ডলার সংকট আরও বাড়বে সামনের দিনগুলোতে – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in বিবিসি বাংলা on 24 January 2023

ডলার সংকটের আরও অবনতি হতে পারে

বাংলাদেশে গত বছর থেকে যে ডলার সংকট শুরু হয়েছিল, নতুন বছরের শুরুতেও পরিস্থিতি উন্নতির কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনো ডলারের অভাবে তারা ব্যাংকে এলসি খুলতে পারছেন না। আমদানি মূল্য মেটাতে না পারায় পণ্য নিয়ে বন্দরে আটকে রয়েছে জাহাজ। এমনকি সরকারি অনেক উদ্যোগও ডলার সংকটের কারণে জটিলতায় ভুগছে।

যদিও এর আগে একাধিকবার বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছিলেন যে, নতুন বছরে নাগাদ ডলার সংকট মিটে যাবে।

সংকটের কোন সমাধান তো দেখা যাচ্ছেই না, উল্টো পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে আশংকা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

আমদানি সংকট কাটছে না

রোজা সামনে রেখে সাতটি পণ্য জরুরি ভিত্তিতে আমদানিতে সহায়তা করার জন্য ডিসেম্বরের মাসের শুরুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’ এসব পণ্য আমদানিতে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছিল। এসব পণ্য আমদানিতে প্রায় আড়াইশো কোটি ডলার দরকার হবে। সেই সময় ব্যবসায়ীদের এলসি সমস্যা মেটাতে একটা ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল’ খোলার কথাও জানিয়েছিল সরকার।

কিন্তু জানুয়ারি মাসের শেষদিকে এসেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিস্থিতির কোন বদল হয়নি। ফলে সোমবার আরেকদফা চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ডলার সংকটে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চিনি ও সয়াবিন তেল নিয়ে নিত্যপণ্য বহনকারী পাঁচটি জাহাজ বন্দরে আটকে রয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাঁচ ছয় মাস আগে থেকে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির এখনো খুব একটা উন্নতি হয়নি।

খাদ্য পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’পরিস্থিতির আসলে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। ব্যাংকগুলো এখনো ক্যাশ এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না।”

”কোন কোন ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি এলসি খুলতে বলছে। কিন্তু সেটা করলে অনেক অনিশ্চয়তা আছে। আমদানি করার পণ্যের কি দাম ধরব, ভবিষ্যতে কি ডলারের দাম কেমন হবে ইত্যাদি ঝুঁকি রয়ে যায়।‘’

দীর্ঘমেয়াদি এলসির ক্ষেত্রে সুদে তিনমাস বা ছয়মাস মেয়াদি হয়ে থাকে। তৃতীয় কোন ব্যাংক এলসির মূল্য পরিশোধ করে দেয়। মেয়াদ উত্তীর্ণের সময় ডলারের যে দাম থাকে, সেই দামে ব্যবসায়ীকে পরিশোধ করতে হয়।

বর্তমানে ডলারের সংকট থাকায় ব্যাংকগুলো এই পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু সুদের অতিরিক্ত হার এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বিবেচনায় অনেক ব্যবসায়ী তাতে রাজি হচ্ছেন না।

ডলার সংকটের সমাধান কতদূর

ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২) ৭৮০ কোটি ডলার সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ  খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, ‘’আমাদের ধারণা, এই পরিস্থিতি সহসা উন্নতি হবে না। বরং সংকট আরও বাড়বে সামনের দিনগুলোতে। ‘’

‘’তার কারণ হল, এই মুহূর্তে আমরা রেমিট্যান্স ও রপ্তানির কিছুটা ইতিবাচক ধারা দেখছি। কিন্তু চাহিদার বিপরীতে যে সরবরাহ আসছে, সেটা যথেষ্ট না। জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের জন্য বিপুল ডলার ব্যবহার করতে হচ্ছে, শিল্পকারখানার কাঁচামাল, সরকারি প্রকল্প তো রয়েছেই।”

”আইএমএফের ঋণ পরিস্থিতি কিছু নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে, কিন্তু হয়তো পুরোপুরি স্থিতিশীল করতে পারবে না।‘’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মোহাম্মদ মেজবাউল হক বলেছেন, ‘’সমস্যা সমাধানে সবরকম পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোকেও এলসি নিয়ে কোন সমস্যা থাকলে আমাদের জানাতে বলেছি। রেমিট্যান্স আসছে, রপ্তানি আয়েও ইতিবাচক ধারা রয়েছে। আশা করছি সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি মিটে যাবে।‘’

বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে সংকট শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে সাড়ে চারশো কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ, যা এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

পাশাপাশি আমদানিখাতে বেশ কিছু কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশে ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ২০২২ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬.৩৮ বিলিয়ন ডলার।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’রপ্তানি আয় এখন কিছুটা ভালোর দিকে। সেই তুলনায় আমদানি কিন্তু কমেছে।”

