ট্রানজিট প্রস্তাব আরো স্পষ্ট করা দরকার – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in কালের কন্ঠ on 18 September 2022

ভারতের ভেতরে সড়ক ব্যবহার করে বিনা মাসুলে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি নিয়ে কথা বলেছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ রুমী

কালের কণ্ঠ: ভারত তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যে ট্রানজিট সুবিধার প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি কী?

মোস্তাফিজুর রহমান: ভারত আমাদের নৌ, স্থল ও আকাশপথে ট্রানজিট সুবিধার প্রস্তাব দিয়েছে, তবে সেটা আরো স্পষ্টীকরণ করার দরকার ছিল। কোন কোন বন্দর দিয়ে এই সুবিধা দেওয়া হবে, সেটি পরে জানানো হবে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের দিক থেকে যে বন্দরগুলো বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো ওই তালিকায় আছে কি না সেটা দেখতে হবে। ভুটান, নেপালের ক্ষেত্রে বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট স্থলবন্দরগুলো আমাদের বেশি কাজে লাগবে। আমরা ভুটানের সঙ্গে যদি রেল সংযোগ করতে চাই, তাহলে হলদিবাড়ী, চিলাহাটি—এই বন্দর আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটার ফল বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে বলে আমি মনে করি।

কালের কণ্ঠ : বিবিআইএনের সঙ্গে ভারতের নতুন সুবিধায় বাড়তি কী সুযোগ তৈরি হলো?

মোস্তাফিজুর রহমান: আমরা এর আগেই বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল মোটরযান চুক্তি (বিবিআইএন এমভিএ) করেছি। সেখানে ভারত তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য করার সুযোগ দিয়েছে। এর অধীনে সড়কপথে আমাদের কোনো ট্রান্সশিপমেন্টের প্রয়োজন পড়বে না। এর সঙ্গে আরো সংযুক্ত করে ভারত যে প্রস্তাবটা দিয়েছে, তাতে আমরা তৃতীয় দেশে রপ্তানি সম্প্রসারণ করতে পারি। মোটরযান চুক্তি ব্যবহার করে মুম্বাই পর্যন্ত যেতে পারেন আমাদের রপ্তানিকারকরা। এরপর মুম্বাই বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট করে পণ্য পাঠাতে পারেন ইউরোপ-আমেরিকায়। এটা যদি তাঁদের জন্য লাভজনক হয়, তাহলে এই সুবিধা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

যাঁরা নৌপথে পণ্য পরিবহন করেন, তাঁদের কলম্বো কিংবা সিঙ্গাপুর হয়ে অন্যান্য গন্তব্যে যেতে হয়। আমরা যদি সরাসরি মুম্বাই বন্দরে পণ্য নিতে পারি, তা আরো সাশ্রয়ী হতে পারে। ভারতের প্রস্তাব আমরা যাচাই-বাছাই করতে পারি। যত বিকল্প থাকবে আমাদের ব্যবসায়ীরা তত প্রতিযোগিতাসক্ষমভাবে আমদানি ও রপ্তানি করতে পারবেন।

কালের কণ্ঠ: ভারত পশ্চিমবঙ্গের হিলি থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত একটি মহাসড়কসহ নতুন উপ-আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্প শুরু করতে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে। এতে আমাদের কী লাভ হবে?

মোস্তাফিজুর রহমান: গত কয়েক বছর থেকেই ভারত তাদের সাতটি রাজ্যে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিকল্প করতে চাচ্ছে। একটি ছিল আশুগঞ্জকে আন্তর্জাতিক নৌবন্দর করে সেখান থেকে আগরতলা পর্যন্ত চার লেনের মহাসড়ক। ভারতের লাইন অব ক্রেডিটে সেই প্রস্তাব আছে। আরকেটি বিকল্প তারা মেঘালয়ের সঙ্গে করতে চাচ্ছে। আশুগঞ্জ দিয়ে মেঘালয়ে যাওয়া তাদের জন্য ভালো বিকল্প নয়। সরাসরি মেঘালয়ে যেতে এমন মহাসড়ক হলে সেখানে ভারতের সুবিধা হবে। সেখানে মহাসড়ক নির্মাণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের বড় অংশগ্রহণ থাকতে হবে। আবার একটি মহাসড়ক যখন হবে, সেখানে কেবল শুরু ও শেষ প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ হবে তা নয়। মাঝখানেও সুযোগ থাকতে পারে। এই সড়ক ব্যবহার করে বাংলাদেশও লাভবান হতে পারে। সেখানে কৌশলগতভাবেও বাংলাদেশের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। ভারতের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যৌথ বিনিয়োগে এটি করতে হবে। বাংলাদেশও যাতে এই মহাসড়ক পর্যাপ্তভাবে কাজে লাগাতে পারে, সেই সুযোগ রাখতে হবে।

কালের কণ্ঠ: ভারত আমাদের অন্যতম বাণিজ্য অংশীদার। দেশটিতে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে করণীয় কী?

