তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও দাম বেঁধে দিয়ে আমাদের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ

Originally posted in Bonik Barta on 1 April 2024

আমাদের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে, অনেক সময় তা অঞ্চলভিত্তিকও করে থাকে। তবে তারা যে দাম নির্দিষ্ট করে দেন তা নির্দেশনামূলক; নির্দেশমূলক নয়। গত ১৫ মার্চ ২৯টি পণ্যের দাম একটি পর্যায়ের মধ্যে থাকবে বলে তারা জানিয়েছেন। এর মধ্যে ২৯টি পণ্যের মধ্যে নয়টি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে, আটটির দাম কমানো হয়েছে। ১৫ মার্চ পণ্যের দাম বাড়ানোর পর দোকান মালিকরা ক্ষিপ্ত হওয়ার বিষয়টি নজরে আসে। কারণ বাজারে সাত-আটটি পণ্যের দরদাম ওঠানামা করা সাধারণত চোখে পড়ার মতো বিষয় নয়। ২০১৮ সালের কৃষি বিপণন আইন এবং কৃষি বিপণন অধ্যাদেশ-২০২১ অনুযায়ী একটি যুক্তিসংগত দাম নির্ধারণ করা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ম্যান্ডেট। তবে দাম নির্ধারণে জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা করা হলে তা যৌক্তিকও হয় না, কার্যকরীও হয় না। বাজারে এরই মধ্যে আমরা তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া দেখছি। কোনো একটা দাম নির্ধারণ করে দিয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, ‘এটি যৌক্তিক দাম’। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এক্ষেত্রে দাম নির্ধারণের যৌক্তিকতা বোঝার জন্য কোন স্টেজে কত টাকা ধরে হিসাব করা হচ্ছে, কী প্রক্রিয়ায় করা হচ্ছে সেসব জানা প্রয়োজন। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়েও স্পষ্টতা প্রয়োজন। ১৫ মার্চ ২৯টি পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার বিষয়টি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। কিন্তু ভোক্তারা এটি সাধুবাদ জানালেও বিক্রেতারা বলছেন এ দামে তাদের পোষাবে না। অনেক মাংস ব্যবসায়ী তো দোকান বন্ধও রেখেছেন। সৃষ্ট এ পরিস্থিতি খুব সহজেই এড়ানো যেত যদি মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতো এবং যে জায়গাগুলোয় ব্যত্যয় আছে তা শোধরানো যেত। আমরা জানি, অনেক জায়গায় ব্যত্যয় আছে, পাইকারি বিক্রি থেকে খুচরা বিক্রির জন্য যে দাম হওয়ার কথা তার হেরফের হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে দাম বেশি হচ্ছে। এ বিচ্যুতিগুলো বোঝা প্রয়োজন ছিল।

