পণ্যমূল্য নিয়ে একটি গবেষণা সংস্থা থাকা উচিত – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in যুগান্তর on 24 August 2022

আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অনৈতিক, বেআইনি ও বেসামাল মুনাফা করে নিজেদের পকেট ভরেছে। জীবন ধারণে চড়া দামে নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে দিশেহারা ভোক্তা। আমদানি পণ্য থেকে শুরু করে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়েছে লাগামহীন গতিতে।

সরকারের যথাযথ তদারকি না থাকায় ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া মুনাফা লুটে নিয়েছে। অথচ যে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে, তার প্রভাব এখনই দেশে পড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এই মুহূর্তে বাজারে যেসব পণ্য আছে, তা অন্তত দু-তিন মাস আগের এলসি করা। অর্থাৎ আগে অপেক্ষাকৃত কমদামে আমদানি করা পণ্যই বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

ভোক্তার ত্রাহি অবস্থা দেখে প্রায় সপ্তাহখানেক পর সরকারের টনক নড়েছে। বিভিন্ন সংস্থার হস্তক্ষেপে ডিম, আটা, সয়াবিন তেল, চিনিসহ বেশকিছু পণ্যের দাম কমেছে। তবে তা যৌক্তিক দামের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। সাতটি নিত্যপণ্যের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে এসব পণ্যের দাম আন্তর্জাতিকভাবে কমেছে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ। এর বিপরীতে দেশীয় বাজারে কমেছে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ার কথা নয়। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাড়তি দামে এলসি খোলার পর সে পণ্যটি দেশে আসতে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ মাস সময় লাগে। রাশিয়া, ইউক্রেন, ব্রাজিল থেকে আসতে আরও বেশি সময় লাগে। আমদানি করা পণ্য সরাসরি প্যাকেজিং করে বাজারে ছাড়লেও ২ থেকে ৪ মাস সময় লাগবে। তবে ভারত ও মায়ানমার থেকে পণ্য এনে সরাসরি বাজারে ছাড়লে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগবে। এছাড়া যেসব পণ্য কাঁচামাল বা মধ্যবর্তী কাঁচামাল হিসাবে আমদানি হয় সেগুলো বাজারে ছাড়তে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ মাস সময় লেগে যায়।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা ওই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে লাগামহীণভাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কত বাড়ল, সে অনুপাতে কত হারে এবং কত দিন পর বাড়ানো যায় তার কোনো তোয়াক্কা করেনি। এমন কি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বিধিবিধানের প্রতি কোনো রকম সম্মান প্রদর্শন করেনি। অনেকটা যেমন খুশি তেমন করে তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে টাকা লুটে নিয়েছে। একই অবস্থা ঘটেছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও। শিল্পপণ্যের দাম সাধারণত ১ থেকে ২ মাস পর বাড়ার কথা। এবার বেড়েছে সঙ্গে সঙ্গে।

মার্চে আন্তর্জাতিক বাজারে সাবানের কাঁচামাল নুডুল সোপের দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ। আর তা কমেছে ১৬ শতাংশ। কাঁচামালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় কোম্পানিগুলো সাবানের দাম বাড়িয়েছে। ৪৫ টাকার সাবান বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা। দাম বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। কাঁচামালের দাম কমার পর এখন আর দাম কমেনি। এখন ব্যবসায়ীরা অজুহাত দিচ্ছেন ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার কারণে কাঁচামাল আমদানি ব্যয় ও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ সাবান প্রতি ১ টাকার কম বাড়ার কথা। পরিবহণ ব্যয় ৫ পয়সার বেশি বাড়বে না। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় ৯ শতাংশের বেশি বাড়বে না। ফলে কোনোভাবেই সাবানের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়তে পারে না। দেশে সয়াবিন তেল ও গমের বেশিরভাগ অংশই আমদানি হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ২৪ ফেব্র“য়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে এবং রাশিয়ার ওপর ইউরোপ ও আমেরিকা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করলে দুটি দেশ থেকে পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। মার্চে প্রতি টন গমের দাম ফেব্র“য়ারির শুরুর দিকের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়ে ১ হাজার ২৫২ ডলারে উঠে। তখন তা না করে আটার দাম বাড়িয়ে কেজিতে ৬৫ টাকার উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে ৭৫৫ ডলারে নেমেছে। দাম কমেছে ৩৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। কিন্তু খোলা বাজারে দাম কমেছে মাত্র ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জ্বালানি তেল ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বাদ দিলে কমার কথা কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ।

একই অবস্থা সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে। প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন গত মে মাসে ছিল ১ হাজার ৮৬৫ ডলার। তখনই দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়াতে বাজার থেকে তা উধাও করে ফেলে। প্রতি লিটারের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ২০৫ টাকায় উঠে। এখন তা আন্তর্জাতিক বাজারে কমে অপরিশোধিত তেলের দাম দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫০৫ ডলারে। দাম কমেছে ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। সামনে আরও কমতে পারে। অথচ দেশের বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল এখন ১৮২ টাকা। প্রতি লিটারে দাম কমেছে ১১ দশমিক ২২ শতাংশ। এপ্রিলে এলসি খোলা অপরিশোধিত সয়াবিন তেল পরিশোধন হয়ে এখন বাজারে আসার কথা। কিন্তু ১ হাজার ৩০০ ডলারে যেসব তেল আমদানি করা হয়েছে, যখন ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা, ওইসব তেলের দাম বাড়িয়ে বেআইনি ও অনৈতিক মুনাফা করেছেন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লেই দেশে বেড়ে যায়। এটি একেবারেই ঠিক নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে তার কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মাস বা আরও বেশি সময় পর বাড়তে পারে। সেটিও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সমন্বয় রেখে। কিন্তু দেশে এটি একেবারেই মানা হচ্ছে না। সরকারি সংস্থাগুলো এ বিষয়টি তদারকিও করছে না। ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে বাজার ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ সরকারের কাছ থেকে চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে। ভোক্তার জন্য এটি ভালো লক্ষণ নয়।

