তৃতীয় দেশে ট্রানজিট নিয়ে বিবেচ্য বিষয়াবলি – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in সমকাল on 3 October 2022

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিনা মাশুলে ভারতে ট্রানজিট সুবিধার প্রস্তাব পেয়েছে বাংলাদেশ। নির্ধারিত স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ এ সুবিধা নিতে পারে। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে ভারত। দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে এসব বিষয় উঠে এসেছে। দুই প্রধানমন্ত্রী পারস্পরিক স্বার্থসংশ্নিষ্ট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য বিষয়েও আলোচনা করেছেন। কভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তাঁরা এ অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের স্বার্থে বন্ধুত্ব ও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যাপকতর সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে- ভারতীয় ভূখণ্ড বিশেষত স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিনা মাশুলে ট্রানজিট সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ। এই সুবিধা ব্যবহারে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সদ্য উদ্বোধন হওয়া চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটের মাধ্যমে ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর কার্যকারিতা ও সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে বিষয়টি বিবেচনা করতে রাজি হয়েছে ভারত। ওদিকে আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগগুলো কার্যকরে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী ক্রসিংয়ে বন্দর বিধিনিষেধ প্রত্যাহারে বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে ভারত।

বস্তুত প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। ট্রানজিট সুবিধার বিষয়টির মধ্যে বেশ নতুনত্ব রয়েছে। তাই প্রথমেই বিষয়টি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ট্রানজিট সুবিধা বলতে কি কোনো ধরনের মাশুল বা ফি ছাড়া পণ্য আমদানি-রপ্তানি বোঝানো হয়েছে; নাকি আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্য যেসব প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে, সেগুলো বোঝানো হচ্ছে? যেমন- ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পর্যাপ্ত পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কারণ আমরা দেখি, বাংলাদেশ থেকে ভারত কোন পণ্য আমদানি করবে এবং বাংলাদেশ ভারতে কোন পণ্য রপ্তানি করবে তা নির্দিষ্ট করা থাকে। এমনকি কী পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা যাবে তাও বেঁধে দেওয়া থাকে। এখন ট্রানজিট সুবিধার মানে মাশুল ছাড়া তৃতীয় দেশে আমদানি-রপ্তানির সুযোগ; নাকি চাহিদা অনুযায়ী আমদানি-রপ্তানির সুযোগ- তা স্পষ্ট নয়। এগুলো আমাদের জানা দরকার।

বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের ৬০ মিলিয়ন ডলারের মতো বাণিজ্য হয়; ভুটানের সঙ্গে হয় ৩৭ মিলিয়ন ডলারের। উভয় ক্ষেত্রে বাণিজ্যের ভারসাম্য বাংলাদেশের দিকে বেশি। নেপাল থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ডাল ও ডাল জাতীয় দানাদার শস্য। নেপালে বাংলাদেশ রপ্তানি করে ম্যানুফ্যাকচারিং ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য। এ ছাড়া রয়েছে প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন খাদ্যজাত পণ্য। ভুটান মূলত বাংলাদেশে রপ্তানি করে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য। বাংলাদেশ ভুটানে রপ্তানি করে ফার্নিচার, তৈরি পোশাক ও ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্য। বাংলাদেশ-ভুটানের মধ্যকার বাণিজ্যের আকার সীমিত। এটা রাতারাতি বৃদ্ধি পাবে- এমনটা বলা যাবে না। নেপাল-ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের বড় বাধা ভারতের রুট ব্যবহার করা। এবার সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে গেল। কারণ, নেপাল-ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির বড় কারণ হয়ে আছে দূরের রুট ব্যবহার করে কাঁচামাল ও পচনশীল পণ্য পরিবহন। এখন যদি ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করা যায় তাহলে স্বল্প সময়ে এসব জরুরি পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা যাবে।

বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। এখানে অনেক বিষয়ে সুরাহার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি সুবিধা কার্যকর হবে কিনা, তাও স্পষ্ট করা দরকার। এটা করতে পারলে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে বাণিজ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হবে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গেও বাণিজ্য বাড়বে। বাংলাদেশ ভারতকে তখনই সুবিধা দিতে পারে যখন দেওয়ার বিনিময়ে সুবিধা পাওয়া যাবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পুরো বিষয় পরিস্কার করে নিতে পারলে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান- সবাই লাভবান হবে।

বাংলাদেশকে কী ধরনের সুবিধা দেবে ভারত; ট্রানজিট নিয়ে দুই দেশ কী ধরনের সমঝোতায় এসেছে; তা এখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। সরকারের উচিত পূর্ণাঙ্গ আলাপ-আলোচনা করে কৌশল নির্ধারণ করা। এ ক্ষেত্রে দেশের নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে মন্ত্রণালয়ের উচিত ব্যাপক পরিসরে আলাপ-আলোচনা করা। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ কৌশল কাঠামো ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখন থেকেই প্রস্তুত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুটি কৌশল হতে পারে। একটি, আমরা কোনো সুবিধা দেব না; কোনো সুবিধা নেবও না। আরেকটি, সুবিধা দেব এবং সুবিধা নেব। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের উচিত আঞ্চলিক কাঠামোতে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও মালদ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। এমনকি মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এই যোগাযোগ স্থলপথের পাশাপাশি অন্যান্য রুটেও হতে পারে। কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক কৌশলগত আলাপ-আলোচনা ছাড়া দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উপকৃত হবে না।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। এ দেশে বড় বড় অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান। কর্ণফুলী টানেল হচ্ছে; যমুনায়ও হবে। পাবনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে; ঢাকায় মেট্রোরেল হচ্ছে। পদ্মা সেতু হয়ে গেছে; সেতুতে রেললাইনের কাজ চলছে। এই যে বড় বড় বিনিয়োগ; এগুলো অমূলক নয়; বরং যৌক্তিক বিনিয়োগ। কিন্তু এসবের সুফল পেতে হলে শুধু অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ওপর ভরসা করলে হবে না। এমনকি শুধু ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ-বাণিজ্যই যথেষ্ট নয়; মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ডের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। স্বল্পমেয়াদের বদলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বহুমাত্রিক চিন্তা করতে হবে। ট্রানজিটে বাংলাদেশ আসলে কী পাচ্ছে, তা পর্যালোচনা করতে হবে। তাই আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়িয়ে বাণিজ্যের পরিধি সম্প্রসারণ করতে হবে। এই যোগাযোগ কখনও দ্বিপক্ষীয়, কখনও ত্রিপক্ষীয়; কখনও উপ-আঞ্চলিক, কখনও আবার আঞ্চলিক হতে পারে। অর্থাৎ যখন যা প্রয়োজন তা করতে হবে।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)