির্ধারিত হবে সেটি যাতে বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাজারের উপর ছেড়ে দিলে টাকার অবম্যূল্যায়ন কি হতেই থাকবে?

অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এতো দিনে জোর করে ডলারের দাম টাকার বিপরীতে কমিয়ে ধরে রেখেছিল। কারণ ডলারের দাম বাড়লে তা আমদানির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তাদের ধারণা ছিল। সেটি ঠিক নয় উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ডলারের দাম ধরে রেখে কাঙ্খিত মাত্রায় রেমিটেন্স এবং রপ্তানী আয় করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। একই সাথে রয়েছে আইএমএফ’র শর্তও। যার কারণে সেই অবস্থান থেকে তাদেরকে সরে আসতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে নমিনাল রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট এবং রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট- এই দুই রেটেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান অতিমূল্যায়িত ছিল বলে মনে করেন তিনি।

নমিনাল রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট হচ্ছে, কোন দেশের মুদ্রার বিপরীতে আরেকটি দেশের মুদ্রার বিনিময় হার কেমন। এখানে দুই দেশের ক্রয়ক্ষমতাকে বিবেচনায় নেয়া হয় না। আর রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট হচ্ছে, কোন দেশের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার এবং এর সাথে সাথে মূল্য সূচক এবং তার প্রবণতাও তুলনা করা হয়।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশের মুদ্রা, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম-এদেশগুলোর তুলনায় ডলারের বিপরীতে টাকা অতিমূল্যায়িত ছিল। এখন হঠাৎ করেই ছেড়ে দেয়ার কারণে টাকার মান দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এটা আরো আগে করা উচিত ছিল। তাহলে এটা ধীরে ধীরে সহ্য হয়ে যেতো।

তিনি বলেন, টাকার এই মান পড়ে যাওয়াটা কিছু দিন ধরে চলবেই। এটা ততদিন চলবে যতক্ষন পর্যন্ত না ডলারের প্রাপ্তি, ডলারের সরবরাহ এবং অন্যান্য মুদ্রার সাথে ডলারের কেমন সম্পর্ক, এক্সচেঞ্জ রেট কত- এই সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে একটা জায়গায় গিয়ে থামবে। কিন্তু কিছুদিন পর্যন্ত এটা চলতে থাকবে। মার্কেট স্থিতিশীল হওয়া পর্যন্ত টাকা অবমূল্যায়িত হবে।

ধাপে ধাপে টাকার অবমূল্যায়ন করাটাই যথাযথ পদক্ষেপ বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তা না হলে এটা বাজারে এক ধরণের শক বা চাপ তৈরি করবে, মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করে বেড়ে যাবে এবং মানুষ এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না।

ডলারের দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়ার বিষয়টিকে বেশ ইতিবাচকভাবেই দেখছেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ডলারের দাম সমন্বয় করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি ডলারের রেট উন্মুক্ত করার পথে খুবই ছোট একটি পদক্ষেপ।

কারণ বাফেদা ও এবিবি কতদিন পর পর এই রেট ঠিক করবে তার কোন সুনির্দিষ্ট সময় সীমা দেয়া হয়নি। এরা প্রয়োজন অনুযায়ী রেট নির্ধারণ করে। তবে সেপ্টেম্বর নাগাদ তারা বাজার ভিত্তিক রেটের দিকে যাবে বলে বলা হচ্ছে।

ডলারের রেট বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান হু হু করে কমে যাবে-এটা ভ্রান্ত ধারণা বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, ডলারের বিপরীতে টাকার যে দাম উঠার বিষয়টি বলা হচ্ছে সেটি আসলে এরইমধ্যে উঠে গেছে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এক ডলারের বিপরীতে অনানুষ্ঠানিক মার্কেট বা কার্ব মার্কেটে ১১২ টাকা আর এর আশেপাশে পাওয়া যাচ্ছে। আর হুন্ডির ক্ষেত্রে এই রেট ১১৪-১১৫ টাকার মতো। আর এই ট্রেন্ড চলছে গত এক-দেড় মাস ধরে।

“এটা অলরেডি বাজারে এই রেটই প্রিভেইল করছে। খালি এটাকে আমরা স্বীকার করছি না ফর্মাল মার্কেটে।”