মোস্তাফিজুর রহমান: ভারত বাংলাদেশের জন্য খুবই সম্ভাবনাময় বাজার। ভারত বছরে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আমরা আমদানি করি ১৩ বিলিয়ন ডলারের। উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংশ্লেষ সফলভাবে করতে পারলেই ভারতের সঙ্গে আমাদের বড় বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। আমাদের স্থলবন্দরের অবকাঠামোসহ নানা দুর্বলতা ও সমস্যা আছে। এগুলো দ্রুত দূর করতে হবে। মোটরযান চুক্তির সফল বাস্তবায়ন করতে গেলে এই রুটগুলোকে উন্নত করতেই হবে। আমাদের রপ্তানিকারকরা ভারতে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক, নানা রকম অশুল্ক বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। আলোচনার মাধ্যমে এগুলোর সমাধান করতে হবে।

কালের কণ্ঠ: ভারত আমাদের জন্য বড় বাজার। সেখানে রপ্তানি বাড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

মোস্তাফিজুর রহমান: ভারতে বড় ধরনের বাণিজ্যের সুযোগ আমাদের আছে। কিন্তু আমরা এখনো তা খুব একটা কাজে লাগাতে পারিনি। আমাদের বড় সমস্যা হলো, আমাদের রপ্তানি মূলত পোশাকনির্ভর। ভারতের বাজারে তৈরি পোশাক খুব বেশি রপ্তানির সুযোগ নেই। আমাদের সরবরাহ সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের যানবাহনের যে খরচ, তাতে ভারতে পণ্য পাঠাতে যে খরচ হয়, অনেক সময় ইউরোপে পাঠাতে গেলে তার চেয়েও কম খরচ হয়। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগব্যবস্থার ত্রিমাত্রিক সংশ্লেষ প্রয়োজন। ভারতকে আমরা মোংলা ও মিরসরাইয়ে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল দিয়েছি। সেখানে তারা বিনিয়োগ করে এই সুযোগটা ব্যবহার করতে পারে। ভারত আমাদের যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে ওই বিনিয়োগের পণ্য ভারতের বাজারে যেতে পারে। ভারত যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে সেগুলো আমরা তৈরি করে ভারতের শুল্ক সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভারতে রপ্তানি করতে পারি। ভারতে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। ১০ বছরে চার গুণ বেড়েছে। এটা খারাপ নয়। এখন এটাকে পরবর্তী ধাপে নিতে হবে।

কালের কণ্ঠ: দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যে একক মুদ্রা এবং বাণিজ্যজোট তৈরির আলোচনা আলোর মুখ দেখে না কেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: ২০১১ সাল থেকে আমরা সাফটার অধীনে ভারতের কাছ থেকে শূন্য শুল্ক সুবিধা পাচ্ছি, যা তারা ২০২৬ সাল পর্যন্ত দেবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। সার্কের অধীনে বাণিজ্যে খুব একটা অগ্রগতি হচ্ছে না; বিমসটেক, এফটিএতেও খুব একটা গতি নেই। তার চেয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর দিকে আমাদের বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এটা নিয়ে ধাপে ধাপে চিন্তা করতে হবে।

কালের কণ্ঠ: দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সেপা নিয়ে আলোচনায় আমাদের অগ্রাধিকার কী হতে পারে?

মোস্তাফিজুর রহমান: ভারতের সঙ্গে কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) আমাদের জন্য ইতিবাচক হবে। কিন্তু এটার মধ্যে আমাদের সুবিধা কী, ভারতের সুবিধা কী, আমরা কী প্রস্তাব করতে পারি—এগুলো আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে। ভারতের মতো বড় দেশের সঙ্গে অবশ্যই আমাদের কিছু প্রস্তাব করতে হবে। সেটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে আমাদের ওপর এটার অভিঘাত নেতিবাচক না হয়। ভারত আমাদের শূন্য শুল্ক দিয়েছে, কিন্তু আমরা সেটি এক দিনে দিতে পারব না। শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে তারা হয়তো দ্রুত উদারীকরণ করবে, আমাদের একটু আস্তে যেতে হবে। খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ভারতের সঙ্গে সেপার আলোচনায় যেতে হবে।

কালের কণ্ঠ: ভারত ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে কিছু কৌশলগত সমস্যা আছে। বৃহৎ এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?

মোস্তাফিজুর রহমান: চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে অগ্রসর হতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রেখেই আমাদের এগোতে হবে। চীনের সঙ্গে আমাদের অনেক অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে, ভারতের সঙ্গেও আছে। এই সম্পর্ককে ভারসম্যপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে। এটা যাতে সাংঘর্ষিক কিংবা বৈপরীত্যমূলক পর্যায়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক যে টানাপড়েন সেটা আমাদের উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে না দাঁড়ায়, সে দিকটা মাথায় রেখে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।