তিনি আরও বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ে একটি গবেষণা সংস্থা থাকা উচিত। যারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার, উৎপাদন, চাহিদা বিশ্লেষণ করে সরকারকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে। এর ভিত্তিতে সরকার আগাম ব্যবস্থা নিতে পারবে। প্রতি বছরই রোজার আগে চিনি, ছোলা, সয়াবিন তেল নিয়ে হইচই হয়। এটি কেন হবে? এই সময়ে চাহিদা বাড়বে, সে কারণে আমদানি বা উৎপাদন বাড়াতে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটি করা হচ্ছে না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৬ আগস্ট থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর অজুহাত দেখিয়ে ডিম নিয়ে এক তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটে গেছে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছে, ১৫ দিনের ব্যবধানে ডিম ও ফার্মের মুরগির দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৫১৮ কোটি টাকা। তেলের দাম বাড়ার কারণে প্রতি ডজন ডিমের পরিবহণ খরচ বাড়ার কথা সর্বোচ্চ ৬০ পয়সা। ১২০ টাকা থেকে ডিমের ডজন সর্বোচ্চ ১২২ টাকা হতে পারে। কিন্তু ডিমের দাম লাফিয়ে বেড়ে ১৬০ টাকা ডজন বিক্রি হয়েছে। পরে সরকারি সংস্থার হস্তক্ষেপে এখন ১২০ টাকায় নেমে এসেছে। দেশে ডিম আমদানি হয় না। দেশীয় ভাবেই এর চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ডিমের দাম বৃদ্ধির অজুহাতেও দেশে এর দাম বাড়ছিল। মার্চে প্রতি ডজন ডিম ছিল ১ দশমিক ২৮ ডলার। জুলাইয়ে তা বেড়ে ১ দশমিক ৮১ ডলার হয়। এখন তা কমে ১ দশমিক ৬৯ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। দাম কমেছে ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। দেশের বাজারে কমেছে ২৫ শতাংশ। পণ্যটি আমদানি হয় না। অথচ এর সঙ্গেও আন্তর্জাতিক ও ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত এসেছে।

দেশে চাহিদা অনুযায়ী চাল উৎপাদন হচ্ছে। তবে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে কিছু চাল আমদানি করা হয়। তবে আমদানি করা চাল বাজারের দামে প্রভাব ফেলতে পারে না। ১৭ মে প্রতি টন মাঝারি মানের চালের দাম ছিল ৩৬০ ডলার। এখন তা কমে ৩৪০ ডলার হয়েছে। দাম কমেছে ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে এর দাম বেড়েই চলেছে। গড়ে কেজিতে ৫ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ প্রতি কেজিতে চালের পরিবহণ খরচ বাড়ার কথা ৫০ পয়সা। জ্বালানি তেলের দাম ৬ আগস্ট বৃদ্ধির আগে প্রতি কেজি মিনিকেটের দাম ছিল ৬৫ টাকা। তেলের দাম বাড়ার পর থেকে এখন তা বেড়ে ৭৫ টাকা হয়েছে। ওই সময়ে এর দাম বেড়েছে ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এখনও তা বাড়ছে। এবার অজুহাত বন্যা ও সারের মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু এর প্রভাবে চালের দাম বাড়ার কথা আগামী আমন মৌসুমে। কেননা ওই সময়ে নতুন ধান আসবে। সেগুলোর উৎপাদন খরচ বাড়বে। এখন বাজারে যেসব চাল আছে সেগুলো বোরো মৌসুমের। এগুলোতে দাম বাড়ার কথা নয়।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ধান উৎপাদনের পর আর কৃষকের হাতে থাকে না। সেগুলো বড় বড় কোম্পানিগুলো কিনে নিচ্ছে। তারা মজুত করছে। আগে কৃষক বিভিন্ন সময় ধান বিক্রি করত। এখন করছে না। ফলে মৌসুম শেষ হলে বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যায়। তখন বড় কোম্পানিগুলো দাম বাড়াতে অল্প অল্প করে বাজারে ছাড়ে। এতেই বাড়ে দাম।

দেশে দুধের চাহিদার বড় একটি অংশ দেশীয় ডেইরি ও ব্যক্তিগত ফার্মগুলো থেকে মেটানো হয়। দুই মাস আগে প্রাস্তুরিত তরল দুধের দাম লিটারে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। ওই দামেই এখন বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু আমদানি করা গুঁড়ো ও প্রাস্তুরিত দুধের দাম বেড়েছে। ২৭ মে প্রতি টন ছিল ৫০০ ডলার। এখন তা কমে ৪০০ ডলারে নেমেছে। দাম কমেছে ২০ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে কমেছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক বাজারে ডালের দাম মার্চে ছিল প্রতি টন ৬৭১ ডলার। এখন তা কমে ৬১৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর দাম কমেছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। দেশের বাজারে কমেছে মাত্র ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।

এদিকে ৩০ মে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ ১১৭ ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ৮৬ ডলারে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে পরিশোধিত তেলের দামও কমে ৯৫ ডলারে নেমেছে। জ্বালানির দাম বাড়া ও কনটেইনার সংকটে গত বছরের মে মাসে জাহাজ ভাড়া ৭২ শতাংশ বেড়েছিল। এখন তা ৪২ শতাংশ কমে গেছে। কিন্তু দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ায় ছোট জাহাজের ভাড়া বেড়েছে, কমেনি।