সরকার বাজার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবে বাজারের কিছু নিয়ম আছে—বাজারের সরবরাহ কত, চাহিদা কত, সেখানে স্টক কত আছে, আমাদের টিসিবি প্রয়োজনমতো পণ্যছাড় করার মাধ্যমে বাজারকে প্রভাবিত করার কতটুকু শক্তি রাখে, আমদানি আগের থেকে হয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আমদানি করতে গিয়ে কেউ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কিনা এখানে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা আছে কিনা সেটা জানা দরকার। যখন সীমিতসংখ্যক আমদানিকারকরা আমদানি করেন তখন একটা অলিগোপলিস্টিক বাজার তৈরি হয়। অর্থাৎ বিক্রেতারা নিজেদের মধ্যে আঁতাত করে। আবার সরকার নিজেও এটা করতে পারে। তবে সরকারের উচিত ব্যবসায় প্রবেশ না করা। সরকারের টিসিবি বলে একটা সংস্থা আছে, যারা মাঝে মাঝে খোলাবাজারে বিক্রি করে ও আমদানি করে। এটাকে মূলত কৌশলে ব্যবহার করতে হবে যেন প্রাইভেট সেক্টরের ব্যবসায়ীরা অলিগোপলিস্টিক ব্যবহার বা আঁতাতমূলক ব্যবস্থা না করতে পারে। আমদানিটা আমরা যত প্রতিযোগিতামূলক করতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। পাশাপাশি তদারকি জোরদার করতে হবে। ভোক্তা পর্যায়ের সব বাধা মাথায় রেখে খবরদারি ও পর্যালোচনা করতে হবে এবং বাধা নিরসন করতে হবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বা অন্যরা যখন হিসাব করে তখন আমদানির হিসাব করা হয় আমাদের অফিশিয়াল বিনিময় হার অনুযায়ী। কিন্তু দেখা যায়, আমদানিকারককে বাইরে থেকে বেশি দামে ডলার কিনে এলসি খুলে আমদানি করতে হয়েছে। এমন হলে তখন আমদানিকারকের মূল্য অফিশিয়াল মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। এজন্য এসব তথ্য-উপাত্তকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে, ইন্ডিকেটিভ প্রাইস বা নির্দেশক মূল্য (নির্দেশমূলক না) ঠিক করলে বাজারমূল্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। একই সঙ্গে আমাদের নজরদারি থাকতে হবে পাইকারি বিক্রির জায়গা থেকে পণ্য রিলিজ ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, গুদামজাত করা হচ্ছে কিনা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আগে থেকে পূর্বাভাস দেয়া আসলে সম্ভব নয়, আমরা যে দেশ থেকে পণ্য আমদানি করব সেখানে বৃষ্টি-খরা হওয়ার কারণে মূল্যের ওপর কী রকম প্রভাব পড়তে পারে, সেই প্রভাব দু-তিন মাসের আগে বোঝা সম্ভব নয়। তারপর গ্লোবাল কমোডিটি মার্কেটগুলোয় কী ধরনের প্রবণতা সেটা অনুমান করা এবং সেটার প্রভাব কী হতে পারে, আবার ব্যাংক তুলে দিলে সেটাই বা কেমন প্রভাব ফেলবে ইত্যাদি বিষয় একটি বিশ্লেষণের ব্যাপার। সেখানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ, অভিযোগ অধিদপ্তর এবং প্রতিযোগিতা কমিশনের ম্যান্ডেটকে তাদের যদি পালন করতে হয় তবে অবশ্যই তাদের শক্তিমত্তা, স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। মূল কথা, যেসব সংস্থা এর সঙ্গে জড়িত অর্থাৎ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন—তাদের জনবল বৃদ্ধি করে, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বাজার কোন দিকে যেতে পারে তা দেখতে হবে। সে অনুযায়ী আমদানি নিশ্চিত করতে হবে, মজুদ পণ্য ছাড়তে হবে। আবার আমদানি করার সময় ব্যবসায়ীদের ভিন্ন সহায়তা দেয়া যেতে পারে। যেমন আমাদের বাইরে অনেক মিশন আছে যেখানে কমার্শিয়াল কাউন্সিলর আছে। তারা এ খাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। কখন কত দামে কোন জিনিসটা পাওয়া যায়, তা সম্পর্কে অবগত করে আমদানির পরামর্শ দিতে পারেন তারা। ভালো কোল্ডস্টোরেজ, কুল চেইন যদি থাকে তাহলে আগাম আমদানি করলেও যেকোনো পণ্য ভালোভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকার ওয়্যারহাউজিং বা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। এভাবে চাহিদার পার্থক্যের কারণে বাজার ওঠানামা কিছুটা স্তিমিত করা সম্ভব।

তবে দীর্ঘমেয়াদে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের একটা পার্মানেন্ট এগ্রিকালচার প্রাইস কমিশন করার কথা ভাবা উচিত, যেমনটা ইন্ডিয়া করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কোনদিকে যেতে পারে, বাইরে থেকে আমদানি করলে মূল্য কমার বা বাড়ার প্রবণতা কতটুকু হতে পারে বা কতটুকু অস্থিতিশীল হতে পারে, আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কতটুকু হচ্ছে, আমাদের চাহিদা কেমনভাবে বাড়ছে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। চাহিদাও একটা ডায়নামিক পরিস্থিতির মধ্যে থাকে এবং অনেক সময় যখন জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় তখন চালের চেয়ে অন্যান্য বিষয়ের চাহিদা বাড়ে। যেমন হয়তো জীবনযাত্রার মান বাড়লে প্রোটিনের চাহিদা বাড়বে। এ ডায়নামিকসকে বিবেচনায় নিয়ে ভারতে পার্মানেন্ট এগ্রিকালচারাল কমিশন তথ্য, উপাত্ত, গবেষণার ভিত্তিতে পূর্বাভাস দেয় এবং কখন আমদানি করতে হবে তা নিয়ে সরকারকে ইঙ্গিত দেয়। দেশে কতটুকু মজুদ রাখতে হবে, কতটুকু পণ্য কোল্ডস্টোরেজে রাখতে হবে ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। বাজার ব্যবস্থাপনার পুরোটাই আসলে একটা বিজ্ঞান। আমি মনে করি, আমরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তাতে করে বাংলাদেশেরও সময় এসেছে পার্মানেন্ট এগ্রিকালচারাল কমিশন করার। এখানে বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা দরকার। বাজারের যে যৌক্তিক মূল্য তা ঠিক রাখতে যা করা প্রয়োজন সে অনুযায়ী তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে যেন। আমাদের দেশে এখন একটা জিনিস হলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেটার রিঅ্যাকশনে চলে যাই, কিন্তু বাজার সেভাবে চলে না। তাই আমার মনে হয়, পার্মানেন্ট এগ্রিকালচারাল কমিশনকে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক স্থায়ী কাঠামো দিতে পারলে ভবিষ্যতে দাম নির্ধারণ কিংবা নিয়ন্ত্রণে বেগ পোহাতে হবে না।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ও সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)