”যদিও বিশ্ববাজারে মন্দা আছে, যেরকম রপ্তানি অর্ডার পাওয়ার কথা, ততোটা আসছে না। কিন্তু অর্ডার আসতে শুরু করেছে, যদিও প্রাইসিং ইজ টাফ। কিন্তু এই পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে বলে আমরা আশা করছি। তখন রপ্তানি আয় আরও বাড়বে।‘’

তবে তিনি স্বীকার করছেন, বিশ্ববাজারে মন্দা থাকার কারণে তৈরি পণ্যের দাম যেমন ভালো পাওয়া  যাচ্ছে না, তেমনি ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

রিজার্ভের কী অবস্থা?

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানেদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৩২.৪৮ বিলিয়ন ডলার

সেখান থেকে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ ও ঋণ হিসাবে দেয়া ৭.২ বিলিয়ন ডলার কমানো হলে বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি হয়।

২০২১ সালের এই সময়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের আকার ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ বাংলাদেশের রিজার্ভের প্রধান উৎস। অন্যদিকে আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন ভাতা ইত্যাদি খাতে ডলার ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে ডলারের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়েছিল গত বছরের মে মাস নাগাদ। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কম আসায় ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা লেনদেনের বড় ঘাটতি তৈরি হয়।

ফলে ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা যাওয়ায় জুলাই-অগাস্ট মাসে ডলারের বিনিময় মূল্য রেকর্ড ছুঁয়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৩২.৪৮ বিলিয়ন ডলার

সেখান থেকে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ ও ঋণ হিসাবে দেয়া ৭.২ বিলিয়ন ডলার কমানো হলে বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি হয়।

গত বছরের এই সময়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের আকার ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি করতে না পায় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আকরাম উল্লাহ এর আগে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ডলারের সংকটের জন্য কয়লা আনা যাচ্ছিল না। যার কারণে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে জরুরি ভিত্তিতে এলসি সমস্যা সমাধান করে কয়লা আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে স্বল্প সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ সুবিধার রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের আকার এক বিলিয়ন ডলার কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ফলে ব্যাংক খাতে বৈদেশিক মুদ্রা সংকট আরেকটু তীব্র হবে। কারণ ব্যাংকগুলো এই তহবিলের আকারে এলসি খোলা কমিয়ে আনছে।

সোমবার একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপপ্রধান মাহমুদুল হাসান বলেছেন, ‘’ডলারের যে অ্যাডজাস্টমেন্টের কারণে আমদানি করা পণ্যের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে।‘’

রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ বাংলাদেশের রিজার্ভের প্রধান উৎস। অন্যদিকে আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন ভাতা ইত্যাদি খাতে ডলার ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে ডলারের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়েছিল গত বছরের মে মাস নাগাদ। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কম আসায় ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা লেনদেনের বড় ঘাটতি তৈরি হয়।

ফলে ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা যাওয়ায় জুলাই-অগাস্ট মাসে ডলারের বিনিময় মূল্য রেকর্ড ছুঁয়ে যায়।

আমদানি নির্ভর দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশে বরাবরই ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা লেনদেনে হিসাবে ঘাটতি থাকে।

কিন্তু গত বছর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় এই ঘাটতি অনেক বড় হয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে এজন্য দায়ী করছে বাংলাদেশের সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ ডলারের সংকট অনেকটাই মিটে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সেই পরিস্থিতি দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’দেশে আসলে ব্যবহারযোগ্য ডলার কি পরিমাণ রয়েছে, সেটি নিয়ে এই মুহূর্তে একটি সন্দেহ তৈরি হয়েছে।‘’

‘’বিভিন্ন রকমে আমরা যে হিসাব পাচ্ছি, সেটা যতটা না কাগজে কলমে, বাস্তবে যে ধরনের সমস্যার ভিতরে বিভিন্ন পর্যায়ে যেতে হচ্ছে, এলসি পেমেন্ট দেয়া যাচ্ছে না,নতুন এলসি খোলা যাচ্ছে না- সবকিছু মিলিয়ে আশঙ্কা হচ্ছে বাজারে অ্যাভেইলেবল ডলারের সরবরাহ হিসাবের চেয়ে অনেক কম।‘’

অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ডলারের সংকটকে পুরোপুরি স্বীকার করে নিয়ে উপযুক্তভাবে এবং বিভিন্ন খাতকে প্রাধিকার দেয়ার মাধ্যমে ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। সরকার দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, গাড়ির মতো বিলাসী পণ্য আমদানি, জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা, বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে এমন প্রকল্প গুরুত্ব দেয়া উচিত।