আর্থিক খাতসহ পুরো শাসন ব্যবস্থায় নৈতিকতার বড় অভাব রয়েছেঃ অধ্যাপক রেহমান সোবহান

Published in আমাদের সময় on Sunday, 18 March 2018

তীব্র তারল্য সংকটে ব্যাংকিং খাত

হারুন-অর-রশিদ

ব্যাংকিং খাতে অলস তারল্যের মধুর সংকটের তৃপ্তি ছিল মাত্র ৬ মাস আগেও। কিন্তু তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে খাতটি। নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ বিতরণ করায় খাতটি বহুমুখী সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে। পুরনো খেলাপি ঋণের কারণে আক্রান্ত ক্যানসার তীব্রতর হতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিনের চেষ্টায় সিঙ্গেল ডিজিটে নামা সুদহার ফের সংখ্যায় ফিরে গেছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ডলার বিক্রি করা ব্যাংকগুলো এখন কিনছে ডলার। ব্যাংকিং খাতের এ সংকটের জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, সুশাসনের অভাব ও বাংলাদেশ ব্যাংককে ঠিকভাবে কাজ করতে না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকিং খাতকে তদারকি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ব্যাংকিং খাতের সংকট সম্পর্কে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান বলেন, আর্থিক খাতসহ পুরো শাসনব্যবস্থায় নৈতিকতার বড় অভাব রয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে সংকট চলছে। ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। খেলাপিরা প্রায় সবাই এলিট শ্রেণির। তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা রয়েছে। ঋণের সুদের হার (কস্ট অব লেন্ডিং) সবার জন্য এক রকম নয়। একেকজন একেক রেটে ঋণ পাচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজার প্রায় ধ্বংস হয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বাংলাদেশ ব্যাংক) বড় ধরনের ব্যর্থতা রয়েছে। সব কিছুতেই রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়ছে।

সূত্র জানায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ৯ ব্যাংকের মধ্যে দুটি ব্যাংকের বড় ধরনের অনিয়ম গত বছরের শুরুতে প্রকাশিত হতে থাকে। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের সব অর্থ মালিকরা লুটেপুটে খেয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাংকিং খাতে। আমানতকারীরা দুর্বল ব্যাংকে আর আমানত রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। এমনকি সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সরকারি ব্যাংকে রাখছে। এতে বিভিন্ন ব্যাংক চরম বেকায়দায় পড়েছে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের শুরুতে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বেড়েছে ব্যাপকহারে। দীর্ঘদিন মন্দা থাকার পর হঠাৎ চাহিদা বাড়ায় বেশ কিছু ব্যাংক নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করেছে। এতে প্রায় ১৯ ব্যাংক তাদের জমিয়ে রাখা তারল্য শেষ করে ফেলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম পরিপালনে ব্যর্থ হয়ে জরিমানার শিকার হয়েছে দুটি ব্যাংক।

এর আগে ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অলস তারল্য ছিল। এটিকে তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান মধুর সংকট বলে উল্লেখ করতেন। সেই মধুর সংকট এখন বিষিয়ে উঠেছে। টাকার জন্য ব্যাংকগুলোয় হাহাকার পড়ে গেছে। অর্থ সংগ্রহের জন্য ৩ থেকে ৬ শতাংশে নামা সুদহার ৯ থেকে ১২ শতাংশ উন্নীত করতে বাধ্য হয়েছে। আগে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া গেলেও এখন তা পাওয়া যাচ্ছে কমপক্ষে ১২ শতাংশ সুদে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য ফুরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এডিআর সীমা কমিয়ে দিয়েছে। এতে সব ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে। এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিয়েছে। বাড়তি আমানত সংগ্রহ করতে গিয়ে সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। আমানতের সুদহার বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই ঋণের সুদ হারও বাড়বে।

ব্যাংকিং খাতে চিরায়ত সমস্যা খেলাপি সংস্কৃতি আরও তীব্র হচ্ছে। গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৬২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। তবে গত বছরের শেষের দিকে ব্যাপকহারে পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ফলে বছরের শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ ৬ হাজার কোটি টাকা কমেছে। সুবিধাভোগী বড় অঙ্কের গ্রাহকরা খেলাপি হয়ে পড়ায় আবার নতুন করে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়েছেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ফারমার্স ব্যাংক একটি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আরও কিছু ব্যাংক সমস্যায় আছে?অতিতারল্য কমে গেছে?আর ব্যাংকগুলো এখন তাদের আমানত বাড়াতে সুদের হার বাড়াচ্ছে। এটি নিয়ে অযথা আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে।

এদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে ব্যাপকহারে। এতে ব্যাংকিং খাতে ডলার ফুরিয়ে গেছে। ডলারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ফুরিয়েছে ভল্টের টাকাও। এক বছর আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রির করত ব্যাংকগুলো। বৈদেশিক মুদ্রার আয় বেশি থাকায় প্রতিনিয়ত রিজার্ভ বেড়েছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ নতুন নতুন রেকর্ড গড়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকেই ব্যাংকগুলো উল্টো ডলার কিনছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল পর্যন্ত ১৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এতে ব্যাংকগুলোর ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এখন আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় রিজার্ভ নিম্নমুখী। ৩৩ বিলিয়ন ডলার থেকে রিজার্ভ চলতি মাসের শুরু থেকে ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। যদিও গত বৃহস্পতিবার তা আবার ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ডলারের চাহিদা বেশি থাকায় দাম অনেক বেড়েছে। আগে প্রতি ডলার ৭৮ থেকে ৭৯ টাকায় পাওয়া যেত। কিন্তু কয়েক মাস ধরে ডলার ৮৩ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

এদিকে আমদানি ব্যয় ব্যাপকহারে বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরের (জুলাই-জানুয়ারি) সাত মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ৪৭ বছরে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে; ৯৯৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ ছাড়া আলোচ্য সাত মাসে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি হয়েছে ৫৩৪ কোটি ডলার।

এদিকে সম্প্রতি ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত নতুন আইনে ব্যাংকে পারিবারিক প্রভাব বাড়ানো হয়েছে?এখন একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের সর্বোচ্চ চারজন সদস্য হতে পারবেন?টানা ৬ বছরের পরিবর্তে তারা ৯ বছর দায়িত্ব পালন করবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, এই আইন না করার জন্য আমরা বলেছিলাম। এতে পারিবারিক আধিপত্য বাড়বে। ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

এ ছাড়া ব্যাংকগুলোয় প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন ঘাটতি, সুশাসনের অভাব, বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, সরকারি ব্যাংকের লোকসানি শাখা ইত্যাদি সংকট রয়েছেই। সংকট বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আরোপিত নানা চাপের মধ্যে রয়েছেন। সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের হুমকিতে রয়েছেন অনেক ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক সূচকের চরম অবনতি হয়েছে। এ জন্য ১৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এর পরও অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। পর্যবেক্ষক থাকা ব্যাংকগুলো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক, বিডিবিএল, কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পর্যবেক্ষক রয়েছে ফারমার্স, এনআরবি কমার্শিয়াল, ইসলামী, ন্যাশনাল, এবি, বাংলাদেশ কমার্স ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে।