বাংলাদেশে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার ভয়ংকরঃ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in প্রথম আলো  on Wednesday, 10 January 2017

সিডারের কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা

উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি

%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%a1%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%93-%e0%a6%b6%e0%a7%8dবছর বছর দেশের কৃষি ও শিল্প খাতে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। এ দুটি খাতে যে হারে মজুরি বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে

বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। ফলে শ্রমিকেরা কিছুটা বাড়তি মজুরি পেলেও দেখা যাচ্ছে তাঁদের মোট আয় দিয়ে আগের চেয়ে কম পরিমাণ পণ্য ও সেবা কেনা যাচ্ছে।

প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ার এ চিত্র উঠে এসেছে নবগঠিত সংস্থা সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের (সিডার) ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা, ২০১৭’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে।

এতে আরও দুটি চিত্র উঠে এসেছে, যাকে খুবই অস্বস্তিকর বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ দুটি হলো দেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ২৫ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। তাঁরা কর্মবাজারে নেই, শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। এঁদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ। আরেকটি চিত্র হলো দেশের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি।

রাজধানীতে গতকাল সোমবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্মেলনকক্ষে এক সেমিনারে এ প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। সিডার ও বিআইডিএস সেমিনারটি আয়োজন করে। এতে জানানো হয়, সিডার এখন থেকে নিয়মিত শ্রমবাজার পর্যালোচনা ও গবেষণা করবে। এটির প্রথম নির্বাহী চেয়ারপারসন হয়েছেন রুশিদান ইসলাম রহমান। এ ছাড়া এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে আরও আছেন এ টি এম নুরুল আমিন, রিজওয়ানুল ইসলাম, গোলাম রহমান ও কাজী শাহাবুদ্দিন।

সেমিনারে শ্রমবাজার নিয়ে পর্যালোচনার তিনটি অংশের প্রথমটি তুলে ধরেন সিডারের সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো রিজওয়ানুল ইসলাম। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নিজের করা হিসাব তুলে ধরে জানান, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে কৃষি খাতে মজুরি বেড়েছে (নামিক) ৫ দশমিক ১২ শতাংশ, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে প্রকৃত মজুরি কমেছে। একইভাবে শিল্প খাতে ওই বছর মজুরি বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে এ খাতেও প্রকৃত মজুরি কমেছে।

রিজওয়ানুল ইসলাম প্রতিবেদনে ২০১১-১২ থেকে চার অর্থবছরের হিসাব তুলে ধরেন। এতে দেখা যায়, প্রতিবছরই কৃষি ও শিল্প খাতে প্রকৃত মজুরি কমেছে। কারণ, প্রতিবছরই এ দুটি খাতে মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি ছিল।

বাংলাদেশে সব সময়ই বেকারত্বের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকে উল্লেখ করে রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, এটা উন্নত দেশগুলোকে লজ্জায় ফেলবে। কিন্তু বাংলাদেশে বেকারত্বের হার এত কম, কারণ এ দেশে একজন মানুষ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেই তাঁকে কর্মজীবী হিসেবে গণ্য করা হয়।

শ্রমবাজার পর্যালোচনার দুটি অংশ তুলে ধরেন রুশিদান ইসলাম রহমান। তিনি তরুণ জনগোষ্ঠী ও পোশাক খাত নিয়ে তাঁর উপস্থাপনায় জানান, ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী এ দেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৩৪ লাখ। এঁদের মধ্যে ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমবাজারে নেই, শিক্ষায় নেই এবং প্রশিক্ষণও গ্রহণ করছেন না। ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে এ হার আরও বেশি ছিল। তখন প্রায় ৩১ শতাংশ বা ১ কোটি ২২ লাখ তরুণ নিষ্ক্রিয় ছিলেন।

বিশ্বব্যাপী এ ধরনের তরুণদের নিট নামের একটি সূচক দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যার মানে হলো ‘নট ইন এমপ্লয়মেন্ট, এডুকেশন অর ট্রেনিং’। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) এ হার কমিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। গত মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তাদের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক সম্মেলনে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪০ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়।

রুশিদান ইসলাম জানান, বাংলাদেশে মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তার হার ছেলেদের চেয়ে কম। ছেলেদের ২৯ শতাংশ ও মেয়েদের ২২ শতাংশ শিক্ষা, চাকরি কিংবা প্রশিক্ষণের বাইরে আছে।

শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি থাকার চিত্রটিও তুলে ধরেন রুশিদান ইসলাম। তিনি ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেন, এসএসসি পাস করা ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার সাড়ে ৭ শতাংশ, এইচএসসি পাস ব্যক্তিদের মধ্যে এ হার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। স্নাতক ও স্নাতক পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে এইচএসসি পর্যন্ত শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার কমেছে। অন্যদিকে এ সময়ে উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার বেড়েছে। ২০১০ সালে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে আলোচকেরা শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব দেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের শিক্ষা খাত শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। শিল্প যে ধরনের শিক্ষা ও দক্ষতার কর্মী খুঁজছে, তা মিলছে না। ফলে বিদেশ থেকে লোক এনে কাজ করাতে হচ্ছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখন দেখা যাচ্ছে যত বেশি শিক্ষা গ্রহণ করছে, বেকারত্ব তত বাড়ছে। আগে বলা হতো পড়াশোনা করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। এখন তো দেখা যাচ্ছে যে যত পড়াশোনা করে, সে তত গাড়ির তলায় পড়ে। তিনি নিষ্ক্রিয় তরুণের হারকে ভয়ংকর বলে অভিহিত করেন।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, মানুষ চাকরি খুঁজে মরছে, আর শিল্পে লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এটা একটা কাঠামোগত সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জার্মানিতে কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ কর্মী নেওয়া হলে তাঁকে প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা করলে দেখা যাবে জনসংখ্যার চেয়ে শ্রমশক্তি বেশি হয়ে গেছে। একবার লুঙ্গি রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়ার পর দেখা গেল একটি লুঙ্গির রপ্তানিমূল্য দেখানো হচ্ছে ৪০০ মার্কিন ডলার। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে সুশাসনের বিষয়টি চলে আসে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী মোস্তাফিজুর রহমানের বক্তব্যের সূত্র ধরে একটি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের সুশাসনের বিষয়টি মনে করিয়ে দিচ্ছি।’

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক কে এ তৌফিক। এতে বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মুহাম্মদ ইউনুসসহ বিভিন্ন সংস্থার গবেষক ও কর্মকর্তারা বক্তব্য দেন।