ডলারের দাম নিয়ে কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Published in বাংলাদেশ প্রতিদিন on Friday, 27 April 2018

অস্থির ডলার বাজার

সংকট হুন্ডির কারণে পাচারকারীদের শনাক্ত করতে তৎপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

মানিক মুনতাসির

প্রায় টানা ছয় মাস ধরেই অস্থির ডলারের বাজার। আর কয়েক দিন ধরে প্রতি মুহূর্তেই দাম বাড়ছে। বৃহস্পতিবার প্রতি ডলার ব্যাংকিং চ্যানেলে ৮৫ দশমিক ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর কার্ব মার্কেটে (খোলাবাজার) প্রতি ডলার ৮৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। ফলে আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে ডলারের বাজারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ভিন্ন কথা। ব্যাংকটির মতে, কয়েকটি ব্যাংক পরিকল্পিতভাবে ডলারের বাজার অস্থির করে রেখেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি অসাধু চক্র। যারা বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ডলার পাচার করছে। একটি বিশেষ গোষ্ঠী হুন্ডির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচার করায় স্থানীয় বাজারে ডলারের সংকট চলছে। ফলে টাকার বিপরীতে হু হু করে দাম বেড়ে চলেছে ডলারের।

এদিকে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি করা পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করেছে। এর প্রভাব মুক্ত নয় নিত্যপণ্যের বাজারও। ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণ খুঁজতে ও বাজার স্বাভাবিক করতে বাণিজ্যিক ব্যাংক অনুমোদিত ডিলার (এডি) ও মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এরপরও বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলসি খোলার ক্ষেত্রেও কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা প্রয়োজন। কে কোন পণ্য আমদানি করছেন। এলসি খোলার সঙ্গে আমদানি পণ্যের সামঞ্জস্য আছে কিনা এসব বিষয়ে অধিক যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সম্প্রতি দেশের পণ্য ও সেবা উভয়ের ক্ষেত্রেই বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মোট বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার বা ৯৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। ডলার সংকট আর দাম বাড়ার এটিও একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রায় ছয় মাস ধরেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর সঠিক কারণ খুঁজতে হবে। এতে কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগও উঠেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অন্য ব্যাংকারদের সচেতন হতে হবে। যদি কারও বিরুদ্ধে কারসাজির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

সূত্রমতে, বিভিন্ন চক্রের খপ্পরে পড়ে ডলার নিয়ে গভীর সংকট তৈরি হয়েছে দেশে। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে ডলারের। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার খোলাবাজারে ডলারের রেট ছিল ৮৬ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেট ৮২ দশমিক ৪০ টাকা হলেও কেউই তা মানছে না। এর আগে গত বছরের শেষদিকে বিভিন্ন ব্যাংক তথ্য গোপন রাখছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বলে জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এখনো কয়েকটি ব্যাংক পরিকল্পিতভাবে রেট বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা এর মধ্যে চিহ্নিতও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে তিনটি বিদেশি ও ১৭টি দেশীয় ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করে নোটিসও দিয়েছিল। সামান্য জরিমানা করে তাদের সতর্ক করা হয়েছিল। ফলে ডলারের বাজার এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ওইসব ব্যাংকের ভূমিকা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বাজার স্থিতিশীল রাখতে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস থেকে গত মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৯০ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। একই সময়ে বাজার থেকে কোনো ডলার কেনার প্রয়োজন হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের। অথচ গত অর্থবছর বাজারে ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রির বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সূত্রমতে, কয়েকটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলারের প্রকৃত বিক্রি মূল্যের তথ্য গোপন করছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যে রেট দিচ্ছে তার চেয়ে কমপক্ষে ২ টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রি করছে আমদানিকারকদের কাছে। আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না নেওয়া হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। অন্যদিকে আমদানিকারকদের পাশাপাশি সাধারণ বিদেশগামী রোগীরাও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এর প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কেননা ডলারের দাম বাড়াতে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। ফলে আমদানি পণ্যের দাম ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ডলারের বাজার এখনই স্থিতিশীল করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সূত্র জানায়, একটি চক্র খুবই পরিকল্পিতভাবে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। চক্রটি দেশের বাইরে ডলার পাচারও করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) এ বিষয়ে ইতিমধ্যে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। পাচারকারীদের তথ্য পেতে কাস্টমস অফিসসহ বিভিন্ন দফতরের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানির আড়ালে হুন্ডি হচ্ছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিদেশে চিকিৎসায় যাবেন এমন কারও পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করতে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হচ্ছে কিনা, সেদিকেও তীক্ষ দৃষ্টি রাখছে বাংলাদেশ ব্যাংক।