তিনি বলেন, যেই ধারণা মানুষের মনে আছে যে, ডলারের রেট বাজারের উপর ছেড়ে দিলে টাকা-ডলার রেট অনেক বেড়ে যাবে এবং এর কারণে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে- এটা একেবারেই ভুল। কারণ যা বাড়ার তা অলরেডি ঘটে গেছে। এখন এটা ছেড়ে দিলে ডলার সংকট কমে গেলে এটি মূল্যস্ফীতি কমাতে অবদান রাখবে।

ডলার সংরক্ষণের জন্য সরকার আমদানির উপর যে কড়াকড়ি আরোপ করছে ডলারের যোগান বাড়লে এই নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়বে না। উল্টো পণ্য উৎপাদন বাড়াতে এটি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে, বাংলাদেশে যেভাবে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের লেনদেন হয়ে থাকে, তা আন্তর্জাতিক মানের নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রেট মার্কেট রেটের তুলনায় অনেক কম ছিলো। তাই এই ব্যবধান কমিয়ে একটি একক রেট করার জন্য টাকার মান কমিয়ে ডলারের দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান এমটিবি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা আইএমএফ এর দেয়া ঋণের শর্তের মধ্যে দেশে ডলারের একটি একক রেট প্রচলনের বিষয়টি ছিল। তবে সেটি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে কোন শর্ত ছিল না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন চৌধুরী।

ডলার সংরক্ষণের জন্য সরকার আমদানির উপর যে কড়াকড়ি আরোপ করছে ডলারের যোগান বাড়লে এই নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়বে না। উল্টো পণ্য উৎপাদন বাড়াতে এটি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

তবে টাকার দরপতনের ঘটনা স্বীকার করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, টাকার আসলে দরপতন হয়নি। বরং ডলারের দাম ১০৯ টাকা করে বিক্রির সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাফেদা ও এবিবি। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা নিয়ন্ত্রণ করে না। তবে তারা ‘গাইড’ করে।

মি. হোসেন দাবি করেন, ডলারের দাম মুক্ত বাজারের উপর এরই মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

“এটা তো ওপেন মার্কেটে ছেড়ে দেয়াই আছে। এটা (ডলারের দাম নির্ধারণ) সবসময় বাফেদাই করে। কারণ প্লেয়ার হচ্ছে ব্যাংকগুলা। ওরাই চিন্তা করে কোন রেটে কিনবে। এটা ছেড়ে দেয়াই আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কোনভাবেই এটা নিয়ন্ত্রণ করে না।”

যদিও চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে যে, আগামী সেপ্টেম্বরে ডলারের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়ার লক্ষ্য রয়েছে। আর এই লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যেই ডলারের এক রেট প্রচলনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অংশ হিসেবে ডলারের দাম সমন্বয়ের এই ঘটনা ঘটলো।

এ বিষয়ে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাফেদার ওয়েবসাইটে যে রেট প্রকাশ করা হয়েছে সেটি দিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনবে অন্য বাংকগুলো। এই রেটে অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যেও ডলারের লেনদেন হবে। ফলে ভিন্ন ভিন্ন ডলার রেট থাকছে না।

তিনি আরো বলেন, এটাকে মার্কেট রেট বলা যাবে না। তবে আগামী সেপ্টেম্বরে বাজারের উপর ডলারের দাম নির্ধারণের বিষয়টি উন্মুক্ত করে দেয়ার পথে এটি আসলে একটি বড় পদক্ষেপ।

আগামীতে ডলারের দাম আরো বাড়বে কিনা-সে বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন মি. রহমান।

“তবে এটা মার্কেট ড্রিভেন রেটের দিকে যাচ্ছে। তবে কোন দিকে যাবে সেটা বলা যাচ্ছে না।”

বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে, বাংলাদেশে যেভাবে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের লেনদেন হয়ে থাকে, তা আন্তর্জাতিক মানের নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রেট মার্কেট রেটের তুলনায় অনেক কম ছিলো। তাই এই ব্যবধান কমিয়ে একটি একক রেট করার জন্য টাকার মান কমিয়ে ডলারের দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান এমটিবি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা আইএমএফ এর দেয়া ঋণের শর্তের মধ্যে দেশে ডলারের একটি একক রেট প্রচলনের বিষয়টি ছিল। তবে সেটি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে কোন শর্ত ছিল না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন চৌধুরী।